ভবিষ্যৎ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রত্যাশা ও নির্বাচন
বাংলায় একটি প্রচলিত কথা আছে। পারিবারিক পর্যায়ে যে কথাটি বারবার ফিরে আসে। পারিবারিক সংঘাতে আমরা অনেক সময় শুনতে পেয়েছি: 'দেখতে এসেছ! দেখে যাও, দেখাতে চেওনা'। সংলাপ হিসেবে চলচ্চিত্ত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে এই বাক্যটি।
বর্তমানে আমাদের নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা জানেন কিনা তা বোঝা যায়নি। নির্বাচন কমিশনারের উদ্যোগে যে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে তাতে এই চিত্রটি ফুটে উঠেছে যে- মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন তাদেরকে তেমন একটি গ্রাহ্য করেন না।
তাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এই নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। বর্তমান নির্বাচন কমিশন এই প্রথম মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যে বৈঠকটি করেছেন তার উদ্দেশ্য ছিল একটি বার্তা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা যে তারা একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চায়।
কিন্তু একজন নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। বিগত নির্বাচন গুলোর অস্থাহীনাতার জন্য সাবেক আমলা নির্বাচন কমিশনার মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উপরই দোষ চাপাতে গিয়েছিলেন। সে কারণে সবাই উপস্থিত মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতিবাদের মুখে তিনি তার বক্তব্য শেষ করতে পারেননি এই হচ্ছে আমাদের নির্বাচন কমিশনারদের অবস্থা। গণমাধ্যম তাই তুলে ধরেছে।
২০১৮ সালের নির্বাচন সম্পর্কে যে কথা প্রচলিত হয়েছে তা হচ্ছে রাতের ভোট আর তার যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে তার সমস্ত দায়ভার মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। বাংলাদেশের জন্ম লগ্ন থেকেই মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সরকারের প্রতি আনুগত্যই হচ্ছে তাদের জীবনের ভবিষ্যৎ। আমরা প্রশাসনের সর্বস্তরে তাই দেখতে পাচ্ছি।
আমরা দেখতে পাচ্ছি একের পর এক প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ইতিহাস । আমরা জানি না দেশে এই মুহূর্তে কতজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আছে। স্বাধীন বাংলাদেশে যখন সরকারি কর্মকর্তার অভাব দেখা দিয়েছিল তখন ১৯৭৪ সালের সরকারি কর্মচারী অবসর আইনের আওতায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকার ।
যে কাউকে সেই আইনের আওতায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার যে বিধান চালু হয়েছে তা আজও একইভাবে টিকে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫ বছরের কর্মজীবন শেষ করার পরেও উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন নতুন করে। সুতরাং এমন ধরনের কর্মকর্তাদের সমাহারেই চলছে এই দেশ।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রধান কর্তা হচ্ছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সুতরাং ভবিষ্যত নিয়োগ প্রত্যাশীরার সরকারের সঙ্গে সবসময় একটি সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলতে চায়। এই কর্মকর্তারা জানেন যে তারা নির্বাচন কমিশনের কাছে দায়বদ্ধ নয়। কোনো কারণে নির্বাচন কমিশন চাইলেই তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে কখনোই পারবে না। নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পরে নির্বাচন কমিশনারের কাছে সরাসরি প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করার কোন আইন দেশে বর্তমানে নাই। অর্থাৎ নির্বাচনী এলাকার পুলিশ কিংবা প্রশাসন কেউই তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নয় ।
মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সে পুলিশ কিংবা প্রশাসন যেই হোক না কেন, নির্বাচনের দায়িত্ব পালনে অবহেলা প্রমাণিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নাই। অতীতের ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই যে এরকমের কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধপত্র পাঠানোর পরেও সেই প্রশাসন সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
নির্বাচন কমিশন যদি তার সক্ষমতা প্রমাণ করতে চায় তাহলে প্রশাসনের উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভারতের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে। ভারতের নির্বাচন ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র ব্যবস্থার ফলে একক কোনো দিনে ভারতে সংসদ নির্বাচন হয় না। দেশটির লোকসভার নির্বাচন হয় দীর্ঘ সময় নিয়ে।
বহু পর্যায়ে, অর্থাৎ সাত থেকে আট পর্যায়ের নির্বাচন হয়। এই নির্বাচন পরিচালনা করার সময় প্রশাসনিক মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে নির্বাচন কমিশনের উপর। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশের বাইরে তাদের পক্ষে কোনো কিছুই করা সম্ভব হয় না। ভারতের নির্বাচন কমিশনের তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করার সক্ষমতা আছে ফলে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নির্বাচনী আচরণবিধির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন ধরনের ঢিলেমি সচরাচর করেন না।
