যানজট সমাধানে আশু স্বস্তি দিতে পারে ট্রাভেল ডিমান্ড ম্যানেজমেন্ট

ঢাকার যানজট সমাধানের আশু স্বস্তি খুঁজতে গেলে ট্রাভেল ডিমান্ড ম্যানেজমেন্টের (ভ্রমণ চাহিদা ব্যবস্থাপনা) যেমন: স্কুল-কলেজগুলোর সময়সীমা ও ছুটির সূচী, মার্কেটসমূহের খোলা-বন্ধ ও বন্ধের সূচীতে বাস্তবসম্মত পরিবর্তন আনা যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদ এবং পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
মঙ্গলবার পরিকল্পনাবিদদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এর 'স্বাভাবিক ঢাকায় অসহনীয় যানজট: পরিবহন পরিকল্পনা ও নগর পরিকল্পনার প্রেক্ষিত বিশ্লেষণ ও প্রস্তাবনা' শীর্ষক নগর সংলাপে বক্তারা এ মন্তব্য করেন।
নগর সংলাপের মূল প্রবন্ধে আইপিডির নির্বাহী পরিচালক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানী ঢাকার যানজটের দীর্ঘ মেয়াদে সমাধান খুঁজতে গেলে পরিবহন পরিকল্পনার মূল ভিত্তি হওয়া প্রয়োজন গণপরিবহনকে কেন্দ্র করে হাঁটা-সাইকেল-বাস-কমিউনিটিভিত্তিক প্যারাট্রানজিট ব্যবস্থা তৈরি।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিক সময়ের মত চালু হবার পর নগরে যানজট বেড়েছে তীব্রভাবে, যা নগর জীবনকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকার সড়কসমূহ তার কার্যকর সক্ষমতার ৬-৭ গুণ ট্রাফিক ধারণ করার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ঢাকা নগরের ট্রাফিক সমস্যার সমাধানে সমন্বয়হীন প্রকল্প উদ্যোগ চলমান থাকলেও বাস্তবিকভাবে যানজট সমস্যার সমাধান পাওয়াটা খুবই দুরূহ।
যানজট নিরসনে স্বল্পমেয়াদি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাগত উদ্যোগের পাশাপাশি পরিবহন পরিকল্পনা ও নগর পরিকল্পনার কার্যকর সমন্বয় প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, নগরে সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সড়ক এলাকার বরাদ্দকৃত ভূমি ২০-২৫ ভাগ হওয়া প্রয়োজন হলেও ঢাকায় ১০ ভাগেরও কম সড়ক বিদ্যমান। এতদসত্ত্বেও সেবাসংস্থা, সড়ক সংস্থা ও নগর সংস্থাসমূহের সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ি, অনিয়ন্ত্রিত পার্কিং ও হকার অব্যবস্থাপনার কারণে ঢাকার সড়কগুলো সক্ষমতার ৬০-৭০ ভাগের বেশি কার্যকারিতা দেখাতে পারে না।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এর প্রকল্প পরিচালক মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেন, ঢাকার ভৌত পরিকল্পনা ও যোগাযোগ পরিকল্পনার যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে ঢাকাকে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা শৃংখলার মধ্যে আনা সম্ভব। পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত এলাকার ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা এখনই চূড়ান্ত করে ফেলা দরকার।
যত্রতত্র বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের কারণে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে তাই পরিকল্পনামাফিক বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের উপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত জোড়-বেজোড় ভিত্তিক ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবস্থাপনা কার্যকর হলে গাড়ির সংখ্যা দেড়গুণ বেড়ে যাবে উল্লেখ করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, এটা কোনো সমাধান নয়। যাদের একটি গাড়ি আছে তারা চাইলেই নিজেদের সুবিধার্থে জোড়/বিজোড়ের অন্য একটি গাড়ি কিনে ফেলবেন। আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয়হীনতা।
ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কার্যকর করতে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় প্রস্তাবিত বিদ্যালয়ভিত্তিক জোনিং ব্যবস্থা কার্যকর করবার পাশাপাশি অধিক ব্যয়নির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিবর্তে সাশ্রয়ী গণপরিবহন ব্যবস্থা কার্যকর করবার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ পুলিশ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উন্নয়ন)পরিকল্পনাবিদ ড. চৌধুরী মোঃ জাবের সাদেক বলেন, ট্রাফিক মোড়গুলোতে ডিজাইন ও পরিকল্পনাগত সমাধান করা প্রয়োজন। ঢাকা শহরে গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত পার্কিং নগর বিশৃংখলার জন্য দায়ী, এক্ষেত্রে পার্কিং ব্যবস্থাপনাকে কার্যকর নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসা জরুরি।
সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিনিধিত্বকারী ওবায়দুল ইসলাম বলেন, বিগত বছরগুলোতে ট্রাফিক সমস্যা নিরসনে গৃহীত অধিকাংশ প্রকল্প কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করলেও নগরের যানজট নিরসনে কার্যকর সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
আইপিডির উপদেষ্টা ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ঢাকার ট্রাফিক ও পরিবহন পরিকল্পনায় যতগুলো সম্ভাব্য প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে, সেগুলো যদি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলেও ঢাকার যানজট নিরসন করা যাবে না, যদি না সারাদেশের আঞ্চলিক উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ঢাকামুখী জনস্রোত না কমানো যায়।
অনুষ্ঠানে ঢাকার ট্রাফিক সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য বিদ্যমান বাস রুট রেশনালাইজেশন শহরের সকল রুটে সম্প্রসারিত করা; গণপরিবহন সার্ভিসসমূহের সমন্বিত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা; কমিউনিটিভিত্তিক মানসম্মত প্যারাট্রানজিট পরিকল্পনা তৈরি করা; পথচারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে পরিবহন পরিকল্পনা করা ও সড়কগুলোর ডিজাইন তৈরি করাসহ ২৩টি প্রস্তাবনা দেয় আইপিডি।