প্রতিষ্ঠাতার পর উত্তরাধিকারীদের হাতে কেন টেকে না বাংলাদেশের পারিবারিক ব্যবসা

বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড গড়ে তুলেছে পারিবারিক মালিকানাধীন ব্যবসা। কিন্তু এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হস্তান্তরের সময় এর বড় অংশই টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়। পরিবারের ভেতরেই ব্যবসা ধরে রাখার প্রবল ইচ্ছা থাকলেও, কাঠামোবদ্ধ পরিকল্পনার অভাব বহু দশকের উত্তরাধিকার ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
এই জরুরি চ্যালেঞ্জই উঠে আসে গতকাল মঙ্গলবার মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) আয়োজিত সেমিনার "হয়্যার ফ্যামিলি ভেল্যুজ মিট ফিউচার ভিশন: স্ট্র্যাটেজি ফর সাসটেইনেবেবল সাকসেশন"-এ।অনুষ্ঠানে দেশের শীর্ষস্থানীয় পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রথম, দ্বিতীয়, ও তৃতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারে অস্পষ্ট উত্তরাধিকার পরিকল্পনা, দুর্বল করপোরেট গভর্ন্যান্স ও পারিবারিক দ্বন্দ্বকে ব্যবসার স্থায়িত্বের প্রধান হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা।

পরিকল্পনার 'উদ্বেগজনক' ঘাটতি
পরিস্থিতি গুরুতর। প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারস (পিডব্লিউসি)-এর এক সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশের ৯১ শতাংশ পারিবারিক ব্যবসা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছে—যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ আছে খুব কম প্রতিষ্ঠানের। উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনার এই বিশাল ফারাককে বিশেষজ্ঞরা "উদ্বেগজনক" হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
পিডব্লিউসির ২০১৯ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাত্র ৩১ শতাংশ পারিবারিক ব্যবসার একটি অনানুষ্ঠানিক উত্তরাধিকার পরিকল্পনা আছে। কিন্তু জরিপের আওতায় আসা একটি প্রতিষ্ঠানও মজবুত, আনুষ্ঠানিক ও যোগাযোগকৃত পরিকল্পনা তৈরি করেনি—সে তুলনায় এমন প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক গড় ১৫ শতাংশ।
সেমিনারে রাজাহ অ্যান্ড ত্যান সিঙ্গাপুর– নামের সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা তাদের উপস্থাপনায় পারিবারিক ব্যবসা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যাওয়ার পর সফল কীভাবে হতে পারে, তার কৌশল তুলে ধরে।
তাদের মূল পরামর্শ ছিল পারিবারিক ব্যবসাকে করপোরেট কাঠামোয় রূপান্তর করা, টেকসই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, পরিবারভিত্তিক গভর্ন্যান্স কাঠামো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া এবং পরিবার ও ব্যবসার কার্যক্রম আলাদা রাখা।

কেন কাঠামোবদ্ধ উত্তরাধিকার জরুরি
দেশের যেসব পারিবারিক ব্যবসার কয়েক প্রজন্ম ধরে সফলতার সঙ্গে টিকে আছে, এমন বিরল কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক নেতৃত্বও ছিলেন। তারা জানান, পেশাদারিত্ব ও সুস্পষ্ট গভর্ন্যান্সই তাদের টিকে থাকার মূল চাবিকাঠি।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বলেন, তার বাবা স্যামসন এইচ চৌধুরীr প্রতিষ্ঠিত স্কয়ার গ্রুপ প্রজন্মান্তরে সফলভাবে ও সুনামের সাথে পরিচালিত হচ্ছে—পেশাদারিত্ব ও করপোরেট সংস্কৃতির কারণেই। তিনি বলেন, "আজ আমরা গর্ব করে বলতে পারি যে আমাদের করপোরেশন সত্যিই পেশাদারদের দ্বারা পরিচালিত। আমরা একটা টিম হিসেবে কাজ করি এবং যেখানে সবার অবদানকে স্বীকার করা হয়।"
তিনি আরও বলেন, "আমার ছেলে-মেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডার হতে পারে বা কোম্পানির সুবিধা ভোগ করতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তারা ব্যবসা পরিচালনার সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা বা শিক্ষায় প্রস্তুত।"
এমএম ইস্পাহানী লিমিটেডের চেয়ারম্যান মির্জা সালমান ইস্পাহানী জানান, কীভাবে তার পূর্বপুরুষরা ইরান থেকে মুম্বাই ও কলকাতা হয়ে বাংলাদেশে এসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেন। আজও গ্রুপটি চা, কৃষি, খাদ্য ও টেক্সটাইলসহ নানা খাতে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে।
তিনি বলেন, "পরবর্তী প্রজন্মকে জানতে হবে সামেন কী আসছে, আর কী আসছে না। পরিবারের সবাই সমান নয়। সবাই ভাবে তাদের সন্তান সেরা বা সবচেয়ে মেধাবী, কিন্তু তা সব সময় সত্য নয়। তাই তারা তাদের অংশ বা ডিভিডেন্ড পায়, কিন্তু ব্যবসার নেতৃত্ব দেওয়া ভিন্ন বিষয়।"
তিনি যোগ করেন, "আপনি যদি সাকসেশসন প্ল্যান (উত্তরাধিকার পরিকল্পনা) করতে ব্যর্থ হন, তবে মূলত ব্যর্থতার দিকেই এগোচ্ছেন। সঠিকভাবে পরিকল্পনা করতেই হবে। গভর্ন্যান্সের মানে হলো—যখন শেয়ার থাকে, তখন একক মালিকানা বা অংশীদারিত্ব করপোরেশনে রূপ নেয় এবং শেয়ার স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ডাউলিউটেড হয়ে যায়।"

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন এমসিসিআই প্রেসিডেন্ট কামরান টি রহমান। তিনি বলেন, "উত্তরাধিকার পরিকল্পনা প্রায়ই পিছিয়ে দেওয়া বা স্থগিত রাখা হয়, কখনও এড়িয়ে যাওয়া হয়, আবার অনেক সময় ভুলভাবে বোঝা হয়। স্পষ্ট কৌশল না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে অনেক ব্যবসা ভেঙে পড়ে, খণ্ডিত হয় বা বিলীন হয়ে যায়— যেটি গড়ে উঠতে কয়েক দশক লেগেছিল।"
তিনি বলেন, কাঠামোবদ্ধ পরিকল্পনা পরিবারের মূল্যবোধকে ব্যবসার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে মেলাতে, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে এবং গভর্ন্যান্স ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এতে বিনিয়োগকারীর আস্থা, কর্মীদের স্থিতিশীলতা ও স্টেকহোল্ডারদের কাছে স্পষ্টতা আসে।
এক সময়ের শক্তিশালী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেভাবে পারিবারিক দ্বন্দ্বে দুর্বল হয়
পরিকল্পনাহীনতা বা দুর্বল পরিকল্পনার ক্ষতিকর দিকও আলোচনায় উঠে আসে। মঙ্গলবারের আলোচনায় অংশ নিয়ে রহিমআফরোজ বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ফিরোজ রহিম জানান, তাদের একটি পারিবারিক কনস্টিটিউশন ও কাউন্সিল রয়েছে ব্যবসা পরিচালনার জন্য। তিনি জানান, তারা কিছু বিষয় এখনো মোকাবিলা করছেন এবং সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় পারিবারিকভাবে গড়ে ওঠা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ডিবিএল গ্রুপ -এর ভাইস চেয়ারম্যান এম এ রহিম ফিরোজ।
সেমিনার শেষে টিবিএসকে তিনি বলেন, "সারা পৃথিবীতে বড় বড় ব্যবসাগুলোর ৮০ শতাংশের এর বেশি ওন বাই ফ্যামিলি। ইন্ডিয়া, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনোশিয়ার মত দেশে থার্ড, ফোর্থ জেনারেশন পর্যন্ত ব্যবসা সফলভাবে চালাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে হাতে গোনা দুই একটা ফ্যামিলি ছাড়া তা খুব একটা সাসটেইন করছে না।"