তবে আমাদের মাঠ প্রশাসন যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক পদ সেই পদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি কোন ভুল মন্তব্য করেন তবুও তার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া যেভাবে ব্যক্ত হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে তা সঠিক নয় তা বলা যায়। তারপরেও সারাদেশের সকল মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ডেকে এনে তাদের মাধ্যমে ভোট কেন্দ্র কমানোর সুপারিশ গ্রহণ, ইভিএম মেশিন এর প্রচারণা চালানোর বিষয় কতটুকু নির্বাচনী পরিবেশের সহায়ক হচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারছি না।
দেশের বর্তমান পার্লামেন্টের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি নির্বাচন কমিশনের ইভিএম এর বিষয়ে সরাসরি মত ব্যক্ত করেছেন । তারপরেও নির্বাচন কমিশন যে উদ্যোগ নিচ্ছেন ইভিএম ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য তা আগামী নির্বাচন সর্বদলীয় নির্বাচনের রূপান্তরিত করা কতটা বাস্তবসম্মত সে প্রশ্ন সামনে আসে।
কয়েকদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আগামী ২০২৩ সন বিশ্বব্যাপী এক মন্দার সম্ভাবনার কথা.। সেই মন্দা চলাকালীন সময়েই আগামী নির্বাচন। মন্দায় সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায় সেদিকে নির্বাচন কমিশনকে লক্ষ্য রাখতে হবে। নির্বাচনটি যেন সার্বজনীন হয় । মন্দার কারণে সামাজিক অস্থিরতা যেন নির্বাচনকে প্রভাবিত না করে। সে বিষয়টা মাথায় রাখে মাঠ গরম করা, রাস্তায় অস্থিরতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে যারা রাজনৈতিক আন্দোলন করছেন তাদেরকে যেন কোন সুযোগ করে দেওয়া না হয় ।
নির্বাচন কমিশনকে মনে রাখতে হবে এদেশে একবার মাত্র স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা ছিল ২০০১ এর নির্বাচন। যে নির্বাচনকে নিয়ে নির্বাচন উত্তর কালে ভিন্নমতের সৃষ্টি হয়েছিল। বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গৃহীত কিছু পদক্ষেপ বিতর্কিত হয়েছে। সম্ভবত তারই পরিণতি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়া।
নয়তো যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আওয়ামী লীগ দীর্ঘ আন্দোলন করেছে ১৯৯৫ সাল থেকে শুরু করে ৯৬ সালের ১৩ সংশোধনীর আগ পর্যন্ত, সেই আওয়ামী লীগই রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সংশোধনী পাস করেছিল।
সংবিধানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আওয়ামী লীগের দাবির প্রেক্ষিতেই ঘটেছিল ১৩ তম সংশোধনী আর সেই একই সংশোধনী বাতিল করেছে আওয়ামী লীগ ১৫ তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদে। যে দুটি সংশোধনীর বিষয় হচ্ছে নির্বাচন সংক্রান্ত জটিলতা । একটি স্বাধীন, সক্ষম নির্বাচন কমিশনের একটি সার্থক নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে না পারার ফসল এ দুটি।
বিচারপতি রউফ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে ১৯৯১ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের একটি পক্ষ সেই নির্বাচন নিয়ে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে তারা প্রশাসনের কাছ থেকে স্বাভাবিক আচরণ পায়নি। সেই সময়ের নির্বাচনে এই অভিযোগ এরশাদের দল করেছিল যা অনেকটাই সত্য।
এরশাদের রাজনৈতিক দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকেই কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছিল বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে। তাদেরকে কারাগার থেকে জামিন দেওয়া হয়নি নির্বাচনকালীন সময়ে। এমনকি দীর্ঘদিন এরশাদ নিজেও আটক ছিলেন। বিএনপির সেই সরকারের আমলে।
বিএনপি সরকারের আমলের সেই রউফ নির্বাচন কমিশন ও বিতর্কিত হয়েছিল নানাভাবে। বিশেষ করে ১৯৯৪ সনের মাগুরা নির্বাচন। যার পরিণতিতে দেশে চরম রাজনৈতিক বিভাজন সংঘটিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে সামনে নিয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটি সঠিকভাবে বেরিয়ে আসে, একটি সক্ষম কার্যকর নির্বাচন কমিশনের অনুপস্থিতিতেই দেশ বারে বারে রাজনৈতিকভাবে বিভাজন হচ্ছে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিয়ে নানান আশাবাদের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, কারণ এই নির্বাচন কমিশন গঠন করার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দলের একটি মতামত গ্রহণ করা হয়েছিল, যদিও তা কোন আইনি কাঠামোর আওতায় নয়। তারপরেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত গ্রহণ করার ভেতর থেকে যে কমিশন গঠন করা হয়েছে তা মূলত সব অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দিয়ে। আর প্রধান নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষটিও তাই।
