ডুবছে নেত্রকোনা, ট্রেন চলাচল বন্ধ, উদ্ধারকারী নিখোঁজ

সিলেট ও সুনামগঞ্জের পর এবার নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতির উদ্বেগজনক অবনতি হয়েছে। আরও বেড়েছে সোমেশ্বরী এবং কংস নদীর পানি। পাউবোর সর্বশেষ তথ্যমতে, কলমাকান্দা পয়েন্টে সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার এবং জারিয়া পয়েন্টে কংস নদীর পানি বিপৎসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে মোহনগঞ্জ ও অতিথপুর রেলস্টেশনের মাঝামাঝি ইসলামপুর এলাকার একটি রেলসেতু বন্যার পানিতে ভেঙ্গে যাওয়ায় নেত্রকোণার সঙ্গে ঢাকা এবং ময়মনসিংহসহ সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। মোহনগঞ্জ ও বারহাট্টা স্টেশনে আটকা পড়েছে দু'টি ট্রেন।
সদর উপজেলার জঙ্গলবাড়ি এলাকায় কংস নদীর বেড়িবাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ছয়টি উপজেলায় এ পর্যন্ত ৩৯টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় খোলা হয়েছে ১৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র।

শুক্রবার বিকেলে দুর্গাপুরের চণ্ডিগড় ইউনিয়নের তেলাচী গ্রামে বন্যাদুর্গত পরিবারকে উদ্ধার করতে গিয়ে আক্কাছ আলী নামে এক যুবক নিখোঁজ হয়েছেন।
নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত, সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাহমুদা আক্তার, বারহাট্টা রেল স্টেশনের মাস্টার গোলাম রব্বানী এবং দুর্গাপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের অফিসার শফিকুল ইসলাম এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জেলা প্রশাসক অঞ্জন খান মজলিশ জানান, এ পর্যন্ত জেলার ৬টি উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়ন বন্যা কবলিত হয়েছে। প্লাবিত উপজেলাগুলো হচ্ছে: দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী, বারহাট্টা ও নেত্রকোণা সদর। এসব উপজেলায় মোট ১শ ৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যা কবলিত ১৬১৮০ জন মানুষ সহায়-সম্পদ ও গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। দুর্গত উপজেলাগুলোতে বিতরণের জন্য ৬৮ মেট্রিক টন চাল, ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত জানান, সকাল ন'টার পরিমাপে দেখা গেছে, কলমাকান্দা পয়েন্টে সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর জারিয়া পয়েন্টে কংস নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। তবে দুর্গাপুরের বিজয়পুর পয়েন্টে সোমেশ্বরী নদীর পানি কিছুটা কমেছে, বর্তমান তা বিপৎসীমার ২শ ১৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে বইছে।
কলমাকান্দা উপজেলা সদর ছাড়াও অন্তত ২০০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা সদরের কিছু কিছু এলাকায় নৌকায় যাতায়াত করতে হচ্ছে। উপজেলা সদরের বেশিরভাগ বাসাবাড়ি, বেশকিছু অফিস এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিচতলা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। রান্নাঘর ডুবে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের রান্নাবান্না। এদিকে মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরের গরুহাট্টা, নওহাল, কাজিয়াহাটি, কাচারি রোড এলাকার বহু বাসাবাড়ি এবং দোকনপাটে পানি ঢুকেছে। পানিবন্দি হয়েছে এ উপজেলার অন্তত ৫০টি গ্রাম।

খালিয়াজুরীর ৬৮টি গ্রামের সব ক'টিই পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে ওই উপজেলার সব রাস্তাঘাট। দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের সঙ্কট। নৌকা ছাড়া ঘর থেকে বেরোতে পারছে না মানুষ। বারহাট্টার আসমা, সিংধা, চিরাম এবং রায়পুর এলাকার অবস্থাও একই রকম। এসব উপজেলার অন্তত ৪৭৩ হেক্টর আউশ জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে কয়েক হাজার পুকুরের মাছ।
শুক্রবার বিকেলে দুর্গাপুরের দশাল গ্রামের মৃত আব্দুর রহিমের ছেলে আক্কাছ আলী (২৭) তার আত্মীয় আব্দুল বারেকের পরিবারকে উদ্ধার করতে আরও তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে চণ্ডিগড় ইউনিয়নের তেলাচী গ্রামে যাচ্ছিলেন। পথে তারা বন্যার পানির স্রোতে ভেসে যান। এ সময় তার সঙ্গে থাকা তিনজন সাঁতার কেটে রক্ষা পেলেও আক্কাছ আলী নিখোঁজ হন।
বারহাট্টা রেল স্টেশনের মাস্টার গোলাম রব্বানী জানান, শুক্রবার রাতে মোহনগঞ্জ ও অতিথপুর স্টেশনের মাঝামাঝি ইসলামপুর এলাকার ৩৪ নং রেল সেতুটি বন্যার পানিতে ভেঙ্গে ভেসে গেছে। এ কারণে নেত্রকোণার সঙ্গে ঢাকা ও ময়মনসিংহসহ সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকাগামী আন্তনগর হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনটি মোহনগঞ্জ স্টেশনে এবং মোহনগঞ্জগামী ২৬২ নং লোকাল ট্রেনটি বারহাট্টা স্টেশনে আটকা পড়েছে। রেল সেতু মেরামত ছাড়া ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করা সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি।

নেত্রকোনা সদর উপজেলার ইউএনও মাহমুদা আক্তার জানান, মেদনী ইউনিয়নের জঙ্গলবাড়ি এলাকায় কংশ নদীর বেড়িবাঁধে বাঙ্গন দেখা দিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে বাঁধটি রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। ভাঙনকবলিত এলাকায় ফেলা হচ্ছে বস্তা ও জিও ব্যাগ। স্থানীয়রা জানান, এ বাঁধটি ভেঙ্গে গেলে নেত্রকোণা শহরও বন্যার ঝুঁকিতে পড়বে। তলিয়ে যাবে সদর উপজেলার সম্পূর্ণ এলাকা।
শনিবারও সকাল থেকে নেত্রকোনায় বৃষ্টি হচ্ছে, তিনদিন ধরে সূর্যেও মুখ দেখা যাচ্ছে না। ভারি বৃষ্টির কারণে ঘর থেকেই বেরোতে পারছে না মানুষ। দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে।