আইএমএফের কিস্তি ছাড় বিলম্বে বিশ্বব্যাংক-এডিবির ১৪০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তাও কি অনিশ্চিত?

জুনের মধ্যেই বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ১৪০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশের, যা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল- আইএমএফ এর ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের কিস্তি ছাড়ে বিলম্বের কারণে। যা মূলত গেল ফেব্রুয়ারিতেই পাওয়ার কথা ছিল।
বিলম্বের ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া
বিশ্বব্যাংক ও এডিবি ছাড়াও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি), ওপেক ফান্ড এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা (জাইকা) থেকে আরও ৮০ কোটি ডলার পাওয়া নিয়েও এখন সন্দেহ দেখা দিয়েছে।অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের একটি উচ্চপর্যায়ের সভায় এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
ঋণের পরবর্তী কিস্তি ছাড়ে কয়েকটি শর্ত ছিল আইএমএফের, যার মধ্যে রাজস্ব আহরণ, বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রা (ফরেক্স) রিজার্ভের শর্ত পূরণ না হওয়ায় সংস্থাটি অর্থ ছাড় করেনি। যার এই প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যেও। কারণ আইএমএফের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পর্যালোচনার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই— বিশ্বব্যাংক ও এডিবি তাদের বাজেট সহায়তা দিয়ে থাকে। তাই আইএমএফ উদ্বেগ দেখালে, অন্যান্য ঋণদাতারাও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
একই ঘটনা দেখা গেছে পাকিস্তানে (২০২২-২৩) এবং শ্রীলঙ্কায় (২০২২ সালে)। যেখানে আইএমএফ ঋণ ছাড়ে বিলম্ব করায়— বিশ্বব্যাংক আর এডিবিও বাজেট সহায়তা স্থগিত রেখেছিল।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জানান, আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি চলমান না থাকলে— বিশ্বব্যাংকও বাজেট সহায়তা নিয়ে 'এগোতে পারে না'। এডিবি এগোবে এমন সম্ভাবনাও কম।
তিনি বলেন, 'আইএমএফ সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা সম্পর্কে নিশ্চয়তা প্রদান করে। তাই সংস্থাটির ঋণ কর্মসূচি স্থবির থাকলে— এডিবি ঋণ দেওয়ার পেছনে কোন যুক্তি দেখাবে?'
এমনকী জাপান এবং উপসাগরীয় দাতা দেশগুলোর মতো দ্বিপক্ষীয় দাতারাও রাজনৈতিক চাপের মুখে দ্বিধা করবে। 'আইএমএফ যদি ঋণ না দেয়, তাহলে আমরা কেন দেব'- এটাই তখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠবে, যোগ করেন ড. জাহিদ।
এপ্রিলে আইএমএফের প্রতিনিধি দল আসছে, তবে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে
আগামী এপ্রিলেই আসছে ঢাকা আসছে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল। তারা যদি জুনের কিস্তি ছাড়ও করে – তাহলেও চলতি অর্থবছর শেষ হওয়ার আগে বাজেট সহায়তা পাওয়া কঠিন হবে – অনুমোদনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ জুনে কিস্তি পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী, তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, ভ্যাটের একক হার কার্যকর করা ও বাজার-ভিত্তিক বিনিময় হার চালুর মতো আইএমএফের শর্তগুলো বেশ কঠিন। আসন্ন বাজেটে ভ্যাট-বিষয়ক এই সংস্কার আসতে পারে, তবে বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, 'জুন থেকে এক্সচেঞ্জ রেট পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হবে, এটা বলা যাবে না।এক্সচেঞ্জ রেট বাজারের উপর ছেড়ে দিলে তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, দেশ হঠাৎ করে শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে যেতে পারে।'
আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে বাজেট সহায়তা না নিলে বিপুল পরিমাণ প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) ও রপ্তানি আয়ের প্রয়োজন হবে, যা হঠাৎ করে বাড়ানো সম্ভব নয় বলেও জানান অর্থ উপদেষ্টা।
অর্থনৈতিক ঝুঁকিসমূহ
বৈদেশিক বাজেট সহায়তা ছাড়া— ভর্তুকি ও উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে টানাটানিতে পড়তে পারে। এতে সরকারের অভ্যন্তরীণ উৎসের ঋণ বেড়ে যাবে। অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ বেড়ে গেলে ব্যাংকে 'ক্রাউডিং আউট' পরিস্থিতি তৈরি হবে। এতে বেসরকারিখাত ব্যাংক ঋণ থেকে বঞ্চিত হবে। যার সঙ্গে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও মানি সার্কুলেশন জড়িত বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
অর্থনীতিবিদ মাসরুর রিয়াজ সতর্ক করে বলেন, সরকারি ব্যয় বা সরকারের উন্নয়ন ব্যয় কম হলে— প্রবৃদ্ধি সহায়ক সরকারি বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হয়। এটা বেসরকারি পুঁজি এবং সার্বক বিনিয়োগ পরিবেশকে আঘাত করবে। বেসরকারিখাতের ঋণ প্রাপ্তিকেও সংকুচিত করবে।
চলমান ঋণ আলোচনাসমূহ
অনিশ্চয়তা সত্বেও বাংলাদেশ বর্তমানে বেশ কয়েকটি ঋণ পেতে আলোচনা করছে, এগুলো হলো:
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১০০ কোটি ডলারের (রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড গভর্ন্যান্স প্রোগ্রামস)
এডিবির সঙ্গে ৯০ কোটি ডলারের (ব্যাংকিং অ্যান্ড ক্লাইমেট প্রোগ্রামস)
জাপানের সঙ্গে ৪১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের (ইকোনমিক অ্যান্ড ক্লাইমেট পলিসি লোন), এবং
এআইআইবির সঙ্গে ৩০ কোটি ডলারের (জলবায়ু কর্মসূচির অধীনে)।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ১০.২ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিল। এর মধ্যে বাজেট সহায়তার পরিমাণ ছিল ২.০৩ বিলিয়ন ডলার। তবে আরও অর্থছাড় নির্ভর করছে আইএমএফের কিস্তি অনুমোদনের ওপর। যা না পেলে, সামনের মাসগুলোতে সরকারকে ব্যয় সংকোচনের কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে।