চীনের তালেবান সমর্থন, আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কোনদিকে?

আফগান তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পর বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের পদচারণা আরও গভীরতা লাভ করলো। চলমান অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যেই চীন দেশটির অনির্ধারিত সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। আফগানের সরকার কাঠামো এখনো পরিষ্কার নয়। কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দেশটি পরিচালিত হবে তা বিশ্ব এখনো অস্পষ্ট। যদিও গতকাল প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তালেবান নেতা জাবিউল্লাহ মুজাহিদ একটা আপত মধ্যপন্থার ইঙ্গিত দিয়ে সকলকে 'ক্ষমা' করে কাজে যোগ দেওয়ার কথা বলেছেন। আফগান ভূমি সন্ত্রাসী কাজে কাউকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না, হিজাব ব্যবহার করে নারীরা কাজ এবং পড়াশুনা করতে পারবে এবং দেশ পরিচালিত হবে ইসলামি মূ্ল্যবোধে। ক্ষমতা দখলের পর থেকে বিশ্বের কাছে যে উত্তেজনা ছড়াচ্ছিল চীনের তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি বিশ্ব জনমনে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করেছে।
১৯৯৬ সালে তালেবান নেতা মোল্লা ওমর যখন ক্ষমতা দখল করেন তখন চীনের অর্থনীতি বিশ্বরাজনীতির কোনো অংশ নয়। চীনের সক্ষমতা আজকের থেকে বহুগুণ পিছনে। আজকে চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রায় সাড়ে ১৪ ট্রিলিয়ন ডলারের। বাৎসরিক উৎপাদন ব্যবস্থার হিসেবে '৯৬ সালে ছিল চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ছিল ১ ট্রিলিয়ন ডলারের নিচে। গত ২৫ বছরে চীন যে সক্ষমতা অর্জন করেছে তা প্রায় বিশ্বের সকল দেশের জন্য একটি ঈর্ষনীয় ঘটনা। চীনের সঙ্গে তালেবানদের যে একটি গোপন যোগাযোগ দীর্ঘকাল যাবত চলছিল তা প্রমাণ হয় চীনের এই স্বীকৃতি প্রদানে। চীন ক্রমান্বয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরাজিত করে চলছে। তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া চীনের আগামী দিনের ভূরাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়লো।
যে সরকার সেখানে প্রতিষ্ঠা হলো তাদের অতীত অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। অতীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন সরকার নারীর প্রতি চরম সহিংসতা দেখিয়েছে। নারীদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, বোরকা ব্যবহারে বাধ্য করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নারীদের বের করে দেওয়ার ঘটনার কথা সকলে জানে। মোল্লা ওমরের সময়ে নারীদের বাইরের কাজে যুক্ত হওয়ার অনুমোদন ছিল না। ফলে নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার ও স্বাধীনতা বলতে কিছু ছিল না। কোন পুরুষ সাথে না থাকলে নারী কোথাও ভ্রমণ আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়। বিশ্বজনমত আজও তা ভোলেনি।
২৩ এপ্রিল ২০১৩ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমর নিহত হন। মোল্লা ওমরের ছেলে মোল্লা ইয়াকুব বর্তমান তালেবানের উপপ্রধান। সামরিক শাখার প্রধান ইয়াকুব তালেবানদের মধ্যে প্রভাবশালী। ৩০ বছর বয়সী ইয়াকুবের প্রভাব তার বাবার কারণে না কি তার নিজের অর্জন তা স্পষ্ট নয়। তালেবানদের মধ্যেও অনেক ধারা ও পন্থা রয়েছে। মোল্লা ওমরের ছেলে মোল্লা ইয়াকুব বাবার মত কট্টরপন্থী হলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে বাধ্য। ইতোমধ্যে দেশে ফিরেছেন তালেবানের সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার।
বারাদার তালেবানের উপপ্রধান এবং রাজনৈতিক শাখার প্রধান। বিভিন্ন দেশের সমর্থন নেওয়া, মার্কিনের সাথে দুবাই চুক্তি এবং গতমাসে চীন সফর এবং চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সাথে বৈঠক করে আফগানিস্তানে চীনা সমর্থন নিশ্চিত করেন, যেটা তালেবানদের জন্য বিরাট সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ঐ একই বৈঠকে বারাদার চীনের অভ্যন্তরে উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের আন্দোলন চীনের 'অভ্যন্তরীণ বিষয়' এবং ঐ আন্দোলনের সাথে তালেবানের কোনো 'সম্পর্ক' থাকবে না, অঙ্গীকার করেছেন। ১০ বছরের নির্বাসন জীবন কাটিয়ে গতকাল কাবুল পৌঁছানোর খবর দিয়েছেন তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ। যদিও মোল্লা ওমরের ছেলে মোল্লা ইয়াকুবের সাথে মোল্লা বারাদারের সম্পর্ক ততটা গভীর নয়। ফলে আফগান কট্টর না মধ্যম পথে চলবে তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে চীন তার নিজের প্রয়োজনেই আফগানকে কট্টরপন্থা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইবে তা সহজে অনুমান করা যায়। চীন নিজ ভূখণ্ডে মৌলবাদী সংকট বিরাজমান।
