রাণী ও কুটকুটের ভালোবাসা

শিকার–মানবসভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন পেশা। আদিম মানুষ শিকার করত খাদ্য সংগ্রহে কিংবা আত্মরক্ষার্থে। সভ্যতার ক্রমবিকাশে সেই পেশা আধুনিক বিশ্বে প্রায় বিলুপ্তই বলা চলে, সেটা এখন রূপ নিয়েছে এক নেশায়। তবে এই নেশা আর পেশার বাইরেও কিছু ভিন্ন বিষয় রয়েছে। প্রথা, ঐতিহ্য, জাতিগত বৈশিষ্ট্য; বিশ্বের অনেক স্থানেই, অনেক গোত্র ও সমাজে শিকার শব্দটা এসব বিষয়ের সাথে জড়িত।
উত্তর আমেরিকার কিছু অঞ্চলে কোয়োটের (আমেরিকান শিয়াল, প্রেইরি নেকড়ে বা ব্রাশ নেকড়ে নামেও পরিচিত) বিস্তৃতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শিকার করা হয় রীতিমতো বার্ষিক আয়োজন করে, উৎসবের মতো। ফ্লোরিডার জলাভূমিতে বার্মিজ পাইথনের আধিক্য বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার অন্য প্রাণীরা হুমকির মুখে বিধায় পাইথন শিকারে সেখানে পুরস্কৃত করা হয়; সারা বিশ্ব থেকে বহু সাপশিকারি এ জন্য সেখানে ভিড় জমান।
আবার ঐতিহ্য কিংবা গোত্রের প্রথা হিসেবে শিকারের কথাও যদি বলি, আমাদের দেশে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীরাও এমন এক প্রথা পালন করে। বৈশাখী পূর্ণিমার দিনটিতে তারা 'শিকার উৎসব' পালন করে চিরাচরিত প্রথাকে স্মরণে রেখে। শিকারি জাতি হলেও বর্তমানে পেশা বদল, সেই সাথে বনাঞ্চল ও প্রাণী কমে যাওয়ার কারণে শিকার সহজ বিষয় নয়। তবুও কোনো প্রাপ্তির আশায় নয়, উত্তেজনার প্রবল আকর্ষণে এক স্বতন্ত্র অধিকারের সহজাত বোধে উদ্দীপ্ত হয়ে তারা ওই দিন শিকারে বের হয়ে পড়ে। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট জায়গায় উপস্থিত হওয়ার আগেই সাঁওতাল পুরুষেরা তির, ধনুক, বর্শা, বল্লম, কুড়াল সব ঘষেমেজে শাণ দিয়ে ধারালো ও চকচকে করে রাখে। মেয়েরা বিভিন্ন রঙের শুকনা খাবার তৈরি করে। পুরুষেরা শিকারে যাওয়ার আগে স্ত্রীদের হাতের নোয়া খুলে রেখে যায়। মতভেদে এ রীতি নেই। পুরুষেরা শিকারে যাত্রা করলে না ফিরে আসা অবধি মহিলারা কিছু সংস্কার মেনে চলে। যেমন তেল, সিঁদুর ব্যবহার করবে না। কাপড় কাচা নিষিদ্ধ। এ ছাড়া কাউকে কোনো জিনিস দেওয়াও চলবে না। প্রাচীন প্রথা বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে তীব্র আকর্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে বছরের নির্দিষ্ট দিনে শিকার উৎসবে বের হয়ে গভীর বনে প্রবেশ করে অনেক পশু শিকার করে 'গিপিতি চটৌন্ডি'তে ফিরে আসা তাদের সুখস্বপ্নের এক অংশ বলেই বিবেচিত।
খুঁজলে হয়তো এমন আরও পাওয়া যাবে, তবে সেসব কথা থাক। আজ বলব চৌহান সম্প্রদায়ের কথা।
ভাওয়ালের কিছু অংশ, নরসিংদী ও সিলেটের শুরুর দিকের কিছু অংশে এই সম্প্রদায়ের লোক খুঁজে পাওয়া যায়। এরাও জাতিগতভাবে শিকারে অভ্যস্ত। শিকার এদের প্রাচীন পেশা ও নেশা। তবে আধুনিক যুগের তাগিদে সেখানকার অনেকেই ভিন্ন পেশায় যোগ দিয়েছে, পড়ালেখার সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে কেউ কেউ চাকরিতেও জড়িত। তারপরেও এই গোত্রের কিছু মানুষ এখনো আদিম প্রথায় বিশ্বাসী। সুযোগ পেলেই বন কিংবা গ্রামীণ ঝোপ থেকে গোপনে প্রাণী শিকার করে। বন্য প্রাণী বিশেষত সজারুর বাচ্চা পেলে সেটাকে শিকার না করে বরং বাড়িতে নিয়ে এসে পেলে-পুষে বড় করে এরপর হত্যা করে সেটাকে ভক্ষণ করে এরা।
