বন্যায় নজিরবিহীন দুর্ভোগ সিলেটে

'কাল সকালেও এই সড়ক শুকনা ছিল। আজ এখানে হাঁটুর ওপরে পানি। পানি দ্রুত বেড়েই চলছে। এভাবে বাড়তে থাকলে তো সিলেটের কোনো জায়গাই শুকনা থাকবে না'—এমনটি বলছিলেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমার ঝালোপাড়া এলাকার প্রবীণ তবারক হোসেন।
তিনি বলেন, 'এত দ্রুত পানি বাড়তে আগে কখনো দেখিনি। এক দিনেই পুরো এলাকা তলিয়ে গেল।'
কেবল ঝালোপাড়াই নয়, পুরো সিলেটেই দ্রুত বাড়ছে পানি। জেলার বেশিরভাগ এলাকাই ইতোমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে শুক্রবার থেকে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী।
এদিকে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়েতে পানি ঢুকে পড়ায় তিন দিনের জন্য বিমান চলাচলও স্থগিত করা হয়েছে।
বুধবার থেকে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরদিন বৃহস্পতিবারই তা ভয়াবহ রূপ নেয়। এদিন বিকেল থেকে দ্রুত বাড়তে শুরু করে পানি। সিলেট নগরের বেশিরভাগ এলাকাই তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে।
গত মে মাসের মাঝামাঝি আরেক দফা বন্যা হয়েছিল সিলেটে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে, মে মাসের বন্যায় গত ১৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পানি হয় সিলেটে। তবে চলমান বন্যা গত মাসের রেকর্ডও ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি প্লাবিত এলাকার মানুষদের।
২৯ বছরের চাকরিজীবনে এমন পানি দেখেননি জানিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল কাদির বলেন, 'আর ৪ ইঞ্চি পানি বাড়লেই কুমারগাঁও গ্রিড সাব স্টেশন বন্ধ করে দিতে হবে। এতে সিলেট ও সুনামগঞ্জ শহরের পুরোটা বিদ্যুৎহীন হয়ে যাবে। আমি ২৯ বছর ধরে এখানে চাকরি করছি। ২৯ বছরেও এমনটি দেখিনি। কখনোই কুমারগাঁও গ্রিড লাইনে পানি ওঠেনি। এবারের পানি ভয়ঙ্কর।'
জীবনেও এমন পানি দেখেননি বলে জানালেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পারুয়া গ্রামের সাইদুল হকও। তিনি বলেন, এরকম পানি আর কখনো হয়নি। পুরো উপজেলা তলিয়ে গেছে। কোথাও শুকনো জায়গা নেই। নৌকার অভাবে মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রেও যেতে পারছে না।
স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ছে সিলেট। বন্যার পানি বেড়েই চলেছে। এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে সিলেট নগর ও জেলার সবকটি উপজেলায় পানি ঢুকে পড়েছে।
এদিকে, বন্যার কারণে নজিরবিহীন দুর্ভোগে পড়েছে মানুষজন। বন্যার পানিতে উপকেন্দ্র ও সঞ্চালন লাইন তলিয়ে যাওয়ায় জেলার বেশিরভাগ এলাকাই বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে। নগরের অনেক এলাকায়ও বিদ্যুৎ নেই। এছাড়া ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে না অনেক এলাকায়। ফলে বন্যা কবলিতদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি এলাকার বাসিন্দা আজির উদ্দিন বলেন, 'দক্ষিণ সুরমা সাবস্টেশন পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বৃহস্পতিবার রাত থেকে আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারেনটও নেই।'
তিনি বলেন, 'একে তো পানিবন্দি অবস্থায় আছি, তার ওপর সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। ফলে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।'
ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় পরিবারের সদস্যদের দাড়িয়াপাড়ায় আত্মীয়ের বাসায় রেখে এসেছেন নগরের কাষ্টঘর এলাকার বাসিন্দা সুবল দাস। তিনি বলেন, 'একমাসের ব্যবধানে দুইবার উদ্বাস্তু হলাম। গত মাসের বন্যায়ও ঘরে পানি ঢুকে আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। আজকে আবার একই দশা।'
বিদ্যুতের অভাবে খাবার পানিরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে নগরের অনেক এলাকায়। নগরের তালতলা এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, 'গত মাসের বন্যায় ৭দিন পানি ছিল না। ৭দিন গোসল করতে পারিনি। এবারও একই সমস্যায় পড়েছি।'
তিনি বলেন, রাস্তাঘাট ও দোকানপাট তলিয়ে যাওয়ায় পানি কিনে আনার মতো অবস্থাও নেই। ফলে খাবার পানির পাশপাশি গোসল ও টয়লেটের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
নগরের চালিবন্দর এলাকার রামকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ছড়ারপাড়ের একটি কলোনীর বাসিন্দা তেরাব বিবি। তিনি বলেন, 'এখানে কোনো খাবার নেই। রান্নার ব্যবস্থা নেই। এ পর্যন্ত কেউ কোনো ত্রাণও দেয়নি। মুড়ি ছাড়া সকাল থেকে বাচ্চাদের আর কোনো খাবার দিতে পারিনি। এ অবস্থায় আমরা এখানে থাকব কী করে?'
