মুখ অনেক, কম খাবার: জনসংখ্যা ভয় আর অর্থনীতির গোপন গণিত
'এসে অন দ্য প্রিন্সিপাল অব পপুলেশন'
চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত গল্প 'আ ক্রিসমাস ক্যারল'-এ আমরা যে মানুষটির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হই, তিনি কৃপণতার এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি। এবেনিজার স্ক্রুজ তার নাম। সে নামটি শুনলেই বাতাস যেন শীতল হয়ে ওঠে। রাগী, শুষ্ক, ঠান্ডা হৃদয়ের, আর পৃথিবীর কোনো আনন্দ তাকে ছুঁয়ে যায় না।
বড়দিনের আগের রাতে সবাই যখন আলো জ্বালিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে উঠছে, তখন স্ক্রুজ বসে আছে তার অন্ধকার, ঠান্ডা, কৃপণতায় মোড়া অফিসে। সে পুরোনো তামার মুদ্রা গুনছে। পাশাপাশি তার গরিব কর্মীকে চলে যাওয়ার ইশারা করছে। মানুষটি শুধু বড়দিনের একটি দিন পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চায়। কিন্তু স্ক্রুজের কাছে তার আবেদন-নিবেদকে সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দের মতো মনে হচ্ছে। স্ক্রজ ভাবছে, মানুষ উৎসব করবে কেন? তার বদলে কাজ করলে ক্ষতি কী!
ঠিক তখনই দরজা খুলে দুজন ভদ্রলোক ভেতরে ঢোকেন। হাতে তালিকা, মুখে বিনয়। তারা এসেছেন গরিবদের জন্য সামান্য কিছু দান চাইতে। যাতে বড়দিনে অন্তত খানিকটা উষ্ণতা পৌঁছে দেওয়া যায় গরিব-দুঃখীদের। কিন্তু স্ক্রুজ তাদের দিকে তাকায় এমনভাবে যেন তারা তার ধনরত্ন লুট করতে এসেছে। বিরক্তির ভাঁজে কুঁচকে ওঠে তার মুখ, আর হুমকির সুরে হাত নাড়তে নাড়তে সে দুজনকে ধমক দিয়ে বাইরে বের করে দেয় স্ক্রজ।
দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে যখন দুই ভদ্রলোক হতাশ চোখে চলে যাবেন ভাবছেন, তখনই স্ক্রুজ ছুড়ে দেয় তার সবচেয়ে বিষাক্ত বাক্যটি। নিষ্ঠুর, শীতল গলায় সে বলে, যদি তারা মরতেই চায়, তবে মরুক না কেন। তাতে অন্তত বাড়তি জনসংখ্যা একটু কমবে। কোনো মানুষের হৃদয় কতটা বরফে জমাট বাঁধলে এমন কথা মুখে আসতে পারে?
ডিকেন্স এমনভাবে দৃশ্যটি এঁকেছেন যেন পাঠক শুধু পড়েন না, অনুভব করেন স্ক্রুজের হিমশীতল নিষ্ঠুরতা। আজও সেই কথাগুলো কাঁটার মতো বিঁধে থাকে পাঠকের মনে। কিন্তু ডিকেন্সের সেই দৃশ্য শুধু গল্পের নির্মমতা নয়, এটি আমাদের ইতিহাসের গভীর এক ভয়কেও প্রতিফলিত করে। কারণ, পৃথিবীর ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই মানুষের মনে জন্ম নিয়েছিল আরেকটি প্রশ্ন–অসংখ্য মুখ, সীমিত খাবার।
ভোরের আলো তখনো দিগন্তে উঠতে শুরু করেনি। পৃথিবীর বুকে জমে আছে শীতের নিস্তব্ধতা। যেন প্রকৃতি নিজেই শ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে মানুষের বহুদিনের ভুলে যাওয়া এক সত্য বলার জন্য। সেই নীরবতার ভেতর লুকিয়ে আছে এক ভয়–মানুষ যত বাড়ছে, খাবার কি সেই হারে বাড়ছে? পৃথিবীর টেবিল কি এত মুখ সামলাতে পারবে? মাটির পেট কি অসীম? প্রকৃতি কি এত উদার যে মানুষের সব দাবি মেনে নেবে?