তিনি বলেন, "এর মূল কারণ সঠিক দিকনির্দেশনা ও পারিবারিক করপোরেট গভর্ন্যান্সের অভাব"– উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি দেশ যেমন সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হয়, একইভাবে পারিবারিক ব্যবসা উত্তরাধিকারীদের কাছে যাওয়ার পর কীভাবে চলবে, তার জন্যও কনস্টিটিউশন প্রয়োজন। "এই প্র্যাকটিস অন্যান্য দেশে থাকলেও আমাদের দেশে এর অভাব রয়েছে।"
এ ধরনের কনস্টিটিউশন সঠিকভাবে বাংলাদেশে এখনো ড্রাফট করতে না পারার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, "আইনজীবীকে দিয়ে ড্রাফট করতে গেলে তারা হয়তো গুগল থেকে ইউএসএ'র সাকসেসফুল প্র্যাকটিস এর ড্রাফট কপি করে দেবে। কিন্তু ইউরোপ বা আমেরিকার কালচার আর বাংলাদেশের কালচার তো এক না।"
তিনি জোর দিয়ে বলেন, এমন একটি সংবিধান প্রণয়নে ব্যর্থতাই অধিকাংশ পারিবারিক ব্যবসায় দ্বন্দ্বের মূল কারণ। তবে তার বিশ্বাস, যদি বাংলাদেশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের পারিবারিক ব্যবসাগুলো সাফল্য পেতে শুরু করে, তবে ধীরে ধীরে এই প্রবণতাও বদলাবে।
ভবিষ্যতে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ এড়াতে ডিবিএল গ্রুপ ইতোমধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) ফ্যামিলি বিজনেস গভর্ন্যান্স থেকে দিকনির্দেশনা নিচ্ছে বলেও জানান রহিম ফিরোজ।
আইএফসি ফ্যামিলি বিজনেস গভর্ন্যান্স হলো একটি সমষ্টিবদ্ধ নীতিমালা, টুলস ও অনুশীলন, যা পারিবারিক মালিকানাধীন ব্যবসায়ের গভর্ন্যান্স, টেকসই উন্নয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে প্রণীত।
দেশের অল্প সংখ্যক পারিবারিক ব্যবসার রয়েছে উত্তরাধিকার পরিকল্পনা: পিডব্লিউসির গবেষণা
পিডব্লিউসি -এর প্রথম বাংলাদেশ ফ্যামিলি বিজনেস সার্ভে ২০১৯ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাত্র ৩১ শতাংশ পারিবারিক ব্যবসার অনানুষ্ঠানিক পরিকল্পনা আছে—যেখানে বৈশ্বিক গড় ৩৪ শতাংশ। একটি প্রতিষ্ঠানও আনুষ্ঠানিক ও যোগাযোগকৃত পরিকল্পনা করেনি, বৈশ্বিক গড় যেখানে ১৫ শতাংশ।
জরিপের আওতাভুক্ত ৪৪ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জানায়, তাদের কোনো পরিকল্পনাই নেই, যা বৈশ্বিক গড়ের সমান। আরও ২৫ শতাংশ জানে না এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না। এই শূন্যতা পরিবারের ভেতরে আলাপ-আলোচনার গুরুত্বকেও তুলে ধরে।
"ফ্যামিলি, লিগ্যাসি অ্যান্ড ইউ: পার্সপেক্টিভস অন সাকসেশন প্ল্যানিং এন্ড বিজনেস কনটিনিউয়েটি" শীর্ষক আরেক প্রতিবেদনে পিডব্লিউসি তুলে ধরে কেন পারিবারিক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে পারিবারিক ঐতিহ্য ও ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে নথিভুক্ত ও আনুষ্ঠানিক উত্তরাধিকার পরিকল্পনা থাকা জরুরি।
অধিকাংশ বাংলাদেশি পারিবারিক ব্যবসা দ্বিতীয় প্রজন্মেই সীমাবদ্ধ। উত্তরাধিকার পরিকল্পনা এখনো অবহেলিত—যা ব্যবসার ধারাবাহিকতাকে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে ফেলছে।
তাদের জরিপ বলছে, প্রতিষ্ঠিত ১০০ ব্যবসার মধ্যে ৬০টি দ্বিতীয় প্রজন্মে, ৩২টি তৃতীয় প্রজন্মে, আর মাত্র ১৬টি চতুর্থ প্রজন্ম পর্যন্ত টিকে থাকে। অর্থাৎ, ব্যবসার উত্তরাধিকার পরিকল্পনা এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় অপরিহার্য।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি পারিবারিক ব্যবসাগুলো দ্বিতীয় প্রজন্ম পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। উত্তরাধিকার পরিকল্পনা এখনো অবহেলিত—যা ব্যবসার ধারাবাহিকতাকে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে ফেলছে বলে উল্লেখ করেছে পিডব্লিউসি।