তিনদিন ধরে পরিবার নিয়ে পানিবন্দি হয়ে আছেন গোয়ানঘাটের ফতেহপুর এলাকার সামসুদ্দিন আহমদ। বাড়ির টিউবওয়েলও পানিতে ডুবে গেছে। তবু আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছেন না তিনি। সুবল বলেন, 'চারদিকে পানি। পরিবার নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য কোনো নৌকাও পাচ্ছি না। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল ফোনেও চার্জ নেই। ফলে কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। এ অবস্থায় ঘরে পানির উপরই থাকতে হচ্ছে।'
একই ধরনের সমস্যার কথা জানালেন একই উপজেলার হরিপুরের বাসিন্দা চেরাগ মিয়া। তিনি বলেন, পানিতে চুলা তলিয়ে গেছে। তাই রান্নাবান্না বন্ধ। ঘরে শুকনা খাবারও নেই। নলকূপ তলিয়ে যাওয়ায় খাবার পানিও পাচ্ছি না। আবার আশপাশে বুক থেকে গলা-সমান পানি। ফলে ঘরের বাইরেও যেতে পারছি না। এরমধ্যে বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই।
'কীভাবে যে বাইচ্যা আছি, তা একমাত্র আল্লাহই জানে,' বলেন চেরাগ।
জেলা প্রশাসনের হিসাবে জেলার এ পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্ধি হয়ে আছেন। পানি ঢুকে পড়েছে সবগুলো উপজেলায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা। এই দুই উপজেলার প্রায় শতভাগ পানিতে তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে এই দুই উপজেলা কমপ্লেক্সও।
বিদ্যুৎ না থাকায় হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে জানিয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ সেলিম বলেন, 'আমরা জেনারেটর দিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু জেনারেটরের সাহায্যে এক্স-রে মেশিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চালানো সম্ভব হয় না। তাই এই সেবাগুলো বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া জেনরেটরের তেলও ফুরিয়ে আসছে। চারদিকে পানি থাকায় তেল আনাও সম্ভব নয়। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে সেবা আরও ব্যাহত হবে। মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।'
ঘরে বন্যার পানি অথচ খাবার পানি নেই। বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। শুকনো খাবারও ফুরিয়ে আসছে। এমন অবস্থাকে বিভীষিকাময় উল্লেখ করে জৈন্তাপুর উপজেলার হেমু এলাকার দিনমজুর উসমান মিয়া বলেন, এমন অবস্থায় একদিনও কাটানো সম্ভব না। অথচ পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে সহজে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ মিলবে বলে মনে হচ্ছে না। আরও অনেকদিন দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
সিলেটের সবগুলো উপজেলাই বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, অনেক এলাকায় বাহনের অভাবে পানিবন্দি লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে পারছে না। তাদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী মাঠে নেমেছে। তারা কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়ানঘাট উপজেলায় বন্যা দুর্গতদের উদ্ধারে কাজ করেছে।
তিনি বলেন, 'আমাদের কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এখন ফাঁকা নেই। বেশিরভাগই তলিয়ে গেছে। বাকিগুলো আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। ফলে নগরের বাইরের প্রায় সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।'
এদিকে, ক্যাম্পাসে পানি উঠে যাওয়ায় আগামী ২৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। শুক্রবার সিন্ডিকেটের জরুরী সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, দুই যুগ পর এবার ক্যাম্পাস বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ক্যাম্পাসে বিদ্যুৎও নেই। তাই ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সিলেটের বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর।
এ ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত পানি ঘরে ঢুকে পড়ায় কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাটের অনেক মানুষ পুরোপুরি ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, 'পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে কুমারগাঁও সাবস্টেশন তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। এটি তলিয়ে গেলে পুরো সিলেট বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়বে। এতে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে সিলেট। তাই আমরা এই কেন্দ্রটি চালু রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি; যাতে অন্তত নগরের বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে। সিটি করপোরেশন, সেনাবাহিনী ও বিদ্যুৎ বিভাগ একসাথে মিলে এই কেন্দ্র সচল রাখার চেষ্টা করছি।'
তিনি জানান, বালির বস্তা দিয়ে কেন্দ্রের চারপাশে বাঁধ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া কেন্দ্রে ঢুকে পড়া পানি সেচে সরানোর চেষ্টা করছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয়ের উপনির্বাহী প্রকৌশলী নিলয় পাশা বলেন, যেভাবে ঢল নামছে, তাতে পানি আটকানোর কোনো উপায় নেই। আগামী দুই দিন বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
তিনি বলেন, মেঘালয় ও আসামের বৃষ্টির পানি ঢল হয়ে নামে সিলেটে। এই ঢলেই দেখা দেয় বন্যা। ভারতের এই দুই রাজ্যে ব্যাপক বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।