এই প্রশ্নগুলো কোনো আধুনিক সমস্যার জন্ম নয়, সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই মানুষের পেছনে চুপিসারে হেঁটে চলেছে এই অস্থিরতা। যেন ইতিহাসের করিডরে মলিন বাতাসের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটাই উদ্বেগ, মানুষ বাড়ে, খাবার বাড়ে না। স্ক্রুজের নিষ্ঠুর কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা সেই ভয়ই পরবর্তী সময়ে ম্যালথাসের তত্ত্ব হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার আগেই ডিকেন্স আমাদের মনে করিয়ে দেন, যখন সমাজব্যবস্থার ভেতর করুণা শুকিয়ে যায়, যখন মানুষ সংখ্যাকে জীবনের চেয়ে বড় করে দেখে, তখন মানবসভ্যতা অন্ধকারেই হারিয়ে যেতে শুরু করে।
অর্থনীতির ইতিহাসে প্রথম যিনি এই প্রশ্নটিকে জোরে উচ্চারণ করলেন, তিনি টমাস রবার্ট ম্যালথাস (১৭৬৬-১৮৩৪)। ব্রিটিশ বেনিয়া সংস্থা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরিচালিত ইস্ট ইন্ডিয়া কলেজে প্রথম অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান পাদরি ম্যালথাস। তিনি ছিলেন এক শান্ত, বিনয়ী, সাধারণ জীবনযাপনকারী ইংরেজ গ্রামীণ চার্চের পুরোহিত। কিন্তু তার মস্তিষ্ক ছিল তীক্ষ্ম গণিতজ্ঞের মতো। তিনি মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, মানুষ শুধু জন্ম নিচ্ছে, আরও জন্ম নিচ্ছে, শস্যক্ষেত্রগুলো ছোট হয়ে যাচ্ছে।
জমি একই থাকছে, কিন্তু মানুষের চাহিদা বাড়ছে। শিল্পবিপ্লবের শব্দ পথঘাট কাঁপিয়ে তুলছে, শহরের বাড়িঘরগুলো ভরে উঠছে নতুন নতুন শ্রমিকে। রাস্তাগুলো জনতার ঢল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আর এই সমস্ত কিছু দেখে ম্যালথাসের মনে উঠল এক ভয়, এই পথে যদি মানবজাতি এগোয়, তাহলে একদিন খাবার কম হবে, অভাব বাড়বে, আর মানুষ প্রকৃতির কাছে হেরে যাবে।
তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ 'এসে অন দ্য প্রিন্সিপাল অব পপুলেশন'-এ লিখলেন মানুষের জনসংখ্যা বাড়ে দুই, চার, আট, ষোল–এভাবে ঘাতগতিতে। কিন্তু খাবার বাড়ে এক, দুই, তিন, চার–সোজা সোজা। এ যেন এক দৌড় প্রতিযোগিতা, যেখানে একজন দৌড়াবে বাতাসের মতো, আর আরেকজন হাঁটবে ধীরগতিতে।
কে জিতবে, তা জানার জন্য কোনো দার্শনিক হওয়ার দরকার নেই। এই দুই বৃদ্ধির রেখার ব্যবধানই ম্যালথাসের চোখে ছিল সভ্যতার ভবিষ্যৎ বিপদের মূল। ডিকেন্সের কাহিনি লেখার ঠিক আগেভাগেই, মালথাস এমন এক অর্থনৈতিক মতবাদ প্রকাশ করেছিলেন, যার জন্য মানুষ তাকে অর্থনীতির স্ক্রুজ, অর্থাৎ একেবারে কৃপণ, নির্দয় তত্ত্বের ফেরিওয়ালা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিল।
