সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান অন্তরায় পক্ষপাতিত্বমূলক প্রশাসন ব্যবস্থা

ধন্যবাদ নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা। নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে তিনি কর্মকাল শেষ করলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে নুরুল হুদা বলেছেন, তারা কোনো বিষয়ে বিব্রত নন। তাদের পক্ষে যা করার ছিল, আইনগতভাবে তারা সে অনুসারে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন! 'দায়িত্ব পালন' করার ক্ষেত্রে তারা হয়তো সঠিক- কিন্তু নির্বাচন কমিশন দেশের আইন ও প্রথা ভঙ্গ করেছেন কতগুলো তার হিসাব কি করা হয়েছে? আইন আছে অথচ প্রয়োগ করতে সক্ষম হননি, তারও হিসাব করা হয়নি। বিষয়গুলো গণমাধ্যমের দৃষ্টিও এড়িয়ে গেছে।
আইনের ব্যত্যয়গুলো কী ঘটেছিল? বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হলো, ২০১৮ সালের নির্বাচন। নির্বাচনের আগের রাতে ভোটবাক্স ভরে ফেলা হয় অর্থাৎ ভোট প্রদান সম্পন্ন করা হয়। কাজটি কারা করলো? এজাতীয় কাজ প্রতিহত বা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব কার? ঘটনা সত্য হলে- নির্বাচন বৈধ হলো কিনা? নির্বাচনে বৈধতার প্রশ্ন থাকলে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সরকারও একই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। এনিয়ে গত সাড়ে তিন বছরে কম জল ঘোলা হয়নি। তবে এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কি? একটা সাধারণ ধারনা সমাজে প্রতিষ্ঠিত- এজাতীয় সকল অনিয়ম, বেআইনী ও অবৈধ কাজ নির্বাচন কমিশন সুরাহা করতে পারে।
আমাদের সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। কিন্তু এই স্বাধীনতা অর্থবহ করতে হলে আইন ও বিধি দ্বারা সুরক্ষা দিতে হবে। আইনে বলা আছে, নির্বাচনের সময় প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নির্বাচনের কাজে সহযোগিতা করবে। এরই অংশ হিসেবে ভোটকেন্দ্রের সুরক্ষা দেবার জন্য পুলিশ ও এই কাজের তদারকির জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন করা হয়। পরবর্তীতে অভিযোগ উঠেছে, ভোটের বাক্স ভরার কাজে পুলিশ যুক্ত ছিল। নির্বাচনী কাজের 'সহযোগিতার' চরম লংঘন সত্ত্বেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কমিশনের হাতে কোন ক্ষমতা দেওয়া আছে কিনা- এই জাতীয় ক্ষমতা বিশ্লেষণ করেই বুঝতে হবে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন কিনা?
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের ৪ উপ-অনুচ্ছেদ বলছে, 'নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন'। নির্বাচনী সামগ্রিক ব্যবস্থা যেমন ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা, নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ করা, নির্বাচনী আচরণবিধি প্রণয়ন ও তার নিরপেক্ষ প্রয়োগ এ সবই নির্বাচন কমিশনের কাজ। অন্যদিকে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া সকল দলের নির্বাচনী কাজে সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, নির্বাচনী ঝুঁকি নিরূপণ ও সেই অনুযায়ী আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে মোতায়েন এসবই নির্বাচন কমিশনের কাজ। প্রশ্ন হলো, এসব কাজ নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ভাবে করতে পারে কিনা?
সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ বলছে, 'নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে'। অর্থাৎ উপরে উল্লেখিত সকল কাজের জন্য নির্বাচন কমিশনকে নির্ভর করতে হবে সংবিধানে উল্লেখিত "নির্বাহী কর্তৃপক্ষের" উপর। এই 'কর্তৃপক্ষ' যদি কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষালম্বন করেন বা কোন দলের প্রতি রুষ্ট হন বা ক্ষতি করার চেষ্টা করেন- সেরূপ পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন ঐ কর্মকর্তার বদল করতে পারবেন। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার মাপকাঠি এখানেই। নির্বাচন কমিশনের এমন ক্ষমতা থাকতে হবে, যেন কমিশন চাইলে তৎক্ষণাৎ অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে বদলী করতে পারেন। পরিবর্তে যিনি আসবেন তিনিও একই কাজ করলে নেওয়া হবে অনুরূপ ব্যবস্থা। অর্থাৎ যতবার ঘটবে ততবার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নির্বাচন কমিশন আইনের পূর্ণাঙ্গতা এখানেই। আমাদের সংবিধানে নির্বাচন কমিশন "স্বাধীন থাকিবে" বা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহীগণের "কর্তব্য হইবে" বলা হলেও এর অনুকূলে উপযুক্ত আইন না থাকলে অর্থবহ হবে না। আমাদের 'নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন, ২০২২' পাস হওয়ার আগে এই কলামে একাধিকবার আলোচনা করেছি, কমিশন নিয়োগের আইন দরকার আছে কিন্তু সেইসাথে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা বা নিরপেক্ষভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য আইন থাকতে হবে।
আমাদের এই উপমহাদেশের দেশগুলোতে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান অন্তরায় অনিরপেক্ষ ও পক্ষপাতিত্বমূলক প্রশাসন ব্যবস্থা। প্রশাসন প্রায়শই ক্ষমতাসীনদের পক্ষালম্বন করে থাকে। এই পক্ষ নেওয়া এখন এমন পর্যায়ে যে, রাজনৈতিক দলের লোক ও প্রশাসনের লোক অনেক সময় আলাদা করা যায় না। প্রশাসন ক্রমান্বয়ে 'দলবাজ' প্রশাসনে পরিণত হয়েছে। আমরা ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশনের কথা এর আগেও বলেছি। ভারতে আলাদাভাবে নির্বাচন কমিশন আইন না থাকা সত্ত্বেও সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদের উপর ভর করে টি এন সেশন নির্বাচনের সময় প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে বাধ্য করেছিলেন।
টি এন সেশন দায়িত্ব নেবার পর নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য 'দলবাজ' প্রশাসনই প্রধান অন্তরায়, বলে চিহ্নিত করেছিলেন। যখন যেখানে পক্ষপাতিত্বমূলক বা দলবাজির আচরণ পরিলক্ষিত হয়েছে, তড়িৎ বদল ঘটেছে সেই নির্বাহী কর্তার, তা তিনি যত উপরের হোন না কেন। প্রতিবেশী ভারতে আমাদের পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের সর্বোচ্চ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের চাহিদার ভিত্তিতে বদলীর ঘটনা ঘটেছে। দলীয় সরকার শত চেষ্টা করেও সেই বদলী ঠেকাতে পারেনি। শাস্তিমূলক বদলীর এই 'দাগ' চাকরি জীবনের বাকী সময়ে মুছে ফেলার কোন সুযোগ নেই।
নির্বাচন কমিশন নিয়ে আমাদের বিতর্কের অবসান কবে ঘটবে সেটি আজও বড় প্রশ্ন। আমাদের নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। নুতন আইন অনুযায়ী গঠিত সার্চ কমিটি গতকাল ৩২২ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেছেন। আজ গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষের সাথে সার্চ কমিটির বৈঠক হয়েছে। তালিকার দৈর্ঘ্য কতটা বৃদ্ধি পাবে- তা এখনই বলা যাবে না। এই তালিকায় সাবেক বিচারপতি, আইনজীবী, সামরিক- বেসামরিক আমলা-কর্মকর্তা, সাবেক নির্বাচন কমিশনার, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সুশীল সমাজ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অভিনয় শিল্পী, ফ্যাশন ডিজাইনারসহ নানা পেশার মানুষের নাম রয়েছে। এখন দেখার বিষয় কোন পদ্ধতিতে ১০ জন 'যোগ্য' মানুষ খুঁজে বের করা হবে।
আমাদের সংবিধানে বিচারপতিদের অবসর জীবনে অন্য কোনো পেশা গ্রহণের সুযোগ ছিল না। বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে নিয়োগ দানকালে জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ উত্তর বাংলাদেশে এই বিধানের পরিবর্তন করেছিলেন। যে কারণে এই তালিকায় অনেক প্রাক্তন বিচারপতির নাম রয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল ও তাদের জোট নির্বাচন কমিশন গঠনের এই সামগ্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে থাকার অবস্থান নিয়েছে। তারা মনে করে, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থাটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ভাষায়, "দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়"- ফলে নির্বাচন কমিশন সংস্কার বা নুতন কমিশন গঠন "নিরপেক্ষ" নির্বাচনের শর্ত পূরণ করে না। অর্থাৎ আলাদাভাবে নির্বাচন কমিশনের মত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠা খুব জরুরি না। অথচ ভারতে দলীয় সরকার ছোট আকারে 'নির্বাচনকালীন' সরকার হিসেবে থাকছে এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন করা হয়েছে কিনা? এটা করা গেলে- স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য সামরিক সরকার বা তত্তাবধায়ক সরকারের দরকার হয় না। এখানে একটা রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি রয়েছে। ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাপ্রত্যাশী উভয়ের অন্তর্গত ভাবনা একটি "অনুগত" নির্বাচন কমিশন। তারা মনে করে, জনগণের মন জয় করার চেয়ে নির্বাচন কমিশন ভোটে জয়লাভে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। এবং সে কারণেই গত ৫০ বছরে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আজ যারা এই প্রক্রিয়ার বাইরে অবস্থান নিয়েছেন তারাও দুই দশকের বেশি সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশন আইন কেন করেননি তারা?
আমাদের চিন্তা-ই যদি থাকে, নির্বাচনকালীন "অন্য কোন বিশেষ ধরনের সরকার" ক্ষমতায় আসবে এবং তাদের জোরেই নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে- তা হলে কখনোই নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী হয়ে উঠবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক