উপেন্দ্রকিশোর: বাংলার আলোকচিত্রের এক অগ্রদূত

বীরচন্দ্র দাসগুপ্ত ছিলেন বাংলা রাঢ় অঞ্চলের পূর্ব বর্ধমান জেলার এক প্রভাবশালী জমিদার। জমিদারি জীবনযাত্রা তাঁর মধ্যে যেমন কর্তৃত্ব ও প্রশাসনিক দক্ষতা তৈরি করেছিল, তেমনই তাঁকে আলোকচিত্রের প্রতি অনুরাগী এক অভিজ্ঞানী মানুষ করে তুলেছিল। বীরচন্দ্র ছিলেন এক ব্যতিক্রমী ভূস্বামী―যিনি ক্যামেরাকে শুধু একটি ইউরোপীয় কৌতূহল নয়, বরং আত্মপ্রকাশ ও নন্দনচর্চার অনবদ্য আধুনিক মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। মালবিকা কার্লেকারের রি-ভিশনিং দ্য পাস্টে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত লেখা হয়েছে।
তাঁর হাতে তোলা ছবিগুলো ছিল নিছক মুখচ্ছবি নয়, সেগুলোয় ধরা থাকত তাঁর জমিদারির ভৃত্য, কর্মচারী, আত্মীয়স্বজনের মুখচ্ছবিতে দৃশ্যমান এক সামাজিক বাস্তবতা। কখনো তা ছিল শাসকের চোখে অধীনস্তকে দেখা। আবার কখনো শিল্পপ্রেমিক দৃষ্টিতে সাজানো এক রূপক ফ্রেম, যেখানে আলো, ছায়া, সাজসজ্জা ও ভঙ্গিমার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠত এক অভিজাত সৌন্দর্যবোধ।
বীরচন্দ্রের আলোকচিত্র শুধু তাঁর নিজস্ব রুচির বহিঃপ্রকাশ ছিল না। তা হয়ে উঠেছিল এক ঐতিহাসিক দলিল, উনিশ শতকের বাংলার জমিদার সমাজ, শ্রেণিসংস্কৃতি ও দৃষ্টিভঙ্গির এক বিরল চিত্রভাষ্য।
এই সময়েই আরেক আলোচ্য চরিত্র উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। কলকাতায় ফটোমেকানিক্যাল ছাপার প্রযুক্তি নিয়ে নতুনতর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কাটিয়েছেন নিজ সময়কে। তাঁদের মধ্যে সরাসরি সাক্ষাতের কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ না থাকলেও এক বিষয়ে তাঁরা ছিলেন একই যাত্রার পথিক; আলোকচিত্রকে ছাপার যোগ্য মাধ্যম হিসেবে রূপান্তরিত করার সাধনায় মগ্ন।
এককালের ডাকসাইটে ফিল্ম ও আলোকচিত্র উপাদান নির্মাতা অধুনা প্রায় লুপ্ত কোডাকের আলোকচিত্র নিয়ে একটি বইয়ের সূচনায় বলা হয়েছে, আলোকচিত্র খুবই সহজ কাজ। এই কাজ হলো শুধু আলোকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সঠিক সময়ে শাটার রিলিজ করা। এই 'সহজ কাজ' রপ্ত করতে অনেক আলোকচিত্রীর গোটা জীবনই কেটে যায়। বীরচন্দ্র এবং উপেন্দ্রকিশোর এই সহজ কাজ অতি সহজেই আয়ত্তে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের তোলা ছবিই কালজয়ী সে সাক্ষ্য দিচ্ছে।
উনিশ শতকের শেষ দিকে এই ফটোমেকানিক্যাল প্রযুক্তির আগমন বাংলা ছাপাখানার জগতে যে আলোড়ন তোলে, তাতে বীরচন্দ্র ও উপেন্দ্রকিশোর দুজনই ছিলেন আলাদা প্রান্তে দাঁড়িয়ে এক নবযুগের সূচক। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাভূমির সন্তান উপেন্দ্রকিশোরের দক্ষতা এবং উদ্ভাবনী ধারণা ছিল অনেক বেশি অগ্রসর।