ব্যাপক ক্ষতির মুখে ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন অন্তত ৬০ বড় ঋণগ্রহীতার

কমপক্ষে ৬০টি প্রতিষ্ঠান ঋণ পুনর্গঠনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান বলছে, তারা নিয়ন্ত্রণ-বহির্ভূত নানা কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এসব আবেদনের আওতায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫০ কোটি টাকা থেকে শুরু করে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অধিকাংশ আবেদনকারী সর্বোচ্চ ১৫ বছর মেয়াদি পুনর্গঠনের সুবিধা চেয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠন করে, যার লক্ষ্য হলো আর্থিক সংকটে পড়া ঋণগ্রহীতাদের পুনর্গঠনের মাধ্যমে কার্যক্রমে ফিরিয়ে আনা। এ কমিটি নীতি-সহায়তার সুপারিশ করবে, যাতে এসব প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারে এবং ব্যাংকগুলোর বকেয়া আদায়ও নিশ্চিত হয়।
ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ ইতোমধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নির্দেশ দিয়েছে, যেন বাহ্যিক পরিস্থিতির কারণে খেলাপিতে পরিণত হওয়া গ্রাহকদের জন্য ঋণ পুনর্গঠনের প্রস্তাব জমা দেয়। এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি খেলাপি ঋণধারীরা এ সুবিধার আওতায় থাকবেন। পরে নীতিমালা সম্প্রসারণ করে আর্থিক সংকটে পড়া অ-খেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ঋণ পুনর্গঠনের জন্য যেসব কারণকে বৈধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা।
২৫ মার্চ পর্যন্ত ৩০টি ব্যাংক ৬০টি ক্লায়েন্টের পক্ষে প্রস্তাব জমা দিয়েছে। অধিকাংশ আবেদন ব্যাংকের মাধ্যমেই পাঠানো হলেও, কয়েকটি সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বা সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির কাছে জমা পড়েছে। সব আবেদন পরবর্তীসময়ে বাছাই কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ১০টিরও বেশি আবেদন পর্যালোচনার আওতায় রয়েছে। উল্লেখযোগ্য আবেদনকারীদের মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মা, জেএমআই গ্রুপ, আব্দুল মোনেম লিমিটেড এবং এনার্জিপ্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির একজন সদস্য বলেন, 'বেশিরভাগ আবেদনকারীই সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ অভ্যাসগত খেলাপি, আবার কেউ হাই-প্রোফাইল কোম্পানি। এদের মধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি আগে একাধিকবার ঋণ পুনঃতফসিল করেছেন।'
অনেক আবেদনকারী রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আর্থিক ক্ষতির প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ কোভিড-১৯-এর ধাক্কা, ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক মন্দা এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের দিকেও আঙুল তুলেছেন।
বিনিময় হারের ক্ষতি নিয়েও কয়েকজন আবেদনকারী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের যুক্তি, তারা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন কম বিনিময় হারের ভিত্তিতে সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু অর্থপ্রদান সেই পুরোনো হারে থাকলেও ব্যাংকগুলো এখন বর্তমান উচ্চ বিনিময় হারে অর্থ গ্রহণ করছে—ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ব্যাপক আর্থিক চাপ তৈরি হয়েছে।
কমিটি এখন এ অতিরিক্ত ব্যয়কে আলাদাভাবে বিবেচনা করে দীর্ঘমেয়াদি সময়সীমায় পরিশোধের সুযোগ রাখা যায় কি না, তা মূল্যায়ন করছে। এ বিষয়ে সুপারিশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে।
পর্যালোচনাধীন প্রধান আবেদনসমূহ
বেক্সিমকো ফার্মার নিজের নামে কোনো খেলাপি ঋণ না থাকলেও, গ্রুপভুক্ত অন্যান্য কোম্পানিগুলোর আর্থিক চ্যালেঞ্জের কারণে তারা ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন করেছে, বিশেষত আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সুরক্ষার স্বার্থে। এ কারণে কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে, যেন কোম্পানির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত না হয়।
