সফলতার পথ দেখাচ্ছে স্টার সিনেপ্লেক্স

দর্শক এবং ভালো চলচ্চিত্রের অভাবে দেশের সিনেমা হলগুলো যখন এক এক করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তখন একটা একটা করে বাড়ছে মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল।
রাজধানীর বসুন্ধরা সিটিতে দুই দশক আগে তিনটি হল দিয়ে চালু হয়েছিল স্টার সিনেপ্লেক্স। গত ১৫ বছরে ভালো ব্যবসার সুবাদে এটা বেড়ে এখন ১২টি হলে সিনেমা দেখাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে এর সংখ্যা বেড়ে ১০০ হবে বলে জানিয়েছেন স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান রুহেল।
তিনি বলেন, “সিনেপ্লেক্সের এই বিস্তারের অর্থ আসলে সিনেমার দর্শক কমেনি; দর্শকদের রুচি পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। দর্শক এখনো সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন। একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হওয়ার পেছনে মূল কারণ, পুরানো সিনেমা হলগুলো তাল মেলাতে না পারা। আর বাংলাদেশের সিনেমা নির্মাতারা পরিবর্তনকে গ্রহণ করে নতুন ধরনের সিনেমা বানাতে ব্যর্থ হবার ফলে গতানুগতিক হলগুলো চলছে না।”
শুরুতে বিনিয়োগ ছিল আড়াই কোটি। মাত্র ১৫ বছরে এই প্রতিষ্ঠানের পেছনে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। এমন তথ্যই জানালেন, স্টার সিনেপ্লেক্সের চেয়ারম্যান। সম্প্রতি চালু হওয়া মহাখালীর নতুন শাখার লবিতে বসে কথা হয়ে তার সঙ্গে। তিনি প্রতিষ্ঠানটি শুরু করার আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করছেন।
সিনেপ্লেক্সের চিন্তা সম্পর্কে তিনি জানান, ১৬ বছর বয়স তখন থেকেই আমেরিকায় থেকেছেন রুহেল। একটানা ১২ বছর কাটিয়েছেন সেখানে। ওখানে প্রতি সপ্তাহের শেষে তারা বন্ধুরা মিলে মাল্টিপ্লেক্সে ছবি দেখেতে যেতেন। সেখানেই দেখেন একটা লোকেশনে তিন-চারটা সিনেমা হল এবং একসঙ্গে হলগুলোতে সিনেমা চলছে। দর্শকেরা পছন্দ মতো সিনেমার টিকিট কেটে হলে ঢুকে যান। রুহেলও তাই করতেন। একই সঙ্গে এসব মাল্টিপ্লেক্সে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল। তাই রথ দেখা কলা বেচার মতো সিনেমা দেখা শেষে খাওয়া দাওয়া করে ফিরতেন। ওই সময় থেকেই আসলে স্বপ্নের শুরু।

কেন সিনেপ্লেক্স সফল
সারা পৃথিবীতে সিঙ্গেল স্ত্রিন বা সিনেমা হলের ধারণা বদলে যায় গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে। পুরো পৃথিবীতেই বিনোদনের জন্য বদলাতে থাকে সিনেমা হলগুলো। এক ছাদের নিচে একাধিক সিনেমা হল বা স্ক্রিন নিয়ে শুরু হয় মাল্টিপ্লেক্স কনসেপ্ট। খোদ দিল্লিতে ১৯৯৭ সালে চালু হয় পিভিআর নামের একটি মাল্টিপ্লেক্স। একসঙ্গে চারটা স্ক্রিন নিয়ে শুরু হয় এটি। তারপর থেকে ক্রমান্বয়ে শাখা বাড়াতে থাকেন তারা। পুরো পৃথিবী জুড়েই এক স্ক্রিনের সিনেমা হলগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছিল, তখন একসঙ্গে একাধিক স্ক্রিনের মাল্টিপ্লেক্স সফল হয়ে যায়। যেটা ছড়িয়ে পড়ে পড়ে পৃথিবীজুড়েই।
পছন্দ মতো হলে ঢুকে সিনেমা দেখা, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুই মেলে এক হলেই। সিনেমা দেখার ঝকঝকে বড় পর্দা, সাউন্ড, আসন এমনকি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সবকিছুই সিনেমার জন্য সহায়ক বলে মনে করেন সবাই। একই সঙ্গে দেশি-বিদেশি চলচ্চিত্র থেকে পছন্দের চলচ্চিত্র বেছে নেওয়ার সুযোগ। সব মিলিয়ে দর্শকের কাছে মাল্টিপ্লেক্স জায়গা করে নিয়েছে।
দেশে সিনেপ্লেক্সের শুরু
উন্নত দেশগুলোতে আগেভাগে শুরু হলেও এ দেশে মাল্টিপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে ২০০৪ সালে। স্টার সিনেপ্লেক্স নামে নতুন এই প্রতিষ্ঠানটি শুরুতে তিনটি স্ক্রিনের মাধ্যমে দর্শ্কদের সিনেমা দেখানো শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান রুহেল শোনান শুরুর গল্প।
ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ও কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৯৯ সালে দেশে ফিরে বেইজ লিমিটেড নামে একটি আইটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন তিনি। অফিস নেন পান্থপথে।
তিনি জানান, আমেরিকায় পড়াশোনার সময় তিনি নিয়মিত বন্ধুদের সঙ্গে মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখেছেন। অভ্যাস রয়ে গেছে কিন্তু দেশে সিনেমা হলে যাওয়ার পরিবেশ নেই। একই সঙ্গে নেই ভালো সিনেমাও। তাই বিনোদন না খুঁজে ব্যবসায় মনোযোগ দেন তিনি।

এদিকে, পান্থপথে একই ভবনে বসুন্ধরারও একটা অফিস ছিল। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায়ই কথা হতো। তখনই জানতে পারেন বসুন্ধরা সিটির কাজ হচ্ছে। ওই সময় বসুন্ধরা থেকে রুহেলকে প্রস্তাব দেন, সেখানে একটা মাল্টিপ্লেক্স করার জন্য। প্রস্তাবটা একেবারে লুফে নিয়েছেন ব্যাপারটা এমন নয়। চিন্তা করেছেন। তার আইটি অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এরকম কিছু একটা করা যায়। ওই সময়ই ইন্ডিয়ায় দিল্লির প্রথম মাল্টিপ্লেক্স পিভিআর দেখে আসেন। ওইসময়ই ভাবেন ভারতে হলে আমাদের দেশে কেন নয়।
দিল্লি থেকে ঘুরে এসেই মাঠে নামেন রুহেল। ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে আনেন সিনেপ্লেক্সের যাবতীয় যন্ত্রপাতি। তারপর শুরু হয় সিনেপ্লক্স নির্মাণের কাজ। ২০০৪ সালে উদ্বোধন হয় দেশের প্রথম সিনেপ্লেক্স, স্টার সিনেপ্লেক্সের।
রুহেল বলেন, সিনেপ্লেক্স করার প্রথম বাধা ছিল বিনিয়োগ না পাওয়া। কারণ ওই সময় দেশের চলচ্চিত্রের যে অবস্থা, একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হচ্ছে। ওই সময় এরকম চোখের সামনে ক্ষতি হতে যাওয়া প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য কোনো ব্যাংক এগিয়ে আসেনি। এই দেশে মানুষ সিনেমা দেখবে, এটাও সম্ভব? বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন বেশিরভাগ ব্যাংক কর্মকর্তা। পরে প্রিমিয়ার ব্যাংক থেকে লোন নেন আড়াই কোটি টাকা।
এ উদ্যোক্তা বলেন, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ঋণ দিয়েই শুরু করে আমার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। তবে শুরুতে ঋণ পাওয়ার চেয়েও বড় বাধা ছিল ‘অনুৎসাহিত’ করা। সিনেমার মানুষ থেকে শুরু করে পরিচিতজনরা সবাই একবাক্যে বলেছেন, এটা সম্ভব নয়। সিনেমা দেখতে রিকশাওয়ালারা যায়। এখানে কে যাবে? এই ব্যবসা ভালো পরিবারের ছেলেরা করে না।
তবে একজন পাশে ছিলেন। তিনি রুহেলের স্ত্রী। তিনি বার বার বলেছেন, এটা করো। স্ত্রীর উৎসাহেই নেমে পড়েন রুহেল।
দুই বছর শুধুই ক্ষতি
স্পাইডারম্যান দিয়ে প্রথম ছবি দেখানো শুরু করে স্টার সিনেপ্লক্সে। পাঁচটি হলের জায়গা থাকলেও প্রথম শুরু করে তিনটি হল নিয়ে। কিন্তু দুভার্গ্যজনক ভাবে প্রথম দুই বছর শুধুই ক্ষতি হতে থাকে। মানুষের আনাগোনা হয় না সিনেপ্লেক্সে। এমন অবস্থা হয় ব্যাংকের ঋণ শোধ করাই কঠিন। কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ওই সময় প্রচুর মার্কেটিং শুরু করেন। হলিউডের ‘গ্লাডিয়েটর’ এবং বাংলাদেশের ‘মোল্লা বাড়ির বউ’ সিনেমাটি দিয়ে ব্যবসা ঘুরে যায় সিনেপ্লেক্সের।
তবে ব্যবসা ঘুরে যাওয়ার জন্য আরও একটা উদ্যোগ কাজে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি। “আমেরিকায় সিনেমা মুক্তির পর এ দেশে মুক্তি দিতে দুই মাস সময় লাগে। কারণ সিনেমা আনা, সেন্সর পাওয়া এসব করতে সময় যেতো। এটা আমরা কমিয়ে নিয়ে এসেছি। এ কারণেই এতদূর পর্যন্ত আসতে পেরেছি।”

যা আছে, যা হবে
মাহবুবুর রহমান রুহেল জানান, বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে ছয়টা হলে মোট ১৬শ’ আসন। কিন্তু ঢাকার দর্শকদের জন্য দুর্ভাগ্য তারা ট্রাফিকের কারণে সিনেমা দেখতে আসতে পারেন না। এই কারণে উদ্যোগ নেন ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় সিনেপ্লেক্স করার। ঢাকায় কমপক্ষে ২০টি স্ক্রিন করার উদ্যোগ নেন। তারই প্রথম ধাপ হিসেবে ধানমণ্ডির সীমান্ত সম্ভারে চালু করেন দ্বিতীয় শাখা। তারপর গত বছরের শেষ দিকে মহাখালীতে। মিরপুরে চালু হচ্ছে খুব শিগগিরই। আগামীতে সারাদেশে ১০০টি স্ক্রিন চালু করবে স্টার সিনেপ্লেক্স।
রুহেল বলেন, একজন মানুষ যখন বিনোদন নিয়ে হাসিমুখে বের হয় তখন আমার সবচেয়ে আনন্দ হয়। আমার কাছে মনে হয়, মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কিছু একটা হলেও করতে পেরেছি। এ কারণে সামনে আরও কিছু উদ্যোগ নিতে যাচ্ছি।
তিনি জানান, উত্তরাতে একটা ভবন করার উদ্যোগ নিয়েছেন। সেখানে শুধু সিনেপ্লেক্সই নয়, পুরো এন্টারটেইমেন্ট কমপ্লেক্স করা হবে। অর্থাৎ এন্টারটেইমেন্ট মল। মানুষ সেখানে বিনোদনের যাবতীয় উপাদান পাবেন। এরপর ঢাকার পূর্বাচল এবং চট্টগ্রাম চালু হবে এরকম এন্টারটেইমেন্ট মল। এভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে তাদের।
(https://tbsnews.net/feature/while-other-cinemas-die-star-cineplex-finds-success-mantra-39355)