আগের অর্থনীতিবিদেরা ম্যালথাসের মতো নেতিবাচক ছিলেন না। বাণিজ্যবাদীদের যুগ শেষ হতেই ইতিহাসের মঞ্চে উঠে এল একদল স্বপ্নবাজ, শার্ল ফুরিয়ে, রবার্ট ওউন, আর আঁরি দ্য সাঁ-সিমোঁ। তারা ছিলেন সেই সব চিন্তাবিদ, যাদের মানুষ নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য জন্মায় না, মানুষ দুঃখ-বেদনা পেতে বাধ্য নয়। সমাজও পাষাণ নয়। একে বদলানো যায়। উন্নত করা যায়। করা যায় আরও সুন্দর। এই স্বপ্নবাজদের সবচেয়ে বড় বিশ্বাস ছিল, মানুষ এক পথেই আটকে থাকে না, সে এগোয়, সে শেখে, আর সভ্যতা ক্রমাগত এগিয়ে চলে। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করতেন, মানুষের ভবিষ্যৎ অন্ধকার নয়; মানবজাতির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো অগ্রগতির ওপর বিশ্বাস।
কিন্তু ম্যালথাসের যুক্তি ছিল গণিতের মতো পরিষ্কার। পৃথিবীর সম্পদ সীমিত। জমির পরিমাণ সীমিত। খাবার উৎপাদনের ক্ষমতা সীমিত। কিন্তু মানুষের চাহিদা? সীমাহীন। মানুষের জন্ম? থামে না। জনসংখ্যার ফোয়ারা এমনভাবে ছুটে বেরোয় যে প্রকৃতির সামনে মানুষের দাবি একসময় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
ম্যালথাস এই বোঝাকে বললেন পুপলেশন ট্রাপ বা জনসংখ্যার ফাঁদ। তিনি ঠিক যেন ভবিষ্যতের ভয়াবহতার দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন, বড় বড় শহর, অভাবগ্রস্ত পরিবার, শিশুদের ক্ষুধার্ত চোখ, কাজের চাপে থরথর কম্পনরত শ্রমিক বাহিনীর কাহিনি। ইংল্যান্ডের গ্রামগঞ্জ তখন সত্যিই এমন কঠিন দিন ছিল। অভাব, অসুখ-বিসুখ, ক্ষুধা, ভিড়, দুর্দশা ছিল নিত্যসঙ্গী। মানুষ বাড়ছে, কিন্তু তাদের কাছে খাবার পৌঁছাচ্ছে না; কারণ, উৎপাদিত খাবার জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না।
ম্যালথাস বললেন, যদি মানুষ নিজে আগলে না রাখে, প্রকৃতি নিজে ব্যবস্থা নেবে। প্রকৃতি মানুষের মতো কোমল নয়। প্রকৃতির নিয়ম কঠোর, শীতের কামড়ের মতো নির্মম। প্রকৃতি ভারসাম্য চায়, আর সেই ভারসাম্য আনতে হলে দুর্ভিক্ষ আসবে। বিশ্বমারি আসবে। যুদ্ধ লাগবে। মৃত্যু আসবে। এটাকে তিনি বললেন, প্রকৃতির কঠোর নিয়ন্ত্রণ বা পজিটিভ চেকসের কথা; যা নিমর্মতার মধ্য দিয়ে জনসংখ্যা কমায়।
তবে তিনি আরও এক কথা বললেন, মানুষ যদি বুদ্ধিমান হয়, তবে এই বিপদ এড়ানো সম্ভব। যদি মানুষ জন্মহার কমায়, কম বয়সে বিয়ে না করে, নিজের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে, নাগরিক দায়িত্ব গ্রহণ করে, তবে প্রকৃতির নির্মম হাত নামার আগেই মানুষ নিজেই ভারসাম্য রাখতে পারে। এটাকে তিনি বললেন preventive বা স্বেচ্ছায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ।
জীবন মানেই অভাব। অভাবের মুখোমুখি হয়ে মানুষকে সতর্ক হতে হবে। পৃথিবী কখনো অসীম নয়।
