স্বপ্নের অভিবাসন নাকি মানব পাচার?

"কোম্পানিতে কাজ দেওয়ার কথা বলে আমাকে মালয়েশিয়াতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আমার সমস্ত কাগজপত্র কেড়ে নিয়ে জোরপূর্বক জঙ্গলে ঝুকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য করা হয়। বেতন চাইলেই বলত, 'অনেক টাকা দিয়ে তোকে কিনে আনা হয়েছে,' খাবার চাইলেই প্রচণ্ড মারধর করত"- এভাবেই মালয়েশিয়ায় থাকাকালীন বিভীষিকাময় সময়গুলোর কথা বর্ণনা করছিলেন মানব পাচারের একজন ভিকটিম। এ নিয়ে কাজ করার সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন মানব পাচার প্রবণ জেলায় ঝুঁকিতে থাকা এবং পাচারের শিকার এমন অনেকের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা শোনার সুযোগ হয়েছে।
যে মানুষগুলোর হাড়ভাঙা পরিশ্রম এবং প্রাণের বিনিময়ে দেশে আসছে বৈদেশিক মুদ্রা, ঘটছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি, সেই মানুষগুলোর সাথে ঘটে যাওয়া ঘৃণ্য অপরাধের প্রতিরোধে কতটুক সোচ্চার আমরা? আমাদের সমাজের মানুষের মধ্যে কতটা সচেতনতা আছে মানব পাচার প্রতিরোধ সম্পর্কে? বৈধভাবে বিদেশ যাবার তথ্যগুলো কতটুক পৌঁছে দিতে পারছি পাচারের ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোর কাছে? কতটুক জানি আমরা মানব পাচারের শাস্তির বিধান সম্পর্কে?
আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের অন্যতম শ্রমিক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আজ স্বীকৃত। দক্ষ, স্বল্পদক্ষ ও অদক্ষ জনশক্তি রপ্তানি কেবল জাতীয় আয়কেই বৃদ্ধি করেনি, ব্যক্তি ও পরিবারের সার্বিক উন্নতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। পাশাপাশি জবরদস্তিমূলক শ্রম এবং যৌনকর্মের উদ্দেশ্যে পাচারকৃত নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য বাংলাদেশ একটি উৎস-রাষ্ট্র হিসেবেও বেশ পরিচিত।
অভিবাসনের উদ্দেশ্যে বিদেশে যেতে চেয়ে দালালের হাতে সর্বস্ব হারানো বা প্রতারিত হওয়ার কাহিনি নতুন নয় আমাদের কাছে। অথচ ২০১২ সালের আগে বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে কোনো ধরনের মানব পাচার দমনের কোনো যথাযথ ব্যবস্থা ছিল না। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সব মানুষের পাচার এবং সব ধরনের শোষণকে অন্তর্ভুক্ত করে মানব পাচারের একটি বিস্তৃত সংজ্ঞার অভাব ছিল এবং মানব পাচার বিরোধী আইনি কাঠামো ছিল খুব দুর্বল।
এ অবস্থার প্রেক্ষিতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগের ফলে ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে 'মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২' কার্যকর হয়। এছাড়াও মানব পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৮- ২০২২ প্রণয়নের মাধ্যমে মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটির একটি অত্যন্ত কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে। যেখানে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটি (সিটিসি) গঠন করতে বলা হয়েছে।
কিছু কিছু জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে সিটিসি গঠন করা হলেও অধিকাংশ ইউনিয়নের মেম্বার-চেয়ারম্যান এই কমিটির নামই শোনেননি কখনো। উপরন্তু তারা এই কমিটির প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন না। কোথাও দেখা যায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অস্বীকার করছেন তার এলাকার মানব পাচারের ঘটনার কথা; ভাবখানা এমন যে, স্বীকার করলেই তো ঘাড়ে দায়িত্ব এসে পড়তে পারে!