বন ও প্রাণী সংরক্ষণের নেশা আমার। প্রকৃতিতে প্রাণীদের অস্তিত্বের গুরুত্ব বুঝি। অতীতে একাধিকবার এদের হাত থেকে সজারু, সাপসহ কিছু প্রাণী উদ্ধার করেছি আমি। কখনো একা, কখনো স্থানীয় মানুষ ও বন্ধুদের সাথে নিয়ে। ডিপ ইকোলজি ও স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনের ইফতিকার মাহমুদ, সেইভ ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড নেচারের বাপ্পী খান, শুভব্রত সরকার, সীমান্ত সরকার–তাঁরাও একাধিকবার এই কাজে এগিয়ে এসেছে আমার ডাকে; প্রাণপ্রকৃতি রক্ষার্থে। এভাবেই একবার আমার ডাকে তারা ছুটে আসে আমার গ্রামে। চৌহান সম্প্রদায়ের দুজন শিকারিকে আমি ডেকে আনাই এদের সামনে, আমার কাছে খবর ছিল এই দুই শিকারি সম্প্রতি সজারু ধরেছে। ঢাকা থেকে ছুটে আসা তরুণ প্রাণীরক্ষা কর্মীদের সামনে তারা বিনীত সুরে জানায়, সজারু তারা বনে ছেড়ে দিয়েছে আমাদের ভয়ে। বাপ্পীরা তখন বন্য প্রাণী আইন, ২০১২ সম্পর্কে তাদের জানায় এবং এ-ও বলে যে পরবর্তী সময়ে তারা আবারও বন্য প্রাণী শিকার করলে সেটা বন বিভাগের মাধ্যমে আইনত শাস্তি পাবে। দুই শিকারি প্রতিজ্ঞা করে, এমন কাজ আর তারা করবে না।
বন ও পাহাড়ে জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে আমার। প্রকৃতির মতো সরল ও সোজা হিসেবে অভ্যস্ত। কুটিল মানবিক দিকগুলো সম্পর্কে অভ্যস্ত নই। সম্ভবত এ জন্যই সেই শিকারিদের কথা সরলমনে বিশ্বাস করেছিলাম। জানতাম না, একটা সজারু তারা তখনো আটকে রেখেছে, ভবিষ্যতে সেটা ভক্ষণের উদ্দেশ্যে।
শরীরে কাঁটাযুক্ত, তীক্ষ্ণ দন্তবিশিষ্ট ইঁদুরজাতীয় প্রাণী সজারু। ঘাস, সবজি, লতাগুল্ম ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে থাকে এরা। একসময় আমাদের দেশের গ্রামের বাঁশঝাড়, প্রাকৃতিক ঝোপ, পরিত্যক্ত জমি, বনজঙ্গলে বেশ সংখ্যক সজারু পাওয়া যেত। কিন্তু তাদের বাসস্থান উজাড় এবং ক্রমাগত শিকার বর্তমানে স্তন্যপায়ী প্রাণীটিকে বিপন্ন তালিকায় নিয়ে গেছে। পৃথিবীর যেকোনো প্রাণী ভয়ে বা ক্ষিপ্ত হলে নিজের সামনের দিক থেকে আক্রমণ করে; কিন্তু সজারু এর উল্টো কাজ করে। তারা আক্রমণ করে দেহের পেছন দিক থেকে। নিজ দেহের কাঁটাগুলো সে এভাবে আক্রমণকারীর দেহে গেঁথে দিতে পারে। পৃথিবীতে অনেক বাঘ, চিতাবাঘ ইত্যাদি শিকারি প্রাণী সজারুর কাঁটায় আহত হয়েছে।
কলাগাছের নরম অংশ কেটে সুবিধাজনক আকার ও ওজনে রূপ দিয়ে শিকারিরা তা ছুড়ে দেয় সজারুর দিকে। কাটায় ভারী কলাগাছের নরম অংশ গেঁথে গেলে সেই ওজনে আর সজারু চলতে পারে না। শিকারিরা তখন সেই সজারু ধরে শিকার করে বা বন্দী করে।

এমনভাবেই বন্দী রাখা ছিল সজারুটা এক চৌহান পরিবারে। কিছুদিন আগে আমি গোপন সূত্রে খবর পাই এটার ব্যাপারে। টের পেলাম, ওই শিকারির মিথ্যাবাদিতার ব্যাপারে। রাগে গা জ্বলছিল। সেটা উদ্ধারের জন্য অবিলম্বে পরিকল্পনা করি। দ্রুত স্থানীয় কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে সেখানে পৌঁছাই আমি। সামনের সপ্তাহেই বাঙালি নববর্ষের প্রথম দিন, পয়লা বৈশাখ। মনে ভয়, সেই উৎসবেই যদি সজারুটাকে হত্যা করে খেয়ে ফেলা হয়!
চৌহান সম্প্রদায়ের পাড়ায় গিয়ে হাজির হলাম। সজারুটাকে অসহায়ের মতো অবস্থায় কোনো এক খাঁচায় বন্দী দেখব ভাবছিলাম। কিন্তু যা দেখলাম, তাতে বিস্ময়ের ধাক্কাটা মনে শান্তির বাতাস বইয়ে দিল।
এক কিশোরী পরম আদরে আগলে রেখেছে সজারুটিকে। তীক্ষ্ণ কাঁটার কারণে জঙ্গলের সবাই, এমনকি বাঘ কিংবা চিতাবাঘ পর্যন্ত যাকে ভয় পায়, সেই সজারু নিজ সন্তানের মতো কী করে আগলে রেখেছে সেই কিশোরী? কৌতূহল জাগল মনে। মনে হচ্ছিল কোনো বিশেষ গল্প লুকিয়ে আছে এই অস্বাভাবিক মমত্বের সম্পর্কের পেছনে।
চৌহান সম্প্রদায়ের এক সাদাসিধা কিশোরী, তার নাম রাণী। সম্প্রদায়ের মাঝে বেড়ে উঠলেও তার মন পড়ে থাকে প্রকৃতির মাঝে। প্রাণী ও প্রকৃতিপ্রেম তার সহজাত, তাই তো সম্প্রদায়ের অন্যদের মতো বন্য প্রাণী শিকার ইত্যাদি সে পছন্দ করে না, বরং সুযোগ পেলেই সেগুলোতে বাধা দেয়। এই সজারুটাও তেমনি সে রক্ষা করে চলছে বছরখানেকের বেশি সময় ধরে। ধরে আনা হয়েছিল বাচ্চাকালে, সেই সজারু বাচ্চাকে যত্ন করে খাওয়ানো, সেটার যত্ন করা ইত্যাদি রাণী করেছে নিজ সন্তানের মতো করে। কতই বা বয়স মেয়েটির, অথচ বুকভরা কত মায়া!
সযত্নে আগলে রাখলেও রাণী জানত একদিন ঠিকই গোত্রের অন্যদের নজর এই সজারুর ওপর পড়বে। বয়স কম বলে দূরের বনে যাওয়ার সুযোগ নেই তার। আশপাশের ঝোপে সজারুটাকে ছাড়লেও সেটা আবার ধরা পড়বে নিশ্চিত। তাই তার মনেও ছিল দুশ্চিন্তার মেঘ।
আমাদের দেখতে পেয়ে, আমাদের কথা শুনে উদ্দেশ্য জানতে পেরে সে নিজেই ছুটে আসে আমাদের কাছে। জানাল, পরম মমতায় লালন করে চলা এই সজারুটার নাম সে রেখেছে কুটকুট। কুটকুট তার কথা শোনে, ডাক বোঝে; কিন্তু বন্য প্রাণীদের জন্য এটা স্বাভাবিক নয়, তাই সে এটাকে নিরাপদে কোনো বনে ছাড়তে চায়।
মনে একরাশ স্বস্তি জাগল। সভ্য মানুষেরাও যেখানে আজকাল প্রাণীদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশে পিছপা হয় না, সেখানে প্রত্যন্ত আদিবাসীদের মাঝে বেড়ে ওঠা এই কিশোরীর মনে প্রাণীর প্রতি কী দারুণ প্রেম!
ফোন দিলাম সেইভ ওয়াইল্ড লাইভ অ্যান্ড নেচার (সোয়ান) সংস্থার বাপ্পীকে, সে বন বিভাগের ঢাকা বিভাগের বন্য প্রাণী পরিদর্শক নিগার সুলতানার সাথে আলাপ করল। আমাকেও নিগার সুলতানা ফোন করে, ভিডিও কলে দিকনির্দেশনা ও অনুমতি দিলেন–সজারুটি সেই আদিবাসী গ্রাম থেকে উদ্ধার করে সাময়িকভাবে নিজের কাছে রাখতে অবমুক্তকালীন প্রস্তুতি ও পর্যবেক্ষণের (কোয়ারেন্টিন) জন্য।
দুদিন গেল এভাবেই। রাণীর সাথে যোগাযোগ হয়েছে নিয়মিত। আদরের প্রাণীকে দূরে সরিয়ে সে দুঃখী, আবার সেটার ভবিষ্যৎ জীবনের কামনায় সে আশাবাদীও; সে এক মিশ্র অনুভব। এই বিষয়টা আমিও টের পাই নিজের ভেতর। বন-প্রকৃতির অভিজ্ঞতা তো আর কম নেই।
এপ্রিলের ১২ তারিখ সকালে বাগানবাড়িতে বসে আছি। সজারুর অবমুক্তকরণের কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ মাথায় এল দুদিন পরেই তো পয়লা বৈশাখ। আমরা প্রাণিপ্রেমী মানুষ। বাঙালি নতুন বছরের পয়লা দিনে একটা প্রাণী প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়ার মতোন শুভ কাজ করেই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখা যায় না? আবার ফোন দিলাম বাপ্পী খানকেই, সে আমার আকাক্সক্ষা শুনে জানাল, সজারুটা স্বাভাবিক প্রকৃতিতে অবমুক্তের সবচেয়ে নিকটবর্তী সুযোগ রয়েছে ভাওয়াল বনাঞ্চলে। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের সংরক্ষিত অঞ্চলে সজারু রয়েছে। সেখানে কুটকুটকে অবমুক্ত করা সম্ভব।
বাপ্পী যোগাযোগ করাল ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের সহকারী বন সংরক্ষক শাখেরা আক্তার শিমুর সাথে, উনি সব শুনে খুব আন্তরিকতার সাথেই অনুমতি দিলেন এবং ব্যবস্থা করে দিলেন সজারুটিকে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে অবমুক্তকরণের। পয়লা বৈশাখের রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে কুটকুটকে নিয়ে ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশে রওনা দিলাম আমি, রাণীসহ আরও কয়েকজন, যারা এই সজারুসহ অন্যান্য প্রাণী উদ্ধারে আমার সহযোগী। রাজেন্দ্র চৌহান; ছেলেটি চৌহান সম্প্রদায়ের।
ছোটবেলা থেকেই প্রাণিপ্রেমী। চৌহান হয়েও বরাবরই সজারু ও প্রাণী শিকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার সে। মেধাবী ছেলেটি এখন একটি কনস্ট্রাকশন ফার্মে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তবে তার প্রাণীর প্রেম আজও বিদ্যমান। অতীতে বহু প্রাণী সে উদ্ধার করে অবমুক্ত করেছে। আরও রয়েছে আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী স্কুল শিক্ষক শহিদুল হক বাচ্চু। আছে আমার সার্বক্ষণিক সহচর আবুল হোসেন এবং মাসুদ ভুইয়া। ঢাকা থেকে সোয়ানের পক্ষে ছুটে এসেছে বাপ্পী খান ও শুভব্রত। প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্যে বনে প্রবেশ করতেই মনটা খুশিতে ভরে গেল। এই সবুজ গাছ, বুনো সুবাস; এসবই যেন আমার জীবনের চিরচেনা, অবিচ্ছেদ্য এক অংশ।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের সহকারী বন সংরক্ষক শাখেরা আক্তার শিমু নিজ কার্যালয়ে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। পয়লা বৈশাখ সরকারি ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছুটে এসেছেন সজারুটিকে অবমুক্তির ব্যবস্থায়; তার প্রাণিমমত্বের এমন প্রকাশ আমাদের মাঝে অনুপ্রেরণা জোগায়। তার সাথে স্থানীয় বিট রেঞ্জার ও জাতীয় উদ্যানের কয়েকজন কর্মচারীও উপস্থিত ছিলেন সেই দিন।
শাখেরা আক্তার শিমুর পরামর্শমতে আমরা সংরক্ষিত বনের দুটো স্থান পরিদর্শন শেষে একটি উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে সিদ্ধান্ত নিলাম কুটকুটকে সেখানে অবমুক্ত করার। জায়গাটির আশপাশে অন্যান্য সজারুদের আনাগোনার দেখা মেলে প্রায়ই, ফলে তাদের সাথে মিশে যেতে পারবে সজারুটি। ঘাস-ঝোপ ও পানির আধার রয়েছে বিধায় প্রকৃতিতে টিকে থাকতেও সমস্যা হবে না।
সবাই উৎফুল্ল ও আনন্দিত চেহারায় কুটকুটের খাঁচাটিকে গাড়ি থেকে নামিয়ে খাঁচার দরজা খুলে দিল। নতুন স্থান, নতুন পরিবেশ টের পেয়েই বোধ করি সজারুটি কিছুক্ষণ খাঁচাতেই বসে রইল নীরবে। আমরা সবাই তখন অপেক্ষায়, কখন খাঁচামুক্ত সজারু প্রকৃতির বুকে ফিরে যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না। রাণী তখন এগিয়ে গেল গুটিগুটি পায়ে, আমাদের হতবাক করে দিয়ে সেই কাঁটাযুক্ত প্রাণীটিকে সে নিজ হাতে আগলে ধরে খাঁচার বাইরে বের করে আনল। তার চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত। কিশোরী মেয়েটা জানে, আর কিছুক্ষণ পরেই তার প্রিয় 'কুটকুট' হারিয়ে যাবে বুনো ঝোপের আড়ালে, এটাই হয়তো তার সাথে শেষ দেখা।
বুকে পাথর বেঁধেই সজারুটিকে ঝোপের কাছে নামিয়ে দিল রাণী। কিছুক্ষণ নাক উঁচু করে বাতাসের ঘ্রাণ শুঁকে একসময় সজারুটি ঝোপের দিকে পা বাড়াল। কিন্তু পরক্ষণেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে আবার ফিরে এল রাণীর পায়ের কাছে। সেটা তুলে আবার ঝোপের কাছে রাখা হলো। আবারও সেটা ফিরে এল রাণীর কাছে।
মানুষ ও বন্য প্রাণীর এমন মমত্বের দৃষ্টান্ত কিন্তু মানবসভ্যতায় অতি বিরল। মানুষটি প্রাণীটির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চাচ্ছে, সেটা যেন প্রকৃতিতে ফিরে যায়, অপর দিকে প্রাণীটি মানুষের মমতার মায়ায় ফিরে আসছে বারবার। আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এখন করণীয়?
কিন্তু বন্যরা যে বনেই সুন্দর। সব মানুষ তো আর রাণীর মতো বিশাল হৃদয় আর এক বুক ভালোবাসা নিয়ে জন্মায় না, সেখানে সজারু কেনÑসকল প্রাণীর জীবনেই ঝুঁকি রয়েছে। তাই আমরা কৌশল অবলম্বন করে ধীরে ধীরে সরে আসি সেখান থেকে। আড়াল থেকে লক্ষ করি, একসময় কুটকুট ঝোপের আড়ালে চলে গেল; নিজের জীবনের এক নতুন অধ্যায় রচনা করতে।
আর আমরাও ফিরতে শুরু করলাম বন থেকে যান্ত্রিক সভ্যতার মাঝে। ভেবেছিলাম বৈশাখের পয়লা দিনটা প্রাণী অবমুক্তের মাধ্যমে আনন্দের হবে। কিন্তু মনে জন্ম নিয়েছে সূক্ষ্ম কিছু বেদনা আর অতি উৎসাহী ভাবনার। মানুষ-বন্য প্রাণীর সহ-অবস্থান কি এ দেশে কখনো সম্ভব না? দেশের প্রাণিপ্রেমী, প্রাণী সংরক্ষণে জড়িত স্বেচ্ছাসেবী ও বন বিভাগের সরকারি কর্মকর্তারা একত্রে চাইলে প্রকৃতি ও প্রাণী রক্ষার্থে ভালো কিছু করা সম্ভব, সেটা এই সজারু উদ্ধার ও অবমুক্তের বেলায় আরেকবার প্রমাণিত। তাহলে আমরা কেন স্বপ্ন দেখা ছাড়ব? যা ধ্বংস হয়েছে হোক, যা টিকে আছে, তা কি বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়?
আশাতেই তো বাঁচে মানুষ। পয়লা বৈশাখের পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের নরম আলো বোধ হয় সেটাই জানাতে চাইছিল আমাদের।
- [শ্রুতিলিখনের ভিত্তিতে তৈরি করেছেন: বাপ্পী খান]