জেএমআই গ্রুপ ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের জন্য আবেদন করেছে; আবেদনটি বর্তমানে পর্যালোচনার আওতায় রয়েছে। অন্যদিকে, আব্দুল মোনেম লিমিটেড প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে এবং প্রতিষ্ঠানটি এ সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনায় রয়েছে, কারণ তারা ইতোমধ্যে তাদের খেলাপি ঋণের ৪ শতাংশ পরিশোধ করেছে।
এনার্জিপ্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ভাগ্য এখনও অনিশ্চিত। কমিটির এক সদস্য জানান, কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থান দুর্বল এবং তাদের ব্যাপারে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
২৬ মার্চ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে এনার্জিপ্যাকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশিদ বলেন, প্রতিষ্ঠানটি দায় পরিশোধে ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন করেছে, তবে তাৎক্ষণিকভাবে পাওনাদারদের অর্থ শোধ করতে পারেনি। তিনি বলেন, 'আমরা একাধিক সরকারি প্রকল্প শেষ করেছি। সরকার প্রতি ডলারে ৯১ টাকা দিচ্ছে, কিন্তু ব্যাংক ১২০ টাকা বা তার বেশি আদায় করছে। বাকি টাকা আমরা কোথা থেকে আনব?' তিনি আরও জানান, কোম্পানিটির কার্যকরী মূলধনের সীমা ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কমিটির কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি।'
কমিটির একজন সদস্য জানান, কিছু আবেদনকারী আর্থিকভাবে সক্ষম এবং রপ্তানি আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। তবে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনের বিধানের কারণে তাদের ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ সীমিত। এ অবস্থায় ব্যাংকের প্রতিনিধিরা আইনি সীমাবদ্ধতা থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করেছেন এবং বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চলছে
২৫ মার্চ টিবিএস-কে কমিটির সদস্য ও অর্থনীতিবিদ মামুন রশিদ জানান, প্রতিটি আবেদন পৃথকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, 'আমরা সিআইবি রিপোর্ট, কার্যকরী মূলধনের অবস্থা এবং মেয়াদি ঋণের ইতিহাস বিশ্লেষণ করছি। ঋণগ্রহীতা ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সঙ্গে শুনানিও করছি। অনেক ব্যাংক ঋণ পুনর্গঠনে আগ্রহী হলেও, বর্তমান নীতিমালার সীমাবদ্ধতা তাদের সে সুযোগ দিচ্ছে না। সম্ভাব্য সমাধান খুঁজতে আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করছি।'
তিনি আরও বলেন, যারা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে পুনর্গঠনের আবেদন করেছে—বিশেষত যেসব প্রতিষ্ঠান কর্মসংস্থান ও রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে—তাদের ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া হচ্ছে।
নীতিমালার আওতা বিস্তৃত
১০ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নতুন নির্দেশনায় পুনর্গঠন সহায়তার পরিধি সম্প্রসারিত হয়। পূর্ববর্তী নীতিমালায় ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫০ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণধারীদেরই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সংশোধিত নীতিতে এখন সেইসব প্রতিষ্ঠানও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যারা ওই সময়ের পরে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে কিংবা আর্থিক সংকটে ভুগছে কিন্তু এখনো খেলাপি হয়নি।
তিনবার বা তার কম পুনঃতফসিল হওয়া ঋণগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ঋণগ্রহীতাদের প্রকৃত নগদ প্রবাহের ভিত্তিতে একটি পরিশোধ পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। আবেদনের শেষ সময় ৩০ এপ্রিল।
খেলাপি ঋণ বেড়ে চলেছে
২৬ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এচ মনসুর জানান, ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যেখানে গত সেপ্টেম্বর মাসে এ অঙ্ক ছিল দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা।
ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসেবে, বিতরণকৃত মোট ঋণের মধ্যে ২০ দশমিক ২ শতাংশই ছিল খেলাপি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।