আবার ডুবছে সিলেট নগর, ৫২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ

এক মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো পানিতে তলিয়ে গেছে সিলেট নগরের অনেক এলাকা। পানি উঠে গেছে বাসাবাড়িতেও। এদিকে, সুনামগঞ্জ শহরেও ঢুকে পড়েছে বন্যার পানি। বন্যার কারণে জেলার ৫২টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবারও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। ফলে পানিবন্দি মানুষদের দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার সিলেট নগর ঘুরে দেখা যায়, নগরের উপশহর, তেরোরতন, ঘাসিটুলা, সোবহানী ঘাট, তালতলা, জামতলা, মাছিমপুর, কালিঘাট, ছড়ারপাড়সহ অন্তত ১০-১২টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে এলাকার সড়ক। অনেক বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকে গেছে।
এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে দুই দফা বন্যায় দুর্ভোগে পড়ছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। নগরের তুলনামূলক নিচু ও সুরমা নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন।
নগরের শাহজালাল উপশহর এলাকার বাসিন্দা সরফ উদ্দিন বলেন, 'বুধবার দুপুরেই উপশহরের বেশিরভাগ সড়ক তলিয়ে যায়। রাতের দিকে বাসায় পানি ঢুকে পড়ে। পানি বৃদ্ধি এখনও অব্যাহত রয়েছে।'
তিনি বলেন, 'গত মাসেই বন্যায় বাসাবাড়ি পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। প্রায় এক সপ্তাহ বাসায় পানি ছিল। এ সময় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহও বন্ধ ছিল। অনেক দুর্ভোগের পর পানি নামে। এখন আবার একই দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।'
নগরের তালতলা এলাকার হার্ডবোর্ড ব্যবসায়ী শোয়েব আহমদ বলেন, 'গত মাসে বন্যায় দোকানে পানি ঢুকে অনেক মালামাল নষ্ট হয়েছিলো। আবার দোকানে পানি ঢুকে গেছে। বালির বাঁধ দিয়েও পানি আটকানো যাচ্ছে না।'
নদী উপচে পানি ঢুকে পড়েছে নগরের বৃহৎ পাইকারি বাজার কালিঘাট এলাকার অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও।
কালিঘাট এলাকার ব্যবসায়ী নীলাঞ্জন দাশ টুকু বলেন, 'আগের মাসের বন্যার ক্ষতিই কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এখন আবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছি। এভাবে বারবার বন্যা হলে ব্যবসা করব কীভাবে?'
নগরের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়নি বলে জানিয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)।
সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, 'নগরের কিছু নিচু এলাকায় পানি উঠেছে। তবে এখনও আশ্রয়কেন্দ্র খোলার মতো পরিস্থিতি হয়নি। তবে আমরা প্রস্তুত আছি। প্রয়োজন হলেই আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হবে।'
তিনি বলেন, নগরে খাওয়ার পানির সরবরাহও স্বাভাবিক আছে। ফলে বিশুদ্ধ পানিরও সংকট দেখা দেয়নি।
বৃহস্পতিবারও থেমে থেমে বৃষ্টি হয় সিলেটে। ১৯ জুন পর্যন্ত এভাবে বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। অব্যাহত আছে ঢলও। ফলে বাড়ছে নদনদীর পানি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের উপসহকারী প্রকৌশলী নয়ন পাশা বলেন, সিলেটের সুরিমা, কুশিয়ারা ও লোভা নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে কিছুটা কমলেও বেড়েছে সিলেট পয়েন্টে।
এর আগে গত মে মাসের মাঝামাঝিতে ভয়ঙ্কর বন্যা দেখা দেয় সিলেটে। ১৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই বন্যায় তলিয়ে যায় জেলার ১২টি উপজেলা ও নগরের বেশিরভাগ এলাকা।
এই রেশ না কাটতেই আবারও বন্যার কবলে পড়েছে সিলেট। তবে বন্যায় নগরের চেয়েও বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষেরা।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ এলাকার দিনমজুর ইকবাল হোসেন বলেন, 'পানি তো ইবার যাইতে করি কর না। মাঝখানে কয়দিনের লাগি একটু কমছিল। এখন আবার বাড়ি গেছে। প্রায় এক মাস ধরি আমরা পানির নিচে আছি।'
পানির কারণে কাজের সুযোগ না থাকায় দুর্ভোগে আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'কাজকাম নাই। খাইয়া না খাইয়া আছি।'
জেলার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে জানিয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান, পানিবন্দি মানুষের জন্য ৪৪৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কিছু আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যাকবলিত মানুষজন উঠেছেনও। বন্যার্তদের মাঝে চাল এবং নগদ অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে সিলেটের পাঁচ উপজেলা সদর, গোয়াইঘাট, কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুরে। এসব উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হয়ে আছে। তলিয়ে গেছে এসব এলাকার রাস্তাঘাট। বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি অনেক অফিসেও পানি উঠে গেছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান বলেন, 'বৃহস্পতিবার পানি তেমন বাড়েনি। তবে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে আমরা ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছি।'
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাইদুর রহমান চৌধুরী বলেন, 'চলমান বৃষ্টিপাত আরও কয়েক দিন থাকবে। এই মাসে এখন পর্যন্ত (বৃহস্পতিবার দুপুর) ৬৮৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।'

এদিকে, ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি ২৭ সেন্টিমিটার বেড়েছে। নদীর পানি বৃহস্পতিবার দুপুরে বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো।
বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় সুনামগঞ্জ পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকার ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করা শুরু করেছে। ইতিমধ্যে শহরের নবীনগর, পশ্চিম তেঘরিয়া, উত্তর আরপিন নগর, মরাটিলা এলাকার ঘর বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে।
পশ্চিম তেঘরিয়া এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, 'ঘরেও হাঁটু পানি, এখন মালপত্র সব নিয়া বিছানার উপর বসে আছি, কোন ত্রাণ সহায়তা আমরা পাই নাই। কি করবো, কই যাবো বুঝে উঠে পারছি না।'
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, সুনামগঞ্জে বৃষ্টি থাকলেও পানি বাড়ছে মূলত উজানের বৃষ্টির কারণে। উজানে ভারতের মেঘালয় ও আসামে বৃষ্টিপাত হচ্ছে খুবই বেশি। যার ফলে নদনদীর পানি দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে।
৫২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ
সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে এখন পর্যন্ত ৫২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ আছে। এর মধ্যে ৪০টি প্রাথমিক আর ১২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিরাপদে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা অফিস।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম আব্দুর রহমান বলেন, 'বিদ্যালয়ে পানি ঢুকলে পাঠদান বন্ধ করে এলাকাবাসীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য উপজেলা অফিসারদের নির্দেশনা দেয়া আছে। তারা তাদের এলাকার প্রধান শিক্ষকদের মাধ্যমে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত প্রাথমিকে ৪০টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ করা হয়েছে।'