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও বীরচন্দ্র দাসগুপ্ত দুজনের সাক্ষাৎ হয়েছিল কি না, তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই, কিন্তু তাঁদের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল ছিল নিশ্চিতভাবে―ছবির মধ্যে নতুন সম্ভাবনার সন্ধান। উনিশ শতকের শেষ ভাগে, আলোকচিত্র প্রযুক্তিভিত্তিক ছাপা ফটোমেকানিক্যাল পদ্ধতির আগমনে বাংলা ছাপাখানার দুনিয়ায়ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আর এই প্রযুক্তিকে আপন করে নেওয়ার প্রয়াসেই জড়িয়ে পড়েন ময়মনসিংহ জেলার উপেন্দ্রকিশোর রায়। জন্মসূত্রে যার নাম ছিল কামোদরঞ্জন। পরবর্তীকালে এই নাম বদলে গিয়ে উপেন্দ্রকিশোর।

জন্ম ১৮৬৩ সালে। নিজের পিতার নিকটাত্মীয় হরিকিশোর তাঁকে দত্তক নেন। তাঁর জৈবিক পিতা শ্যামসুন্দর মুনশি নামে পরিচিত ছিলেন। ফারসি ভাষা সেই সময়ে আদালতে বহুল ব্যবহৃত হতো। তৎকালীন রাজভাষা ফারসিতে গভীর পাণ্ডিত্য থাকার কারণে মুনশি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
হরিকিশোর ছিলেন এক বিশাল জমিদার। পরবর্তীকালে তাঁর ঘরেও জন্ম হয় এক পুত্র―নরেন্দ্রকিশোর। তবুও উপেন্দ্রকিশোরকে তিনি সন্তানের মর্যাদাতেই রাখেন।
উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে উপেন্দ্রকিশোর কলকাতায় এলেন, প্রেসিডেন্সি কলেজ হয়ে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করলেন। ১৮৮৪ সালে স্নাতক হওয়ার পর ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন। ধর্মীয় সংস্কারের এই সিদ্ধান্তে পিতা এতটাই ক্ষুব্ধ হন যে নিজের সামগ্রিক সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ মাত্র উপেন্দ্রকিশোরকে দিতে চান। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর মা সেই উইল ছিঁড়ে ফেলেন। ঘোষণা করেন, 'আমি মা হয়ে স্বামীর ইচ্ছা মানতে পারি না, এমনকি এ জন্য যদি নরকবাসও করতে হয়।' ফলে উপেন্দ্রকিশোর এবং নরেন্দ্রকিশোর দুজনেই জমিদারির সমান উত্তরাধিকারী হন।
এই সময়েই জাতপাতের বেড়াজাল ভেঙে উপেন্দ্রকিশোর বিবাহ করেন বিধুমখীকে, তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট সংস্কারক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী ও কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর পালিতা কন্যা। এ দাম্পত্য শুধু সামাজিক রীতি ভাঙে না, বরং উপেন্দ্রকিশোরের মননে আনে আরও বৈপ্লবিক উদ্যম।
জমিদারি সূত্রে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার তাঁকে দেয় শিল্প ও বিজ্ঞানে স্বাধীনভাবে কাজ করার অবকাশ। তিনি একাধারে ছবি আঁকতেন, ফটোগ্রাফি করতেন, আর নিজের খরচে বিদেশি যন্ত্রপাতি আনিয়ে ছাপাখানার প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন। কলেজজীবন থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল ছোট যন্ত্র বানানো, আলো-ছায়ার বিশ্লেষণ আর ইংরেজি ভাষায় বৈজ্ঞানিক বই পড়ে নিজে নিজে প্রয়োগ করতেন।
তিনি আবিষ্কার করেন, তামা বা দস্তায় (কপার বা জিংকে) খোদাই করে ছবি ছাপলে তা কাঠ বা ইস্পাতের তুলনায় অনেক সূক্ষ্ম হয়। এই পর্যবেক্ষণই তাঁকে নিয়ে যায় হাফ-টোন (half-tone) ছাপার পদ্ধতির দিকে। এরপর তিনি শুধু নিজেই এই পদ্ধতি আত্মস্থ করলেন না, আরও কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দিলেন।
এ উদ্দেশ্যে তাঁর পরিবার চলে এল কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ১৩ নম্বর বাড়িতে। এই বাড়িতে কাচের ছাদ দিয়ে স্টুডিও বানানো হয়। মেঘলা দিনে কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য বসানো হলো বিশাল আর্ক ল্যাম্প। তিনি 'খুব খরচ করে ও উৎসাহে' এনে ফেললেন ক্যামেরা, ছাপার প্রেস আর নানা জটিল যন্ত্রপাতি।
১৮৯৫ সালেই বিজ্ঞাপন দিলেন―'হাফ-টোন ব্লক অ্যান্ড ব্রোমাইড এনলার্জমেন্টস অব দ্য হাইয়েস্ট কোয়ালিটি'; ছবি থেকে হাফ-টোন ব্লক মাত্র এক টাকা। তার ঠিকানা: ৩৮-১ শিবনারায়ণ দাস লেন।
হাফ-টোন প্রযুক্তি তখনো পশ্চিমে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অথচ উপেন্দ্রকিশোর নিজে নিজেই এর নানান সমস্যা ও সম্ভাবনার সমাধান করতে থাকেন। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলো যেসব আবিষ্কার পরবর্তী সময়ে করল, তার অনেকটাই তিনি আগেই করে ফেলেন। ১৯০৫-০৬ সালের পেনরোজস পিক্টোরিয়াল অ্যানুয়াল―অ্যান ইলাস্ট্রেটেড রিভিউ অব গ্রাফিক আর্টসে তিনি লিখলেন, ১৮৯৭ সালেই তিনি 'three-lined dot arrangement' পদ্ধতির সমাধান করেছিলেন।
তিনি লন্ডনের মেসার্স পেনরোজ অ্যান্ড কো.-এর মাধ্যমে মি. লেভিকে বলেছিলেন একটি বিশেষ ধরনের স্ক্রিন বানাতে। কিন্তু লেভি তা বানাতে অস্বীকৃতি জানান। পরে তাঁর কাছ থেকে একটি '৬০ ডিগ্রি ক্রস-লাইন স্ক্রিন' নিতে বাধ্য হন। এরপরই খবর আসে, আর্থার শুলৎস এই পদ্ধতির প্যাটেন্ট নিয়ে ফেলেছেন।
তিনি আক্ষেপ করলেন, 'কে ক্রেডিট পেল, তাতে কারও কিছু আসে যায় না, কিন্তু আমার অবদান তো কেউ জানল না।' এই ঘটনাকে আজকের উপনিবেশোত্তর দৃষ্টিতে দেখলে জ্ঞান হরণ বলেই মনে হয়।
তবুও আবেগ নয়, যুক্তির জায়গা থেকে উপেন্দ্রকিশোর তাঁর গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৮৯৮ সাল থেকে নিয়মিত পেনরোজস পিক্টোরিয়াল অ্যানুয়ালে তাঁর লেখালিখি চলতে থাকে। ১৮৯৮ সালে 'থিয়োরি অব হাফ-টোন ডট' এবং ১৮৯৯ সালে 'হাফ-টোন থিয়োরি গ্রাফিক্যালি এক্সপ্লেইন্ড' ছিল উল্লেখযোগ্য নিবন্ধ।

১৯০৪ সালে ব্রিটিশ জার্নাল অব ফটোগ্রাফির বিশেষ সংখ্যায় উপেন্দ্রকিশোরকে নিয়ে লেখা ছাপা হয়, 'হাফ-টোনে বহু ডায়াফ্রামের ব্যবহার সম্পর্ক সঠিকভাবে যিনি বুঝতে পেরেছেন, তিনি হলেন ক্যালকাটার ইউ. রে―তাঁর বিশ্লেষণে রয়েছে গাণিতিক নির্ভুলতা।'
এ দেশে তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি দক্ষতার সঙ্গে হাফ-টোন প্রযুক্তি কাজে লাগান। স্ক্রিন, ক্যামেরা, লেন্স―সবকিছুর ফোকাসিং দূরত্ব ঠিক রাখতে গিয়ে যে সমস্যা তৈরি হতো, তাতে তিনি 'ডাবল-নরমাল' দূরত্বে স্ক্রিন বসানোর উপায় বের করেন, এটিকে বলা হয় তুরাতি ডিসট্যান্স।