ম্যালথাসের বই ছাপা হওয়ার পরেই ইউরোপ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। কেউ কেউ বলল, এ মানুষ সভ্যতার শত্রু, সে মানুষের অগ্রগতিতে বিশ্বাস করে না। কেউ কেউ বলল, না, সে সত্য বলেছে; ভবিষ্যতের বিপদের বার্তা সামনে এনে দিয়েছে। সেই সময়ে অনেক দার্শনিক আশাবাদের আলো ছড়াচ্ছিলেন। তাদের বিশ্বাস, মানুষ প্রযুক্তির মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে, পৃথিবী একসময় হয়ে উঠবে স্বপ্নের মতো। কিন্তু ম্যালথাস তাদের আশার বুকে এক ছুরি চালিয়ে দিলেন।
তার বলার ধরন ছিল এমন নাটকীয় যেন তিনি পৃথিবীর ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলছেন, জীবন মানেই অভাব। অভাবের মুখোমুখি হয়ে মানুষকে সতর্ক হতে হবে। পৃথিবী কখনো অসীম নয়।
এই কথা শুনে অনেকেই ক্ষিপ্ত হলো। কারণ, মানুষ সব সময় আশার গল্প শুনতে চায়। কিন্তু সত্যের গল্প শোনা কঠিন। ম্যালথাসের গল্প সত্যের গল্প। তিনি জানতেন, মানুষ সংখ্যা বাড়াতে ভালোবাসে। পরিবার বড় হলে আনন্দ বাড়ে। কিন্তু জনসংখ্যা যখন সমাজের ওপর চাপ ফেলে, তখন সেই আনন্দ ভয় হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু মানুষের ইতিহাস কখনোই একটি মাত্র রেখা ধরে চলার নয়। যখন কেউ বলে, মানুষ খাদ্যের জন্য ভবিষ্যতে একে অপরকে ছিঁড়ে ফেলবে, তখনই কোনো মানুষ হয়তো নতুন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করে, কেউ জমি উৎপাদন বাড়ায়, কেউ সেচ নিয়ে পরীক্ষা করে। মানুষের আচরণ বোঝা যত কঠিন, তার উদ্ভাবনক্ষমতা বোঝাও ততটাই কঠিন। ম্যালথাস এই দ্বিতীয় দিকটি খুব একটা দেখেননি। মানুষ শুধু মুখ নয়, সে হাত, সে মস্তিষ্ক, সে সৃজনশীলতা।
কিন্তু ম্যালথাস ভুল করে ছিলেন, এ কথা তখন বলা যায়নি। কারণ, তার জীবদ্দশায়ই দেখা গেল কত পরিবার দারিদ্র্যে ডুবে যাচ্ছে, কত শিশু ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে, কত শ্রমিক শহরে এসে ঠাঁই পাচ্ছে না, খাদ্যমূল্য বাড়ছে, গড় আয়ু কম। এই সব দেখে মনে হচ্ছিল, ম্যালথাসের আঁকা ভবিষ্যৎ ধীরে ধীরে সত্যিতে পরিণত হচ্ছে।
এই ভয় ছড়িয়ে পড়ল সবচেয়ে বেশি শিল্পবিপ্লবে। কারখানার চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠছে, জনতার ঢল বাড়ছে, শহরের বুকে দারিদ্র্য ছড়িয়ে যাচ্ছে, খাদ্যের অভাব বাড়ছে। শহর আর গ্রাম দুদিক থেকেই যেন একটি সতর্ক সংকেত পাওয়া যাচ্ছিল। মানুষ বাড়ছে, কিন্তু খাবারও কি সেইভাবে বাড়ছে? এমন দুঃসময়ে ম্যালথাসের ধারণা হয়ে উঠল যেন মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ানো একটি সতর্কবার্তা।
