ফ্রাঁসোয়াজ জিলো পিকাসোর ছায়াসঙ্গী, চিত্রশিল্পী ১০১ বছর বয়সে মারা গেলেন

ফরাসি চিত্রশিল্পী, সমালোচক ও লেখক ফ্রাঁসোয়াজ জিলো মারা গেছেন। মঙ্গলবার (৬ জুন) ১০১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। নিজের চেয়ে বয়সে অনেক বড়, স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়ানোর পর তাকে নিয়ে অনেক আলোচনা ও লেখালেখি হলেও, তার আসল শিল্পী প্রতিভা এই সম্পর্কের আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছিল।
গতকাল ম্যানহাটন হাসপাতালে জিলোর মারা যাওয়ার খবর দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে নিশ্চিত করেছেন তার মেয়ে অরেলিয়া অনজেল। তিনি জানিয়েছেন, তার মা হার্ট ও ফুসফুসের অসুখে ভুগছিলেন।
প্যারিসের একটি স্বচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করা ফ্রাঁসোয়াজ জিলোর সঙ্গে পাবলো পিকাসোর দেখা হওয়ার সময়ই তিনি ইতোমধ্যেই একজন প্রতিষ্ঠিত চিত্রশিল্পী ছিলেন। ফ্রান্সের একটি রেস্টুরেন্টে পিকাসোর সাথে তার দেখা হয় ১৯৪৩ সালে। সেসময় জিলোর বয়স ছিল ২১ এবং পিকাসোর ৬১।

খুব দ্রুতই তাঁদের মধ্যে একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি হয়, যার স্থায়িত্ব ছিল দশ বছরের বেশি। ১৯৫৩ সালে তার সঙ্গে পিকাসোর বিচ্ছেদ ঘটে। জিলোই ছিলেন পিকাসোর একাধিক মিসট্রেসদের মধ্যে একমাত্র নারী যিনি নিজেই পিকাসোকে ছেড়ে এসেছিলেন। পিকাসোর সঙ্গে দশ বছরের সংসারে তাদের দুই সন্তান রয়েছে।
স্প্যানিশ চিত্রশিল্পীকে ছেড়ে আসার সময় জিলো তাকে বলেছিলেন, "তোমার মনে হয় মানুষ তোমার প্রতি আগ্রহী হবে? না, তারা হবে না, আর সেটার কারণও তুমিই। যদিও তোমার মনে হয় যে লোকে তোমাকে পছন্দ করে, কিন্তু সেটা হবে এই কারণে যে তোমার মতো একজন ব্যক্তি আমার জীবনকে এত অন্তরঙ্গভাবে ছুঁয়ে গেছে।"

কিন্তু যে সম্পর্কের ছায়ায় তার ক্যারিয়ার ঢেকে গিয়েছিল এবং তাকে শিল্পী নয়, বরং সোশ্যাল সেলিব্রেটিতে পরিণত করেছিল; বিচ্ছেদের পর সেই ক্যারিয়ার আবারও দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন জিলো।
কিন্তু তার চলার পথেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পিকাসো। তিনি গ্যালারিগুলোকে চাপ দিয়েছিলেন যেন জিলোর শিল্পকর্ম প্রদর্শন না করা হয়। কিন্তু তবুও জিলো তার কাজ প্রদর্শন করে গেছেন, যেগুলো এখন নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট ও মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট এবং প্যারিসের সেন্টার পম্পিদ্যুসহ বিশ্বের ডজনখানেক জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। সেইসঙ্গে জিলো তার চিত্রকর্ম বিক্রিও করেছেন। ১৯৬৫ সালে জিলো তার মেয়ের একটি পোর্ট্রেট আঁকেন; 'পালোমা আ লা গিতা' শিরোনামের এই ছবিটি ২০২১ সালে অনলাইনের একটি নিলামে ১.৩ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।

পিকাসোর সঙ্গে এক দশকের সম্পর্ক নিয়ে ১৯৬৪ সালে 'লাইফ উইথ পিকাসো' প্রকাশ করেন ফ্রঁসোয়াজ জিলো। এই বইটি আন্তর্জাতিক বেস্ট সেলার বা সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের খেতাব পায়। পিকাসো জিলোর এই বইটি প্রকাশে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। জিলোর লেখা এই স্মৃতিকথা পিকাসোকে এতটাই ক্ষুদ্ধ করেছিল যে তিনি জিলো ও তাদের দুই সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ করে দেন।
উল্লেখ্য যে, মার্চেন্ট আইভরির পরিচালনায় এবং অ্যান্থনি হপকিনস অভিনীত ১৯৬৬ সালের চলচ্চিত্র 'সারভাইভিং পিকাসো' নির্মিত হয়েছিল জিলোর বই অবলম্বনে।
১৯৫৫ সালে লুক সিমনকে বিয়ে করেন জিলো এবং এই সংসারে তার মেয়ে অরেলিয়ার জন্ম হয়। ১৯৬২ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায় এবং ১৯৭০ সালে মেডিক্যাল গবেষক জোনাস সল্ককে বিয়ে করেন জিলো। জোনাস বিশ্বের প্রথম সফল পোলিও ভ্যাকসিন আবিষ্কারের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন।

জিলো ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোলা ও দক্ষিণ ফ্রান্সে নিজের স্টুডিও, দুই জায়গাতেই যাতায়াত করতেন। ১৯৭৫ সালে জিলো 'ইন্টারফেস: দ্য পেইন্টার অ্যান্ড দ্য মাস্ক' নামে আরও একটি স্মৃতিকথা প্রকাশ করেন। পরের বছর তিনি সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের চেয়ারওম্যান হন এবং ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত এই পদে ছিলেন।

১৯৫৫ সালে সল্কের মৃত্যুর পর জিলো আপার ওয়েস্ট সাইড ম্যানহাটনে চলে আসেন এবং ছবি আঁকার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ২০১৮ সালে ৯৬ বছর বয়সে জিলো একটি বই প্রকাশ করেন যেখানে ছিল ১৯৭৪ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তার ভারত, সেনেগাল ও ভেনিস ভ্রমণের সময়কার বিভিন্ন স্কেচ।
অরেলিয়া অনজেল ছাড়াও ফ্রাঁসোয়াজ জিলো মৃত্যুর সময় ক্লদ পিকাসো ও পালোমা নামে আরও দুই সন্তান এবং চার নাতি-নাতনি রেখে গেছেন।