ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের মাঝেই আসন্ন বিনিয়োগ সামিটে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে প্রস্তুত বিডা

নতুন করে শুল্ক আরোপ করে যখন বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা তৈরি করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, ঠিক সেই সময়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ৭–১০ এপ্রিল একটি বড় আকারের বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সম্মেলনের লক্ষ্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে—নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ডিজিটাল অর্থনীতি, টেক্সটাইল ও পোশাক, স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধ শিল্প এবং কৃষি প্রক্রিয়াকরণ—বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
আয়োজকরা জানান, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের উপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার 'বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫'-এ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে একটি হ্রাসকৃত শুল্ক কাঠামো তৈরির কাজ শুরু করেছে।
বিডা এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) সম্মেলনটি যৌথভাবে আয়োজন করছে। চার দিনের এ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ।
নতুন শুল্ক আরোপের কোনো প্রভাব পড়বে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, 'এর তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব পড়বে না। যারা (বিনিয়োগকারী) যোগ দিতে যাচ্ছেন, তারা এখনও আসবেন। তবে, তারা আমাদের প্রতিক্রিয়া নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন।'
তিনি বলেন, 'বিনিয়োগকারীরা পর্যবেক্ষণ করবেন বাংলাদেশ সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং নীতিগত পর্যায়ে কীভাবে বিষয়টি সমাধান করছে। শীর্ষ সম্মেলনে অবশ্যই এই বিষয়ে আলোচনা হবে।'
আশিক আরও বলেন, 'আমরা আশা করছি ৯ এপ্রিলের মূল অনুষ্ঠানের আগেই শুল্ক ইস্যু মোকাবিলায় একটি নির্দেশিকা তৈরি করতে পারব।'
তিনি জানান, 'সরকার আমদানিকৃত মার্কিন পণ্যের উপর শুল্ক পর্যালোচনা করছে এবং এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করবে। আমরা ধাপে ধাপে বেসরকারি খাত ও সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করছি। একটি টেকসই সমাধান খুঁজে পেতে আমরা মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গেও যোগাযোগ করব।'
তিনি আরও বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রধান বাজার হওয়ায় নতুন শুল্ক পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।'
'শুধু বাংলাদেশই নয়, আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোও এই শুল্কের প্রভাবে পড়েছে। তাই বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন,' বলেন তিনি।
আয়োজকদের ভাষ্য, তারা শীর্ষ সম্মেলনটিকে একটি মাইলফলক ইভেন্ট হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, যেখানে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা এবং [জুলাই] অভ্যুত্থান-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংস্কারকে তুলে ধরা হবে। ইতোমধ্যে বিশ্বের ৫০টি দেশ থেকে ২ হাজার ৩০০ জনেরও বেশি ব্যক্তি সামিটে অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন করেছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন ৫৫০ জনেরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগকারী।
'স্থানীয় ও বিদেশি—উভয় ধরনের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আমরা ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। তবে সবাইকে হয়তো স্থান দিতে পারব না। আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণকারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে,' বলেন চৌধুরী আশিক।
শুল্ক যুক্তিসঙ্গতকরণের প্রচেষ্টা চলছে
যুক্তরাষ্ট্র নতুন শুল্ক পরিকল্পনা ঘোষণা করার পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৃহস্পতিবার এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, বাংলাদেশ এখন মার্কিন আমদানির উপর শুল্ক যুক্তিসঙ্গত করার উপায় খুঁজে বের করার জন্য পর্যালোচনা করছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তাইয়্যেব ফেসবুকে লেখেন, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশ একটি হ্রাসকৃত শুল্ক কাঠামো প্রস্তুত করছে।