তবে ইতিহাসের নিয়মই হলো, চূড়ান্ত ভয়ের সময়ই কোনো অদৃশ্য পথ খুলে যায়। একই সময়ে অন্য চিন্তাবিদ ও কৃষিবিজ্ঞানীরা এগিয়ে আসলেন। তারা বললেন, মানুষ শুধু খাবার খায় না, মানুষ খাবার বানায়ও।
বিজ্ঞানকে কাজে লাগালে খাদ্য অনেক বেশি পাওয়া সম্ভব। কৃষিজমি হয়তো বাড়ানো যাচ্ছে না; কিন্তু সেই জমির উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে কয়েক গুণ।
এই বিপরীত ধারণা শুরু হলো ঊনবিংশ শতকের শুরুতে, আমরা দেখব কীভাবে বিজ্ঞান, উদ্ভাবন, প্রযুক্তি আর মানুষের চেষ্টা ধীরে ধীরে ম্যালথাসের আঁকা অন্ধকার ভবিষ্যতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নতুন পথ খুলে দিল।
ম্যালথাসের সময়েই ইউরোপজুড়ে শুরু হয়েছিল শিল্পবিপ্লব। ইংল্যান্ডের কারখানাগুলোতে তখন বাষ্প ইঞ্জিনের গর্জন চিমনির ধোঁয়া আর অবিরাম চলমান মেশিনের শব্দ। মানুষ নতুন ধরনের শক্তি আবিষ্কার করেছে প্রাকৃতিক সীমার বাইরে গিয়ে কাজ করার ক্ষমতা তার হাতে এসেছে। এসেছে নতুন যন্ত্র নতুন চিন্তা নতুন কৌশল। ম্যালথাস বললেন, মানুষ বাড়ছে, খাদ্য বাড়বে না; কিন্তু তার চোখের সামনেই কৃষক আর বিজ্ঞানী মিলে চেষ্টা শুরু করলেন কীভাবে কম জমিতে বেশি ফসল ফলানো যায়।
এখানেই প্রবেশ করল আরেকটি শক্তি, প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। বিজ্ঞানকে কাজে লাগালে খাদ্য অনেক বেশি পাওয়া সম্ভব। কৃষিজমি হয়তো বাড়ানো যাচ্ছে না; কিন্তু সেই জমির উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে কয়েক গুণ।
এই সব পরিবর্তনের শুরুটা অষ্টাদশ শতকের শেষ আর ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে ঠিকই কিন্তু একই সঙ্গে খাদ্য উৎপাদনও আগের তুলনায় দ্রুত বাড়তে থাকে। নতুন রাস্তা রেললাইন বন্দর গড়ে ওঠায় দূরদেশ থেকেও খাদ্য আনা সম্ভব হয়। যেখানে বেশি উৎপাদন সম্ভব নয়, সেখানে অন্য অঞ্চল থেকে খাবার পৌঁছে যায়। পুরোনো গ্রামের আত্মনির্ভর ব্যবস্থা বদলে গিয়ে তৈরি হয় বড় বড় বাজার আর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য।
অর্থনীতির ভাষায় বলতে গেলে ম্যালথাস শুধু চাহিদা দেখেছিলেন। সরবরাহের গতিশীল চরিত্রটি পুরোপুরি ধরতে পারেননি। তবে এটাও সত্য যে ঊনবিংশ শতকজুড়ে পৃথিবী ম্যালথাসের ভবিষ্যদ্বাণীর কিছু ছায়া দেখেছে। নানা দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে। আইরিশ আলু দুর্ভিক্ষ এর একটি ভয়ংকর উদাহরণ, সেখানে আলুর রোগ এবং খারাপ নীতি মিলিয়ে লাখ লাখ মানুষ ক্ষুধায় কিংবা অভিবাসনের ধাক্কায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। তাই ম্যালথাস পুরোপুরি ভুল ছিলেন বলা যায় না। তিনি মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন অভাব ও সীমাবদ্ধতার সত্যিটা।
