বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের চ্যালেঞ্জ ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা

উৎসে কর বর্তমানে রাজস্ব আদায়ের অন্যতম হাতিয়ার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রকাশিত সর্বশেষ ২০২০-২০২১ করবর্ষের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী সর্বমোট আয়করের ৬০ শতাংশ অধিক উৎসে আদায় হয়। পরবর্তীকালে উৎসে করের আওতা আরও বাড়ায় এবং কর কর্মকর্তাদের নজরদারি বাড়ার কারণে উৎসে করের অবদান আরও বৃদ্ধি পাবে, যা আমরা ২০২০-২০২১ পরবর্তী বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করলে জানতে পারব। সরকার পরিচালনায় যখন যে সরকারই থাকুক না কেন- এ ধারার বাইরে আসার প্রবণতা এনবিআরের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। বলা যায়, এটা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই প্রথার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে- এখনও প্রত্যক্ষ করও পরোক্ষ কর আদায়ের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যেহেতু পণ্য বা সেবা বিপণনের নিম্নস্তরগুলো থেকে কর আদায় নিশ্চিত করার সহজ কোনো রাস্তা মিলছে না, সে কারণে উৎপাদন বা আমদানি বা সেবা প্রদানের প্রাথমিক পর্যায়ে করদাতার কাছ থেকেই বেশি কর আদায় করা হচ্ছে।
বিভিন্ন খাতে কীভাবে অগ্রিম কর ব্যবসায়ীর কর বোঝা বাড়াচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত কীভাবে পণ্য ও সেবা মূল্য বাড়িয়ে ভোক্তার ওপর পড়ছে, তা কিছু উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক-
আমদানি পর্যায়ে উদাহরণ
ধরুন একজন ফল আমদানিকারক খেজুর আমদানি করলেন। ধরে নিলাম জাহাজ ভাড়া যোগ করে খেজুরের শুল্কায়ন মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০০ টাকা। এসআরও সুবিধা নিয়ে এ ধরনের আমদানিকারককে ১৫ শতাংশ শুল্ক, ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রক শুল্ক, ১৫ শতাংশ মূসক এবং ১০ শতাংশ অগ্রিম দিতে হয়। এ হিসাবে আয়কর বাদ দিয়ে তার খরচ আসে ১৩৬ টাকা। যেহেতু আমদানিকালে পরিশোধিত আয়কর ন্যূনতম কর, তাই এই আমদানিকারককে কী দামে খেজুর বিক্রি করতে হবে চলুন, সেই হিসাব করি।
ধরুন- বিক্রয়মূল্য ১৯০ টাকা। তাহলে এ মূল্যের ওপর ৭.৫ শতাংশ হারে, অর্থাৎ ১৩ টাকা মূসক সরকারকে প্রদান করতে হবে। মূসকবাদে মূল্য দাঁড়াবে ১৭৬ টাকা। ক্রয়মূল্য ১৩৬ টাকা বাদ দিলে লাভ দাঁড়ায় ৪০ টাকা। ধরে নিলাম কার্যকর আয়কর হার ২৫ শতাংশ। তাই ৪০ টাকা লাভের ওপর ২৫ শতাংশ করহার প্রয়োগ করলে করদায় আসে ১০ টাকা। যেহেতু আমদানি পর্যায়ে ১০ টাকা অগ্রিম কর প্রদান করা হয়েছিল, তাই এই আমদানিকারককে আর কোনো আয়কর দিতে হবে না, যদি না তার অন্যান্য কোনো উৎস থেকে আয় থাকে।
অর্থাৎ এই আমদানিকারককে তার খরচের ওপর ৩০ শতাংশ লাভ করতেই হবে, যদি তিনি অগ্রিম আয়কর সমন্বয় করতে চান। যদি ৩০ শতাংশ লাভ করা না যায়, তাহলে এই অগ্রিম আয়কর তার খরচের অংশ হয়ে যায় এবং পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। যেহেতু বিদ্যমান ব্যবস্থায় এনবিআর আমদানিকারক ব্যতীত পরবর্তী বাজারজাতকারি; যেমন- পাইকারি ব্যবসায়ী বা খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে কর আদায় করতে পারছে না, সে কারণে তাদের করভারও এই আমদানিকারকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে- শেষ পর্যন্ত পণ্য বা সেবা বিক্রি করে নিট মুনাফা হবে কি-না, তা নিশ্চিত হওয়ার আগেই ওই পণ্য বা সেবার বিক্রি মূল্যের অগ্রিম কর আদায় করা হচ্ছে। ফলে মুনাফা নিশ্চিত করতে পাইকারি পর্যায়ে পণ্য বা সেবার বিক্রির মূল্য বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এতে পণ্য বা সেবার এই বাড়তি মূল্য ভোক্তাদের ওপরই পড়ছে।
সেবা খাতে করের প্রভাব
সেবা খাতের ক্ষেত্রে সেবাপ্রদানকারীদের বিল থেকে ১০ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করা হয়, যা ন্যূনতম কর হিসেবে গণ্য হয়। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি ১০০ টাকার বিল করে, তবে ১০ টাকা উৎসে কর কাটা হয়। এটি সমন্বয় করতে হলে কোম্পানিকে ৪০ টাকা লাভ করতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত নয়।
ফলে ব্যবসায়ীরা বাড়তি করের চাপ সামলাতে সেবার মূল্য বৃদ্ধি করেন, যার প্রভাব সরাসরি ভোক্তার ওপর পড়ে।
প্রতিবছর উৎপাদনকারীদের উৎসে কর যৌক্তিকীকরণ করার প্রয়াস নেওয়া হয় কিন্তু সেবাপ্রদানকারীদের জন্য করভার লাঘবের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, উৎপাদনকারী থেকে সেবাসেবাপ্রদানকারী উল্লেখযোগ্য বেড়ে গেছে, কিন্তু তাদের সমস্যা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
নির্মাণ খাতে করের বাস্তবতা
একই চিত্র মিলবে নির্মাণ খাতে। একটি নির্মাণ কোম্পানির ক্ষেত্রে ৭ শতাংশ উৎসে কর কাটা হয়, যার ফলে ১০০ টাকার প্রকল্পে ৭ টাকা কর দিতে হয়। এটি ন্যূনতম কর। কার্যকর করহার ২৫ শতাংশ হলে ২৮ টাকার মুনাফা করতে হয়, যাতে করদায় মেটানো যায়। কিন্তু নির্মাণ খাতে এই পরিমাণ লাভ করা কঠিন হওয়ায় অতিরিক্ত করের চাপ নির্মাণ খরচ বাড়িয়ে দেয় এবং অবশেষে এটি সাধারণ জনগণের জন্য বাড়ি নির্মাণের ব্যয় বাড়িয়ে তোলে।
কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম করের প্রভাব
একটি কোম্পানি কাঁচামাল আমদানি করলে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর পরিশোধ করতে হয়। পরবর্তীকালে ওই কাঁচামাল দিয়ে প্রস্তুতকৃত পণ্য বিক্রির সময় যদি এটি কোনো উৎসে কর কর্তনকারী পরিবেশক বা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হয়, তাহলে ৫ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করা হয়।
ধরে নিই আমদানি মূল্য ৫০ টাকা, যার ওপর ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর প্রদান করা হয়েছে। অন্যান্য খরচ ৩০ টাকা। পণ্যটি ১০০ টাকায় বিক্রি করা হলো। ১০০ টাকার ওপর ৪ টাকা উৎসে কর (উদাহরণস্বরূপ) কাটা হয়েছে। অর্থাৎ সর্বমোট ১০ টাকা কর দেওয়া হয়েছে। তাহলে কোম্পানির লাভ: ২০ টাকা। এই ২০ টাকার ওপর ২৫ শতাংশ কর ধরলে করদায় ৫ টাকা। কিন্তু ইতোমধ্যে ১০ টাকা কর প্রদান করা হয়েছে।
প্রশ্ন ওঠে- বাড়তি ৫ টাকা কি ফেরত পাওয়া যাবে? আইনগতভাবে সম্ভব হলেও বাস্তবে এটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এখন অগ্রিম আয়কর ব্যবস্থা না থাকলে ভোক্তা অন্তত ৫ টাকা কমে পণ্যটি পেতে পারতেন।
ইতিবাচক দিক হলো, ২০২৪ অর্থ আইনে ৩৬ প্রকার কাঁচামালের ওপর অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। তবে এতে যে সমস্যার সমাধান হচ্ছে না, তা কেউ আমলে নিচ্ছেন না।
কৃষি খাতে কর বৈষম্য
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বীজ উৎপাদনে নিয়োজিত কোম্পানিগুলোকেও চুক্তিভিত্তিক কৃষকদের থেকে বীজ সংগ্রহের সময় ৩ শতাংশ উৎসে কর দিতে হয়। অথচ একই কৃষি পণ্য যখন বাজারে বিক্রি হয়, তখন ১ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হয়। এই বৈষম্য বীজ উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেয়, যা কৃষকের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং কৃষি উৎপাদন ব্যয় বাড়ায়। এটি মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাছাড়া উৎসে কর্তন বিধিমালার বিধি ৩এ-তে অনেক পণ্যের নাম অন্তর্ভুক্ত নেই। যারা এই বিধান মেনে ব্যবসা করতে চান, তাদের এই অতিরিক্ত খরচ পণ্যের দামে যুক্ত করতে হয়, ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
সম্ভাব্য সংস্কার ও সুপারিশ
এটা অস্বীকার করা যাবে না যে ব্যবসায়ী পর্যায়ে কর আদায় সঠিকভাবে করা যাচ্ছে না। কিন্তু যারা কর প্রদান করেন না, তাদের না আটকিয়ে যারা কর দেন, তাদের ওপর করের বোঝা বাড়ানোর এবং শেষ পর্যন্ত পণ্য বা সেবা মূল্য বাড়িয়ে ভোক্তাকে চাপের মধ্যে ফেলাও কোনো যুক্তিযুক্ত ব্যাপার নয়। ধাপে ধাপে কর আদায়ের ব্যবস্থা করে, অর্থাৎ করজাল বাড়িয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব?
উৎসে কর্তন ব্যবস্থার সংস্কার ও তদারকি জোরদার
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গঠিত 'কেন্দ্রীয় উৎসে কর্তন সেল' উৎসে কর ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে পারে। তবে এর জন্য দরকার, কর প্রদানের বিষয়টি আতঙ্কজনক নয়, বরং কর প্রদান নাগরিকের দায়িত্ব- এমন বোধ সৃষ্টি করা। এই বোধ সৃষ্টির জন্য কর আদায় ব্যবস্থা আরও সহজ ও স্বচ্ছ করতে হবে।
ডিভিএস ব্যবহারের প্রসার
আইসিএবি কর্তৃক চালু করা ডিভিএস ব্যবস্থার মাধ্যমে কোম্পানিগুলোর প্রকৃত আয় ও ব্যয়ের হিসাব বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। শিল্পভিত্তিক আয়-ব্যয় বিবেচনায় উৎসে করের হার যৌক্তিকীকরণ করা দরকার।
সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের করভার হ্রাস
ইন্টারনেট, নির্মাণ ও অন্যান্য সকল সেবাখাতের জন্য উৎসে কর যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
অগ্রিম আয়কর হ্রাস ও কর সমন্বয়ের সুবিধা
অটোমেটেড সিস্টেম ফর কাস্টমস ডেটার তথ্য বিশ্লেষণ করে আরও কাঁচামালের ওপর অগ্রিম কর কমিয়ে ৩ শতাংশে নামানো যেতে পারে। অগ্রিম কর ফেরত প্রক্রিয়া সহজ করা দরকার, যাতে ব্যবসায়ীরা অযাচিত করভার বহন করতে বাধ্য না হন।
কৃষি খাতে উৎসে কর্তন বিধিমালার সংশোধন
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কৃষিপণ্যের উৎসে কর যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
অগ্রিম আয়করের পক্ষে যে যুক্তি দেওয়া হোক না কেনো, ওই যুক্তি কোনোভাবে কর ন্যায্যতাকে প্রতিষ্ঠা করবে না। বিদ্যমান ব্যবস্থায় ব্যবসায়িরা কর দিতে বাধ্য হচ্ছেন বটে, তবে তাদের মধ্যে কর ফাঁকির প্রবণতা বহুগুণে বাড়ছে। কর ফাঁকিতে নানা অনৈতিক ব্যবস্থার প্রচলণ হচ্ছে, দুর্নীতিকেও উসকে দিচ্ছে।
অন্যদিকে বিদ্যমান এ কর কাঠামো বিশেষভাবে আমদানিকারক, ব্যবসায়ী এবং সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর অযাচিত চাপ সৃষ্টি করছে। উৎসে কর্তন ও অগ্রিম করের ভার ব্যবসায়িক খরচ বাড়াচ্ছে, যার চূড়ান্ত প্রভাব পড়ছে সাধারণ ভোক্তার ওপর।
অর্থশাস্ত্রে চাণক্য (কৌটিল্য) বলেছেন, কর ব্যবস্থা প্রজার জন্য বোঝা যেন না হয়। জনগণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় শাসকবর্গ যেন নম্র থাকে, একইসঙ্গে সতর্ক থাকতে হবে রাজস্ব কাঠামো নিয়ে। সরকারের উচিত কর তেমন করে সংগ্রহ করা যেমন করে মৌমাছি ফুল থেকে ঠিক পরিমাণে মধু চুষে নেয়, যাতে উভয়েই বেঁচে থাকতে পারে।
রাজনৈতিক সরকারগুলো ফি বছর বাজেটের আকার বাড়িয়ে দেখাতে পছন্দ করে। ফলে ফি বছরই এনবিআরের ওপর অতিরিক্ত কর আদায়ের চাপ বাড়ছে। এই অযাচিত বাজেটের আকার বাড়ানোর প্রথা থেকে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে গঠিত সরকার বেরিয়ে আসতে পারে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর সবপর্যায়ে সংস্কারের ব্যাপক জনপ্রত্যাশা আছে। এখনই সময় জনস্বার্থে কর ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার আনা। প্রস্তাবিত সংস্কার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে করজাল সম্প্রসারিত হবে, ব্যবসায়ীক পরিবেশ উন্নত হবে এবং রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক ফলাফল আসবে।
লেখক: স্নেহাশীষ বড়ুয়া, এফসিএ, ডিরেক্টর, এসএমএসি অ্যাডভাইজেরি সার্ভিসেস লিমিটেড