তিনি আরও জানান, অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড), বিশেষ ইপিজেড এবং হাইটেক পার্কগুলোতে বাংলাদেশ দেশি ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ ও ঝামেলামুক্ত নিবন্ধন, রপ্তানি প্রণোদনা, নিরাপদ জমি, নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ, উচ্চগতির ইন্টারনেট, নমনীয় অবকাঠামো, ডেটা সেন্টার, ক্লাউড নীতি এবং আইটি সুবিধা প্রদান করবে।
'পোশাক রপ্তানি হ্রাসের প্রভাব কমাতে আমরা প্রযুক্তি ও আইসিটি রপ্তানি বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছি,' শুক্রবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন।
তিনি বলেন, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি সরাসরি আমদানির মাধ্যমে আমরা দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারি এবং পারস্পরিক শুল্ক হ্রাসের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারি।'
বিডা ও বেজা কিছু অংশগ্রহণকারী বিনিয়োগকারীকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শনে নিয়ে যাবে।
বিনিয়োগ পেশাদারেরা যা বলছেন
'শুল্ক প্রতিযোগী দেশগুলোকেও প্রভাবিত করছে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা মজবুত করতে কিছুটা সফলতা দেখিয়েছে, ফলে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা হ্রাস পাবে না,' বলেন চার্টার্ড আর্থিক বিশ্লেষক এবং প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান।
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, 'বিশ্বজুড়ে মার্কিন শুল্কের প্রভাব বিনিয়োগকারীদের আস্থায় ধাক্কা দিতে পারে, কারণ বৈশ্বিক মন্দার ঝুঁকি ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান।'
তিনি আরও বলেন, 'অন্যান্য যেকোনো সংকটের মতো এই ঘটনাও বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছানোর একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে।'
মনিরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ টিকফা (বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি)-এর মতো কাঠামোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে, যেখানে তুলা আমদানিতে কম শুল্ক নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এছাড়া তৈরি পোশাকে ৩৭ শতাংশ শুল্ক হ্রাস কিংবা মার্কিন তুলা দিয়ে তৈরি পোশাকের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার অর্জনেরও সুযোগ আছে।
তিনি বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্যশস্য ও পেট্রোলিয়াম আমদানির সম্ভাবনা অনুসন্ধানে পরামর্শ দেন। শুল্ক বৃদ্ধিতে চ্যালেঞ্জ তৈরি হলেও, কম খরচের পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব এবং বৈশ্বিক মন্দা-চালিত আমদানি ব্যয় হ্রাসের ফলে কিছুটা ভারসাম্য সৃষ্টি হতে পারে।
মনিরুজ্জামান বলেন, 'বাংলাদেশে বিনিয়োগের আকর্ষণ এখনো শক্তিশালী, কারণ কারখানা স্থানান্তর সময়সাপেক্ষ এবং ক্রেতারা কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেশের ঝুঁকি সতর্কভাবে মূল্যায়ন করেন।'
সিএফএ সোসাইটি বাংলাদেশের সভাপতি আসিফ খান বলেন, এখনই স্পষ্ট করে কিছু বলা সম্ভব নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশ এই বড় ঘটনায় কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।
তিনি বলেন, 'অন্যান্য দেশও একই ধরনের সুরক্ষাবাদী নীতি গ্রহণ করতে পারে, অথবা তারা নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণে মনোনিবেশ করতে পারে। যদি পরবর্তীটি ঘটে, তাহলে বাংলাদেশ রপ্তানি কোম্পানিগুলোর জন্য একটি উত্তম উৎপাদন ও বাণিজ্য বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।'
আসিফ আরও বলেন, 'বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারও বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় একটি সুযোগ। তবে দীর্ঘদিন ধরে যে বিনিয়োগ-বাধার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো বাংলাদেশকে কাটিয়ে উঠতে হবে।'
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশ একটি শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক কৃষি উৎপাদনকারী দেশ হলেও, এর কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাত—বিশেষত ফল ও শাকসবজির ক্ষেত্রে—এখনও অনুন্নত। বিনিয়োগ সম্মেলনে এই খাতের সম্ভাবনা তুলে ধরা গেলে তা ক্রেতা ও বিনিয়োগকারী উভয়কেই আকৃষ্ট করতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের কৃষি-প্রক্রিয়াজাত পণ্য শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্ববাজারেও পৌঁছেছে। নতুন শুল্ক বিনিয়োগের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, তবুও আমাদের মানসম্পন্ন ও সাশ্রয়ী পণ্যের শক্তিশালী চাহিদা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে। বাংলাদেশ একটি বিশাল বাজার, যেখানে প্রচুর শ্রমশক্তি এবং বৈচিত্র্যময় সুযোগ বিদ্যমান।'