বর্তমান করোনা দুর্যোগের সময় কয়েক লাখ প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন সঠিক এবং নানাবিধ জটিলতায় হাজারও অভিবাসী প্রার্থীর জীবিকা হয়েছে ব্যাহত। দেশে আগতদের মধ্যে কেউ এসেছেন মহামারির ভয়ে, কেউ এসেছেন চাকরি হারিয়ে, আবার কাউকে কাউকে জোরপূর্বক দেশে ফিরে আসতে বাধ্য করা হয়েছে। ২০২০ সালে ব্র্যাকের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে ফিরে আসা প্রবাসী কর্মীদের ৮৭ শতাংশের কোনো আয়ের উৎস না থাকায় কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দিন পার করছেন এবং ৫২ শতাংশ বলেছেন তাদের জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা দরকার। এছাড়াও গত এপ্রিল-জুন মাসে দেশে দারিদ্র্য হার বেড়ে গিয়েছে বলে অনেক বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে করোনাকালীন সময়ে দেশে দারিদ্র্য বৃদ্ধির হার নিরূপণ করে কোনো জরিপ প্রকাশিত হয়নি।
অবশ্য বাংলাদেশ সরকার ২০২০ সালে ৭০০ কোটি টাকার দুটি ফান্ড ঘোষণা করেছিল বিদেশ ফেরত প্রবাসী কর্মীদের সহজ শর্তে বিভিন্ন ধরনের লোন প্রদান করার জন্য; কিন্তু প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের জনবলের অভাব, প্রচারণার অভাব এবং লোন পাওয়ার ক্ষেত্রে নানাবিধ জটিলতার কারণে ২০২১ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত মাত্র ৪,৮৭৯ জন প্রবাসী লোন পেয়েছেন।
এই হিসেব আপাতত থাক। কিন্তু এই দীর্ঘ বেকারত্বকে কাজে লাগিয়ে দালাল চক্র হয়েছে সোচ্চার, ভূমধ্যসাগরে সাম্প্রতিক ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে। মানব পাচার প্রতিরোধে এই দালাল চক্রকে সবার আগে নির্মূল করা আবশ্যক। যদিও সরকার এই লক্ষ্যে কাজ করছে, 'আমি প্রবাসী' অ্যাপ তারই উদাহরণ। পাশাপাশি সিটিসির সহায়তায় প্রতিটি ইউনিয়নে অভিবাসন প্রত্যাশী এবং দেশে ফিরে আসা প্রবাসী কর্মীদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করা যেতে পারে এবং এই ডাটাবেজ ধরে তাদের সাথে বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার ধাপগুলো সম্পর্কে আলোচনা, মানব পাচারের পরিণতি এবং সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের সেবার আওতায় আনা যেতে পারে।
এছাড়াও এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন ধরনের বিকল্প শ্রম বাজার সন্ধান করতে হবে। বিকল্প শ্রম বাজারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কৃষি ও স্বাস্থ্য খাত। বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ এবং শাকসবজি উৎপাদনে পঞ্চম। কৃষি ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে করোনা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশে কৃষি শ্রমিক পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক আলোচনা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।
পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাত একটি সম্ভাব্য শ্রম বাজার হতে পারে বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য; কেননা করোনা মহামারি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের নাজুকতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে প্রতিটি দেশ স্বাস্থ্য খাতের এই ভঙ্গুরতা কমিয়ে আনার জন্য কাজ করবে এবং ব্যাপক বিনিয়োগ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমরা যদি বাংলাদেশের বিপুল জনশক্তিকে স্বাস্থ্য সেবায় দক্ষ করে তুলতে পারি, তবে আশা করা যায় বিকল্প শ্রম বাজার থেকে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব।
বিদেশগামী শ্রমিককে দক্ষ করে তোলার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। গতানুগতিক প্রশিক্ষণের বাইরে এসে বিকল্প প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে; তবেই আমরা প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলতে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের চাকা সচল রাখতে পারব।
এতকিছুর পরও আশার বাণী এই যে, সম্প্রতি ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট বার্ষিক ট্রাফিকিং ইন পারসন্স রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এবং তাদের র্যাংকিং অনুযায়ী বাংলাদেশ টিয়ার টু'তে রয়েছে। পাশাপাশি এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মানব পাচার প্রতিরোধের স্ট্যান্ডার্ড পুরোপুরি পূরণ করে না; তবে সম্প্রতি সময়ে পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়েছ।
সর্বোপরি, একটাই প্রত্যাশা, আর যেন কোনো লিবিয়া ট্রাজেডির দুঃখগাথা শুনতে না হয় আমাদের। একটু ভালো থাকার স্বপ্ন দেখে বিদেশ গিয়ে আর যেন কাউকে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে না হয়, সর্বস্ব হারিয়ে কোনো পরিবারকে আর যেন পথে বসতে না হয়। সকল অভিবাসী কর্মীর অভিবাসন হোক নিরাপদ, সফল, সুন্দর এবং দেশের জন্য বয়ে আনুক সমৃদ্ধি।
-
লেখক: উন্নয়নকর্মী