“ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে সাথীরে” … দেখা একবার, কথা বহুবার!

সালটা ২০০০ হবে খুব সম্ভবত। আমি কোনো এক কারণে ঢাকায়। এক সকালে আমাকে নিয়ে নিউমার্কেট গেলেন আমার এক আত্মীয়া। একটি সিডি-ক্যাসেটের দোকানে ঢুকে দোকানিকে 'আমি বাংলায় গান গাই' গানটার সিডি দিতে বলা হলো। দোকানি একটি সিডি বের করে দিলেন।
ওই আত্মীয়া বললেন, 'এটা কী দিলেন?'
দোকানি বললেন, 'আপা, এটাই মূল শিল্পীর সিডি। শুনেন, ভালো লাগবে।'
ওই প্রথম প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের নাম জানলাম। এর আগে তাঁকে চিনতাম না। সিডিটা বাড়িতে এনে যখন প্লে করলাম, একটা নতুন জগৎ যেন খুলে গেল আমার সামনে। বেসরকারি একটি টেলিভিশনে অন্য এক বাংলাদেশি শিল্পীর কণ্ঠে গানটি তখন জনপ্রিয় হলেও মূল গীতিকার, গায়কের কথা বেশিরভাগ লোক জানে না। প্রতুল মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশে তাঁর আগেও পরিচিত ছিলেন, তবে খুব অল্প সংখ্যক মানুষের কাছে।
প্রথমবার শোনার পর আমার মনে হলো, 'বাংলায় গান গাই' এর প্রতিটা লাইন যেন মর্মে পৌঁছে যাচ্ছে। প্রত্যেক উচ্চারণ, গায়কি যেন বলে দিচ্ছে বাংলার প্রতি টানের কথা। বাংলাকে ধারণ না করলে মনে হয় ওটা আসে না।
'ছোকরা চাঁদ/জোয়ান চাঁদা' গানটা যেন নতুন এক দুয়ার খুলে দিল। আমি আর আমার বাবা ওটা লুপে চালিয়ে শুনতাম। বারবার। প্রতিদিন। তখনও জানতাম না কোনো একদিন এই শিল্পীর সঙ্গে আমার দেখা হবে। কথা হবে বহুবার।
২০১৩ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশের তৎকালীন এক প্রেক্ষাপটে একটি গান লিখলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। কলকাতার এক সাংবাদিকের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে কল দিলাম। ইচ্ছা ছিল পাঁচ থেকে ১০ মিনিট কথা বলে একটা সাক্ষাৎকারধর্মী নিউজ লিখব। সেই ১০ মিনিট আর শেষ হলো না। টানা একঘণ্টা কথা হলো। সেই থেকে শুরু। বহুবার কথা হয়েছে তাঁর সাথে। গান, রাজনীতি, ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ সব বিষয় নিয়ে কথা হতো। প্রথম দেখা হলো ২০১৬ সালে নভেম্বর মাসে। তারপর থেকে নিয়মিত যোগাযোগ। আমি মেসেজ দেই, উনি উত্তর দেন। কত প্রশ্ন যে করি! উনি উত্তর দিতে ক্লান্ত বোধ করেন না। ২০২১ পর্যন্ত নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তারপর একটু ভাটা পড়েছিল। তবে টুকটাক মেসেজ আদান-প্রদান চলত। বিশেষ করে যখন তার হৃদযন্ত্র বিগড়ে গেল তখন ফোনে কথা হয়েছে।
'বাংলায় গান গাই' নিয়ে একটা ঘটনা একটু বলতে ইচ্ছে করছে এখানে। একদিন তাঁর সাথে কথা বলতে বলতেই হুট করে মাথায় আসলো, 'বাংলায় গান গাই' সম্পর্কে কিছু জানি না। মনে হতেই প্রশ্ন করলাম। দিলেন উত্তর। প্রতুল মুখোপাধ্যায় জানায়েছিলেন, ১৪০০ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখে গানটি লেখা ও সুরারোপ। ১৪০১ সালের চৈত্র সংক্রান্তিতে প্রথম গানটি প্রচারিত হয়। ধন্যবাদ সেই দোকানিকে, যিনি প্রথম প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
২০১৬ সালে এক কাজে কলকাতা গিয়ে তাঁকে কল দিয়ে আবদার করলাম, দেখা করতে চাই। সাক্ষাৎকার নিতে চাই। ছোট্ট একটা শর্তে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছিলেন। শর্ত ছিল, শুধু গান নিয়ে কথা বলবেন। আমিও সেটাই চাইছিলাম। পরদিন কলেজ স্ট্রিটের কাছে থিওসোফিক্যাল সোসাইটিতে সময় দিলেন। সেখানে তার গান গাওয়ার কথা। নির্ধারিত দিনে একটু আগেই গেলাম। তিনি এলেন। দেখা হলো আমাদের। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। আমার হাতে মুঠোফোনের রেকর্ডার অন করা। আমি ছোট ছোট প্রশ্ন করি। তিনি উত্তর দিচ্ছেন। মনে হচ্ছিল, কোনো শিশু কথা বলছে। কথা ছিল মিনিট পনেরোর মত সময় দেবেন। সেটা আধঘণ্টা পেরিয়ে গেল। এর ফাঁকে একজন ডাকতেও এসেছিলেন। বরিশালের মানুষ প্রতুল মুখোপাধ্যায় তাঁকে বলেছিলেন, 'আর একটু সময় দাও। বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। একটু কথা বলি।'
কথা বলেছিলেন, তার সুর নিয়ে। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া নিয়ে। আজকের সময়ে 'লোকসংগীতের অবক্ষয়' নিয়ে। নিজের গান শেখা নিয়ে বলেছিলেন, 'সবাই আমার গুরু, সবাই আমার শুরু। সবার কাছ থেকে আমি শিখছি। এমনকি নোংরা গান থেকেও শিখি। নোংরা গান যদি হয়, দেখতে হবে সেখান থেকে গ্রহণীয় কী আছে। এই যে নর্দমার জল...ঠিকমতো প্রসেস করলে মাছের খাদ্য পাওয়া যাবে। নর্দমার জল মানেই ফেলে দিতে হবে তা নয়। আমি কখনও কিছু ফেলিনি। সবাই আমার গুরু। যারা রাস্তায় গণসংগীত করে তারাই আমার গুরু শুধু নয়। একদিন শুনি ওয়ান ডাইমেনশন বলে আঠারো বছরের একটা ছোঁড়া নাকি মেয়েদের মাথা ঘুরিয়ে ফেলছে। শুনলাম, কী ব্যাপার দেখি।'
ওই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁকে পাঠিয়েছিলাম। সেদিনও অনেক কথা হয়েছিল। কথার ফাঁকে ফাঁকে গানের প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি দু'কলি গেয়ে উঠতেন। প্রতিবার কলটা রিসিভ করেই একই কথা বলতেন, 'হ্যাঁ, বলুন'। আমিও প্রতিবার নিজের নাম বলতাম। শুনে বলতেন, 'জানি তো, বাংলাদেশ থেকে তো তুমিই কল কর।'
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে একদিন ফেসবুকে এক লাইভে কবীর সুমন বলেছিলেন, 'এ রকম অনুসন্ধিৎসু সুরকার ভারতবর্ষে আর নেই।'
এর কয়েকদিন পরে প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে কল করে কথাটা বলেছিলাম। তিনি খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, 'কবীর সুমনের অনুসারী আছে। আমার নেই। আমার গানগুলো যদি কেউ গায় তবে টিকে থাকবে। তোমরা শুনলেও থাকবে। কবীর সুমন আমাকে অনুসন্ধিৎসু বলেছেন। অথচ ওঁর গানের সুরে কত বৈচিত্র্য! আমার ধাঁচটা তো একটু অন্যরকম।'
সাতচল্লিশের দেশভাগ নিয়ে এক দফায় অনেক কথা হয়েছিল। আমার পরিবারের অভিজ্ঞতা তাঁকে বলেছিলাম। তিনি শুনে গেয়ে উঠেছিলেন, 'দুইজনাই বাঙালি ছিলাম, দেখ দেখি কাণ্ডখান, তুমি এখন বাংলাদেশি আমারে কও ইন্ডিয়ান।' এর পর আর কথা খুঁজে পাইনি সেদিন।
বাংলাদেশে যে কয়বার এসেছিলেন একবারও দেখা হয়নি। সেটা মূলত আমার সমস্যার কারণেই। এ নিয়ে একবার কথাও হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। একটুখানি অভিযোগের সুরে বলেছিলেন, 'খুব তো জ্যেঠু ডাক। এলে না যে?' বলেছিলাম, 'কত মানুষ আপনার চারপাশে থাকে। তারা দেখা করুক। আপনার সাথে কথা তো হয়' বলে বাংলাদেশের শিল্পী কফিল আহমেদের একটা গান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, 'প্রাণে প্রাণ মেলাবই/বলে রাখি'।
সেদিন কফিল আহমেদ নিয়েও কথা হয়েছিল কিছু সময়। বাংলাদেশ থেকে তাঁর একটি গানের অ্যাালবাম বেরিয়েছিল। সে প্রসঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল। তার কিছু পর্যবেক্ষণ আমায় বলেছিলেন। যেগুলো আমি কখনও লিখব না বলে কথা দিয়েছিলাম। কথাটা রেখে চলেছি। ২০১৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে হোয়াটসঅ্যাপে একটু মেসেজ করে লিখেছিলাম, 'আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে/করি বাংলায় হাহাকার…।'
জবাবে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছিলেন, 'উল্লাসের কারণ ফুরিয়ে আসছে দিন দিন।' কথায় কথায় একবার বলেছিলাম, 'আমি বড্ড বেশি প্রশ্ন করে জ্বালাই আপনাকে!' সাথে সাথে হেসে উঠে বলেছিলেন, 'প্রশ্নই তো করো, আর কিছু তো চাওয়ার নেই তোমার। আমারও দেওয়ার নেই।'
যেবার তার হৃদযন্ত্রে গণ্ডগোল হলো সেবার শেষ কথায় বলেছিলাম, 'আরও অনেক দিন আপনাকে চাই।'
বাচ্চাদের মতো হেসে বলেছিলেন, 'আছি এখনও। কখন চলে যাই- কে জানে!'
লেখক: সাংবাদিক, ফুড ব্লগার