জে. ভারসাফার তাঁর দ্য হাফ-টোন প্রসেসে (১৯০৪, তৃতীয় সংস্করণ) স্বীকৃতি দেন, 'স্ক্রিনের অবস্থান বোঝাতে একটি সরঞ্জাম তৈরির ধারণা দিয়েছেন মি. রে অব ক্যালকাটা, যাতে অপারেটর নিজে বুঝে সেট করতে পারেন।'
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী শুধু 'ছেলেদের রামায়ণ' বা 'সন্দেশ' পত্রিকার জন্য স্মরণীয় নন―তিনি বাংলা তথা ভারতবর্ষের আলোকচিত্র ও মুদ্রণপ্রযুক্তির ইতিহাসে এক নির্ভরযোগ্য পথিকৃৎ। তাঁর কাজের জটিলতা ও উচ্চমান আধুনিক পাঠকের চোখে বিস্ময় জাগায়, বিশেষত যদি বুঝি যে তিনি কীভাবে আধুনিক 'হাফ-টোন' প্রযুক্তিকে একা হাতে আয়ত্ত করে একে উপযোগী করেছেন নিজস্ব প্রকাশনার জন্য।
উপেন্দ্রকিশোরের এই প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনার ছয়টি দিক তুলে না ধরলে তার প্রতি অবিচার করা হবে। হাফ-টোন প্রযুক্তিতে বহু ডায়াফ্রামের ব্যবহারের শুরু। আলোকচিত্রে হাফ-টোন পদ্ধতি বলতে বোঝায় এমন একটি ছাপানোর পদ্ধতি, যেখানে দৃষ্টিনন্দন ছায়া-আলোসংবলিত ছবি তৈরি হয় অসংখ্য ছোট ছোট বিন্দুর (ডট) মাধ্যমে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় এই বিন্দুগুলোর স্বচ্ছতা ও ঘনত্ব যখন নিখুঁত হয় না। এই কারণেই প্রয়োজন পড়ে বিভিন্ন ধরনের ডায়াফ্রাম বা আলো-নিয়ন্ত্রণকারী পর্দা ব্যবহারের।
উপেন্দ্রকিশোর উপমহাদেশের প্রথম গবেষক, যিনি একাধিক ডায়াফ্রাম ব্যবহার করে হাফ-টোন আলোকচিত্রে 'ফোকাস' বা সূক্ষ্মতার সমস্যা সমাধান করেছিলেন। তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে The British Journal of Photography ১৯০৪ সালে বলেছিল, 'হাফ-টোনে বহু ডায়াফ্রামের প্রভাব বোঝার ক্ষেত্রে শুধু একজনই যথাযথভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন, তিনি হলেন ইউ. রে অব কলকাতা। তিনি একে গাণিতিক নির্ভুলতায় নিয়ে গিয়েছেন।'
এই ডায়াফ্রামগুলো ছিল আলোর পরিমাণ, রশ্মির প্রবাহ ও ফোকাস নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে হাফ-টোন স্ক্রিন ও লেন্সের মধ্যে সঠিক দূরত্ব মাপার মতো কাজ করার সময়।
তুরাতি ডিসট্যান্স (Turati-distance) নিয়ে কথা, একটি উচ্চমানের হাফ-টোন নেগেটিভ পেতে হলে স্ক্রিন ও ক্যামেরার মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হয়।
এই পদ্ধতি ইউরোপে তখনো ভালোভাবে চালুই হয়নি। উপেন্দ্রকিশোর নিজে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বের করেছিলেন যে এই দূরত্বে স্ক্রিন বসালে হাফ-টোন ছবির স্বচ্ছতা ও তীক্ষèতা বহুগুণে বেড়ে যায়। স্ক্রিনের সামনে এক বিশেষ আকারের ডায়াফ্রাম স্থাপন করে তিনি এক অভিনব সমাধান বের করেন।
'থ্রি-লাইন্ড ডট অ্যারেঞ্জমেন্ট' পদ্ধতির কথাও এসে যায় এখানে।
হাফ-টোন ডট গঠনের ক্ষেত্রে একটি নতুন কৌশল উদ্ভাবন করেন তিনি, যেটিকে বলা হয় 'থ্রি-লাইন্ড ডট অ্যারেঞ্জমেন্ট'। এতে আলোকছবির প্রতিটি বিন্দু তিনটি ভিন্ন কোণ থেকে গঠিত হয়ে ছবির আরও সূক্ষ্ম ও গভীর ছায়া-আলো সৃষ্টি করত।
এই পদ্ধতি নিয়ে ১৯০৪ সালে Penrose's Pictorial Annual পত্রিকায় জার্মান গবেষক আর্থার শুলৎস একটি প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর তখনই লিখে জানান যে তিনি এই পদ্ধতি ১৮৯৭ সালেই আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর লেখা, 'মি. শুলৎসের Three-lined ডট প্রসেস আমি ১৮৯৭ সালেই নিজের আবিষ্কার করেছি ও কাজে খাটিয়েছি।' এই দাবি নিঃসন্দেহে তাঁর প্রযুক্তিগত প্রগতি ও আন্তর্জাতিক মানে তাঁর অবস্থানকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছে।
'৬০ ডিগ্রি ক্রস-লাইন স্ক্রিন' এল কীভাবে? হাফ-টোন ছবিতে প্রতিচ্ছবিকে বিন্দুতে রূপান্তর করার জন্য স্ক্রিন প্রয়োজন হয়। এটি সাধারণত কাচ বা ধাতুর পাত হয়, যেখানে অস্বচ্ছ ও স্বচ্ছ রেখার সমাবেশ থাকে। উপেন্দ্রকিশোর চেয়েছিলেন একটি স্ক্রিন, যাতে রেখাগুলো ৬০ ডিগ্রি কোণে ছেদ করে। এই কোণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, এতে বিন্দু বা ডটগুলো সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি স্ক্রিন নির্মাতা মি. লেভিকে অনুরোধ করেন এমন একটি স্ক্রিন বানাতে, যা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু তাঁর অনুরোধ রাখা হয়নি। লেভি তাকে বাধ্য করেন একটি সীমিত ক্ষমতার ৬০ ডিগ্রি ক্রস-লাইন স্ক্রিন গ্রহণ করতে, এ সময়ে মি. শুলৎস তড়িঘড়ি পেটেন্ট করিয়ে ফেলেন।
এই ঘটনায় উপেন্দ্রকিশোর মন্তব্য করেছিলেন, 'কার খাতে কৃতিত্ব গেল, কারিগরি জগতে তা খুব বড় কথা নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি মূল্যবান পদ্ধতি যুক্ত হলো কি না।' তবুও এ ঘটনায় তাঁর মর্মবেদনা স্পষ্ট।
১৮৯৫ সালে উপেন্দ্রকিশোর কলকাতায় বিজ্ঞাপন দেন, 'হাফ-টোন ব্লক অ্যান্ড ব্রোমাইড এনলার্জমেন্টস অব দ্য হায়েস্ট কোয়ালিটি―মাত্র এক টাকায়!'
এখানে হাফ-টোন ব্লক বোঝায় যেকোনো ছবিকে অঙ্কের বিন্দুতে রূপান্তর করে ছাপার উপযোগী করে তোলা, আর ব্রোমাইড এনলার্জমেন্ট বোঝায় বড় আকারে সেই ছবির প্রিন্ট করা।
এগুলো করার জন্য যে যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক প্রয়োজন, তার সবই তিনি বিদেশ থেকে এনে নিজের ঘরে স্থাপন করেন। এই পদ্ধতিতে যেসব ছবির মুদ্রণ পশ্চিমে তখন মাত্র চল শুরু হয়েছে। উপেন্দ্রকিশোর তা কলকাতার শিবনারায়ণ দাস লেনে তারও আগে থেকেই হাতে-কলমে প্রয়োগ করছেন।

আলোকচিত্র ও প্রিন্টিংয়ে আলো ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সূর্যের আলো সব সময় পাওয়া যেত না, বিশেষত মেঘলা দিন বা রাতে। এই সমস্যার সমাধানে উপেন্দ্রকিশোর নিজের স্টুডিওতে বসান বড় বড় আর্ক ল্যাম্প, যেগুলোর আলো তৎকালীন সবচেয়ে উজ্জ্বল বিদ্যুৎ-বাতি হিসেবে ধরা হতো।
আর্ক ল্যাম্পে দুটি বিদ্যুচ্চালিত ইলেকট্রোড থেকে বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমে তীব্র আলো উৎপন্ন হতো। তিনি তাঁর ছাদের ওপরে কাচের ছাদ দিয়ে এক বিশেষ স্টুডিও তৈরি করেন, যেখানে এই আলো ব্যবহার করে দিনের আলো ছাড়াও কাজ চলত।