কিন্তু সময় এগোতে লাগল জনসংখ্যাও বাড়তেই থাকল, তবু প্রত্যাশিত সেই চূড়ান্ত বিপর্যয় দেখা দিল না। উল্টা দেখা গেল বিশ্বের অনেক দেশে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। শিশুমৃত্যু কমছে। স্বাস্থ্যসেবা উন্নত হচ্ছে। খাদ্যের পরিমাণও ধীরে ধীরে বাড়ছে। অবশ্য সব দেশে নয়। ধনী দেশে বেশি, গরিব দেশে কম। কিন্তু সেই ক্ষুধার পৃথিবী, 'পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটির' মতো অন্ধকার, যেখানে সবাই অনাহারে মারা যাবে সে রকম বাস্তবতা দেখা গেল না।
এখানেই গল্পে আরেকটি মোড় এল। অর্থনীতিবিদেরা বুঝতে পারলেন, শুধু খাদ্যের পরিমাণ আর মানুষের সংখ্যা দিয়ে সব বোঝা যায় না। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রযুক্তি শিক্ষা স্বাস্থ্যনীতি এবং সবচেয়ে বড় কথা মানুষের আচরণ। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকে মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করল, সন্তান সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করলে শুধু ব্যক্তিগত পরিবারেই নয়, পুরো সমাজেই চাপ তৈরি হয়। শহরে বাড়িঘরের অভাব। চাকরির প্রতিযোগিতা, সম্পদের ওপর চাপ সব মিলিয়ে এটি এক জটিল সমস্যার মুখে পড়তে হয়।
অনেক দেশে তাই জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হলো। কেউ কেউ প্রথাগতভাবে দেরিতে বিয়ে করতে লাগল। কেউ কেউ নিজের ইচ্ছায় কম সন্তান নিল। কেউ আবার ধর্ম আর সংস্কৃতির সীমার মধ্যেই থেকে স্বেচ্ছায় নিজেদের জীবন পরিকল্পনা বদলাল। ম্যালথাস যার নাম দিয়েছিলেন প্রিভেনটিভ চেকস, মানুষ স্বেচ্ছায় তা মেনে নিতে শুরু করল। কারণ, তারা উপলব্ধি করল বেশি সন্তান মানে বেশি আনন্দ নয়, বরং অনেক সময় বেশি দুঃশ্চিন্তাও।
অর্থনীতির বইতে এই সময়কে বলা হয় ম্যালথাসের ছায়া থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার সময়। একদিকে আছে তার সতর্কবার্তা। অন্যদিকে আছে মানুষের উদ্ভাবন আর পরিকল্পনা–এই দুইয়ের টানাপোড়েনে তৈরি হচ্ছে নতুন বাস্তবতা। কেউ কেউ বলতে লাগল ম্যালথাস ভুল প্রমাণিত হয়েছেন; কারণ, পৃথিবী এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ধারণ করেও কখনো কখনো আগের চেয়ে বেশি খাবারেরও জোগান দিচ্ছে।
কিন্তু কেউ কেউ মনে করলেন, ম্যালথাসের কথা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তিনি যে মূল কথা বলেছিলেন, পৃথিবীর সীমা আছে, সেই সীমাবোধটুকু এখনো প্রযোজ্য। শুধু খাবারের প্রসঙ্গে নয়, পানিব্যবস্থা, জ্বালানি, বনজ সম্পদ পরিবেশ সব ক্ষেত্রেই মানুষের ভোগ বেড়েছে, তাই নতুন করে প্রশ্ন উঠতে লাগল, মানুষ কি আবার নতুন কোনো ম্যালথাসীয় ফাঁদের দিকে হাঁটছে?
মানুষ কেবল ভোক্তা নয়, সে স্রষ্টা এবং সমাধান অনুসন্ধানকারীও।
ম্যালথাস যখন লিখছিলেন, তখন তার সামনে কোনো গ্রাফ বা বিশাল ডেটাবেইস ছিল না। তিনি দেখছিলেন নিজের দেশের গ্রাম আর শহরের অবস্থা কিছু সরকারি পরিসংখ্যান আর নিজস্ব পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি তৈরি করেছিলেন তার যুক্তি। আজকের অর্থনীতিবিদদের সামনে আছে সারা বিশ্বের জনসংখ্যা এবং খাদ্য উৎপাদনের দীর্ঘ হিসাব-নিকাশ। তারা দেখতে পায়, ১৮০০ সালের পর থেকে জনসংখ্যা এমন গতিতে বেড়েছে, যা ম্যালথাসও হয়তো কল্পনা করেননি। কিন্তু একই সঙ্গে দেখা যায়, প্রতি মাথাপিছু খাদ্য উৎপাদনও অনেক দেশে দ্বিগুণ তিন গুণ হয়েছে।
এই বৈপরীত্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারা বলেন, ম্যালথাস একটি ধারা ঠিক ধরেছিলেন। তবে দ্বিতীয় ধারাটি অর্থাৎ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তির শক্তি পুরোপুরি বোঝেননি। তার সময়ে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব তখনো পুরোপুরি স্পষ্ট হয়নি। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা তখনো শিশু বয়সে। তাই তিনি মানুষকে অনেকটা অসহায় কল্পনা করেছিলেন; কিন্তু বাস্তবে মানুষ কেবল ভোক্তা নয়, সে স্রষ্টা এবং সমাধান অনুসন্ধানকারীও।
তবু গল্পের একদম শেষে এসে তাকে সহজে বিদায় জানানো যায় না। কারণ, ম্যালথাস আমাদের মনে গেঁথে দিয়ে গেছেন প্রয়োজন আর সীমার সম্পর্কটি যে পৃথিবী অসীম নয়, মানুষের ইচ্ছাও অসীম হওয়া উচিত নয়, এই বোধ আধুনিক পরিবেশচিন্তার ভিতের মতো কাজ করেছে।
ম্যালথাসের সতর্কবাণীকে অনেকেই পুরোনো ভয় বলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পৃথিবী যেন তার কথাকে ভুল প্রমাণ করার জন্যই চেষ্টা করেছে কৃষিতে সবুজ বিপ্লব, নতুন সার, নতুন বীজ সেচব্যবস্থার উন্নতি এসব মিলিয়ে খাদ্যের উৎপাদন এমনভাবে বেড়ে গেল যে ১৯৫০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর মোট খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি হলো। মানুষ তখন ভাবতে শুরু করল, ম্যালথাসের সময়ের পৃথিবী আর আমাদের পৃথিবী এক নয়। মানুষের মস্তিষ্ক আছে। প্রযুক্তি আছে। বিজ্ঞান আছে। তাই আমরা প্রকৃতির সীমা টপকে নতুন জগৎ তৈরি করব।
খাবারই একমাত্র সংকট নয়, সংকট পুরো পৃথিবীর সম্পদও।
কিন্তু সমস্যা হলো, পৃথিবী টপকে মানুষ নিজের ভোগকেই সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। জনসংখ্যা বাড়ছে ঠিকই; কিন্তু তার থেকেও দ্রুত বাড়ছে ভোগ ও চাহিদা। এই চাহিদা শুধু খাবারের নয়। বিদ্যুৎ-পানি-জমি-গোশত-পোশাক-বাসস্থান-পরিবহন সব মিলিয়ে মানুষের প্রতিদিনের ভোগের তালিকা এমন বড় হলো যে পৃথিবীর ওপর অসহনীয় চাপ তৈরি হলো।
ম্যালথাস বলেছিলেন, খাবার কম হবে; কিন্তু আধুনিক অর্থনীতিবিদেরা দেখলেন সমস্যাটা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। খাবারই একমাত্র সংকট নয়, সংকট পুরো পৃথিবীর সম্পদও।