যে শরিয়া আইনের ব্যাখ্যায় মোল্লা ওমরের সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত ছিল তা আজকের তালেবানরা কতটুকু পরিবর্তন করে করতে পারে তা দেখার বিষয়। মুসলিম বিশ্বে শরিয়া আইন নিয়ে বিভক্তি রয়েছে। শরিয়া আইনের ব্যাখ্যা একেক গোষ্ঠি একেক ভাবে দিয়েছে। একটির সাথে অন্যটির বিস্তর ফারাক। আফগান তালেবানদের মধ্যেও অনেক গোষ্ঠি বা সম্প্রদায় রয়েছে যাদের শরিয়া আইন ব্যাখ্যায় বড় ধরনের ভিন্নতা রয়েছে। নারীর অধিকার ও স্বাধীকারে প্রশ্নেও মতভেদ রয়েছে। এখন বিশ্বের মনোযোগ অনেকটা এখানে। যদিও ইতোমধ্যে দু-একটি আশার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। টেলিভিশনে নারীর উপস্থিতি দেখতে পাওয়া গেছে। এটা হয়তো নারীর প্রতি তাদের যে কমিটমেন্ট সেটি রক্ষা করার পদক্ষেপ।
ইতোমধ্যে কাতারপ্রবাসী তালেবান নেত্রী ঘোষণা করেছেন, নারীদের কেবলমাত্র হিজাব পরলেই চলবে। হিজাব এখন মুসলিম দেশগুলোতে অধিকাংশ নারীদের ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। হিজাবের প্রচলন আমাদের দেশেও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের নারীর অগ্রগমণ বিশ্বের দৃষ্টি কাড়লেও নারী প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও সম অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে লড়তে হচ্ছে।
আফগানিস্তানে অবস্থানকারী অন্তত দুইজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ও সেই সময়কার উচ্চ পদস্থদের সাথে তালোবানরা যোগাযোগ ও মতামত নিচ্ছে সরকার গঠনের প্রক্কালে।তালেবানরা প্রথম দিনেই সর্বস্তরে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। বিশ্বের অন্য দেশের সাথেও বন্ধুত্বের কথা বলেছে। সর্বপরি আফগান সমাজের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটালো। গতকালের সংবাদ সম্মেলন করে তালেবানরা বিশ্বের কাছে অনেক নুতন বার্তা দিলো। ১৯৯৬ এর তালেবানের সাথে বর্তমানের তফাৎটা অনেক জায়গায় স্পষ্ট।
আফগানের বর্তমান পরিবর্তনে ভারত সবচেয়ে বেশি বেকায়দায়। আফগান হাত ছাড়া হওয়ার চাইতে বেশি মাথা ব্যাথার কারণ আফগানের এই পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও পাকিস্তান। ১৫ আগস্ট চূড়ান্তভাবে কাবুল দখলের আগে এক তালেবান মুখপাত্র ভারতকে কোন রকম উষ্কানি না দিতে হুশিয়ারি দিয়েছিল। ভারত তার জবাব দেয় নি বরং গতকাল সরকারি- বেসরকারি ভারতীয় নাগরিকদের ফেরত এনে বলেছে, এ কাজে তারা কোন বাধার সম্মুখীন হয়নি। এই কথা আফগানের সাথে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিত। একই সঙ্গে আফগান থেকে হিন্দু কেউ আসতে চাইলে ভারত তাদের নাগরিকত্ব দেবার পূর্বের সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করেছে। অন্যদিকে বেকায়দায় থাকা বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তান মানুষের অধিকার ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কাজ করলে 'যুক্তরাষ্ট্র পাশে থাকবে' বলার একদিন পরেই তালেবান মুখপাত্র, "সন্ত্রাসী কাজে আফগানের ভূখণ্ড কাউকে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না" বলে সংবাদ সম্মেলন, খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোন দিকে আফগান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তা এই মুহূর্তে সঠিক বলা যাবে না। কিন্তু এটি বলা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র রপ্তানি বাণিজ্য ছিল আফগান সরকার সঙ্গে। বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর একটি রপ্তানি বাজার ছিল আফগানিস্তানে। চীনের অনুপ্রবেশের ফলে কিংবা চীনের আফগান সম্পর্কের ফলে বাংলাদেশে সেই ঔষধ বাজার ধরে রাখতে পারবে কিনা সেটিও একটি প্রশ্নের বিষয়। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই নতুন সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত পরিষ্কার হওয়া যাচ্ছে না যে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কোন দিকে।