উপেন্দ্রকিশোর ঘরোয়া আলোকচিত্রেও মনোযোগী ছিলেন। তাঁর তোলা শিশুদের ছবি সৃষ্টিতে ছিল সূক্ষ্ম রসবোধ এবং কম্পোজিশন জ্ঞানের দক্ষতা। তাঁর মেয়ের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে―বাড়ি ছিল যেন এক সংগীত বিদ্যালয়। রাতে খাওয়ার পর কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে থেকেও তাঁরা শুনতেন―পড়ার ঘরে বসে অনেকে গান করছেন, পাশে বাজছে অর্গান আর বেহালা।
নিজের প্রথম শিশুতোষ বই ছেলেদের রামায়ণ লিখতে লিখতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সন্তানদের পড়ে শোনাতেন। কিন্তু সে বইয়ের ছবি দেখে হতাশ হন। কাঠের খোদাইতে ছবি ছাপার মান খারাপ হওয়ায় নিজেই ছাপাখানা বসান, নিজে প্রযুক্তি শেখেন, নিজে কাজ শেখান।
উপেন্দ্রকিশোর শুধু গৎবাঁধা গবেষক নন, তিনি একই সাথে শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, গল্পকার, সমাজ সংস্কারক। তাঁর হাতে বাংলা ছবি ও ছাপার প্রযুক্তি প্রথমবার শিল্প আর বিজ্ঞানের মিলনে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছায়।
১৯১৩ সালে মৃত্যুর আগের বছর শুরু করেন শিশুদের পত্রিকা 'সন্দেশ'। প্রথম সংখ্যার ভূমিকায় লেখেন, 'সন্দেশ শুনলেই খাওয়ার জিনিস মনে আসে, এই দোষ আমাদের অভ্যাসের। সত্যিকারের মানে হলো―সংবাদ।'
ফটোগ্রাফি নিয়ে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয় ছোট ভাই কুলদারঞ্জন, যিনি পরে বিশেষ দক্ষ হন প্রয়াত ব্যক্তিদের ছবির এনলার্জমেন্টে। সত্যজিৎ রায় স্মরণ করেন, কুলদারঞ্জন বা 'ধোন্দাদু' নাকি ঝাপসা ছবির মধ্য থেকেও এমন জীবন্ত মুখ বানিয়ে দিতেন, যেন মনে হতো ছবি থেকে সত্যিই কেউ তাকিয়ে আছে!
উপেন্দ্রকিশোরের সুপুত্র 'আবোল-তাবোল' বা 'পাগলা দাসু'র জন্য বিখ্যাত সুকুমার রায়, তিনিও লন্ডনে গিয়ে ছবি ও ছাপার কলা শিখেছিলেন। প্রবাসী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লেখেন, 'শিল্পী যেটা অপছন্দ, তা বাদ দিতে পারেন; কিন্তু ফটোগ্রাফারের চোখে সবই সমান, সুন্দর-অসুন্দর বলে কিছু নেই।'
একসময় ক্যামেরা ছিল জাদুর বস্তু। ধীরে ধীরে যখন সাধারণ মানুষ তা ব্যবহার করতে শিখল, তখন ছবির সঙ্গে যুক্ত হলো বিজ্ঞান। রাজেন্দ্রলাল, বীরচন্দ্র, উপেন্দ্রকিশোর―সবাই এই বৈজ্ঞানিক আলোর প্রথম লাভবান।
তাঁর উত্তরসূরিরা―সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায় এই উত্তরাধিকারের পথেই হেঁটেছেন। কিন্তু প্রযুক্তির গভীরে গিয়ে প্রথম নিজ হাতে যিনি 'আলো ও ছায়ার খেলা' নিয়ে গবেষণা করে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন, তিনি নিঃসন্দেহে ময়মনসিংহের সন্তান উপেন্দ্রকিশোর।
এরপরের প্রজন্ম তাদের পথ দেখল। সাধারণ পাঠকও যখন নিজের ঘরের তাক, বই, ম্যাগাজিন, এমনকি সিনেমার পর্দায় ছবি দেখতে শুরু করল, তখন ছাপার ছবি হয়ে উঠল এক শিল্প-বিজ্ঞানের যুগল রূপ।
আজ যখন মোবাইল ক্যামেরা হাতে নিয়ে আমরা মুহূর্তে ছবি তুলে ফেলি, তখন ভোলা যায় না সেসব পথিকৃৎদের, যাঁরা আলোর বিন্দু দিয়ে আঁকতেন সময়, সমাজ ও আত্মার প্রতিচ্ছবি।