বিশ শতকের শেষ দিকে পৃথিবীর জনসংখ্যা এক বিস্ময়কর পরিমাণে পৌঁছাল; ১৯০০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৬০ কোটি, ১৯৬০ সালে এটি পৌঁছায় ৩০০ কোটি; ২০০০ সালে ছুঁয়ে ফেলে ৬০০ কোটি, এখন ৮০০ কোটি অতিক্রম করেছে। এই বৃদ্ধির গতি এমন যে মনে হয় যেন পৃথিবী কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল মানুষের জন্য নতুন জায়গা। নতুন রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। নতুন জীবনরীতি।
কিন্তু যখন মানুষের সংখ্যা বাড়ল, তখন আরেকটি ঘটনা ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াল পৃথিবীর বুকে খাদ্য বাড়লেও পরিবেশের সহ্যক্ষমতা কমতে লাগল। বন কাটার হার বেড়ে গেল। নদী দূষিত হলো। মাছ কমে গেল। জমি উর্বরতা শক্তি হারাতে লাগল। জলাভূমি শুকাতে লাগল। আর যেসব দেশ শিল্পায়ন দিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে শুরু করল, তারা নদী-সমুদ্র-আকাশ সব দূষণে ভরিয়ে দিল। এ যেন ম্যালথাসের সতর্কবাণীর আধুনিক সংস্করণ। খাবার কম হবে নয়, বরং পৃথিবীই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।
এ সময়ে আবার ফিরে এল এক প্রশ্ন, মানুষ কি পৃথিবীর সীমাকে সম্মান করতে জানে? মানুষ কি জানে যে সে যত জন্মায়, তত খরচও বাড়ায়; যত খরচ বাড়ায়, তত পৃথিবী ক্ষয় হয়। এই হিসাব আধুনিক অর্থনীতিবিদদের সামনে এক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াল।
তারা বললেন, মানুষ বাড়ছে, হ্যাঁ। কিন্তু তার ভোগ আরও দ্রুত বাড়ছে একটি ধনী দেশের এক নাগরিক যা খায়, যা ব্যবহার করে, যা নষ্ট করে, তা হয়তো একটি দরিদ্র দেশের দশজন মানুষের সমান। তাই ম্যালথাসের সময়ের সমস্যা ছিল জনসংখ্যা আর খাদ্যের দূরত্ব আর আধুনিক সমস্যাটা হলো, জনসংখ্যা পরিবেশ আর সম্পদের দূরত্ব।
আধুনিক পৃথিবী বলছে, মানুষ বাড়ে বা কমে, খাবার বাড়ে বা কমে, মূল সংকট তা নয়। আসল সংকট হলো পৃথিবী নিজেই ক্লান্ত।
বিশ শতকের মাঝামাঝি এসে পৃথিবীতে শুরু হলো পরিবেশ আন্দোলন। বিজ্ঞানীরা বলতে লাগলেন, পৃথিবী একটি আবদ্ধ ব্যবস্থা। এটি অসীম সম্পদের উৎস নয়। ম্যালথাস যেখানে বলেছিলেন খাবার সীমিত। আধুনিক পরিবেশবিদেরা বললেন, পুরো গ্রহই সীমিত। যেদিন এই সীমা ভেঙে যাবে, সেদিন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে যাবে।
বিশ-একুশ শতক মানুষ দুই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে; একদিকে মানুষ অভাব থেকে বেরিয়ে এসেছে। অনেক দেশ দারিদ্র্য কমিয়েছে। শিশুমৃত্যু কমেছে। গড় আয়ু বেড়েছে। এসবই ম্যালথাসকে ভুল প্রমাণ করে। অন্যদিকে জলবায়ু সংকট, পানি সংকট, জ্বালানি সংকট, পরিবেশ ধ্বংস এসব যেন অত্যন্ত তীক্ষ্ম ভাষায় বলছে, ম্যালথাস এখনো পুরোপুরি হারেননি, তার প্রশ্ন এখনো জীবিত।
ম্যালথাস বলেছিলেন, মানুষ বাড়বে খাদ্য বাড়বে না। আধুনিক পৃথিবী বলছে, মানুষ বাড়ে বা কমে, খাবার বাড়ে বা কমে, মূল সংকট তা নয়। আসল সংকট হলো পৃথিবী নিজেই ক্লান্ত।
আজকের জনসংখ্যা আলোচনার কেন্দ্র তাই আর কেবল খাদ্য নয়, বরং টেকসই জীবনধারা। মানুষ যেন নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই না খেয়ে ফেলে পরিবেশবিদ অর্থনীতিবিদ সমাজবিজ্ঞানী সবাই এখন একসাথে বলছেন, মানুষ যদি ভোগ কমাতে না শেখে, তাহলে কেবল জনসংখ্যা কমলেই হবে না, পৃথিবীর ভবিষ্যতও সংকটে পড়ে যাবে।
