দেশের এক নম্বর সিরামিক ব্র্যান্ড হতে চায় আকিজ

সম্প্রতি টেবিলওয়্যার পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে আকিজ গ্রুপ। ২০০৯ সালের পর এটি দেশে টেবিলওয়্যার খাতে একটি বড় বিনিয়োগ। সিরামিকসের ব্যবসাও সম্প্রসারণ করছে আকিজ গ্রুপ। আকিজ গ্রুপের সিরামিকস ব্যবসা নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বশির উদ্দিন।
সিরামিকস খাতে হঠাৎ আকিজের বড় বিনিয়োগের কারণ কি?
সিরামিকসের আমরা এসেছি প্রায় দশ বছর আগে। তখনই আমরা স্টাডি করে দেশে-বিদেশে এর সম্ভাবনা দেখেছি এবং বড় পরিকল্পনা নিয়েছি। ধীরে ধীরে আমরা এটিকে বড় করছি।
আমরা প্রথমেই টাইলস দিয়ে শুরু করলাম। তখন দুটো লাইন ছিল। এখন আমাদের টাইলসের ৫টি লাইন। নতুন লাইনগুলোর প্রত্যেকটি প্রথম দিকের ৭-৮টি লাইনের সমান। এরপর আমরা স্যানিটারি ওয়্যার উৎপাদনে যাই। সম্ভবত এখন দেশের সবচেয়ে বড় স্যানিটারি ওয়্যার কারখানা আমাদের।
আমরা এখন ইউরোপের বাজারে লার্জেস্ট এক্সপোর্টার্স (সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক)। ইউরোপের দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী স্যানিটারি ওয়্যার উৎপাদন করে দিচ্ছি।
আমরা গত মাসে টেবিলওয়্যার উৎপাদন শুরু করেছি। এর জন্য খুব সুন্দর একটি প্ল্যান্ট স্থাপন করেছি। আমার সর্বোচ্চ মানের টেকনোলজি এবং দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়েছি। কাঁচামালের ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ মানের টাই ব্যবহার করছি। প্রথম মাসের রেসপন্স আমাদের প্রচণ্ডভাবে আশান্বিত করেছে। আমাদের নতুন প্ল্যান্ট দ্বিগুণ করার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। কারখানা তিনগুণ করার পরিকল্পনাও রয়েছে আমাদের।
দেশে টেবিলওয়্যার খাতের বিদ্যমান কোম্পানিগুলো ভালো করছে না। আপনারা কীভাবে পরিকল্পনা করছেন?
পৃথিবীতে লোকসানের ব্যবসা বলে কিছু আছে এটি আমি জানি না। যে ব্যবসায় একজন লোকসান করে, সেখানেই আরেকজন মুনাফা করে। পার্থক্য হয় ব্যবস্থাপনায়। টেবিলওয়্যারে বিনিয়োগ করার আগে আমরা ভেবেছি। আমরা ভোক্তার প্রয়োজন অনুভব করতে চেষ্টা করেছি। ভোক্তারা কী চায় সেটি বুঝে বিনিয়োগ করেছি। আমরা এ খাতের সমস্যা এবং সম্ভাবনা চিন্তা করেই এসেছি। আমাদের ৮০ বছর ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আশা করছি, আমরা ভালো করবো।
কী কী বৈশিষ্ট্যের কারণে আকিজ সিরামিকস ও টেবিলওয়্যারে আকৃষ্ট হবেন ক্রেতারা?
অন্যদের চেয়ে আলাদা হওয়ার জন্য আকিজ মূলত গুরুত্ব দেয় পণ্যের সুন্দর আকার এবং আকর্ষণকারী ডিজাইনের ওপর। সেইসঙ্গে সেরা কাঁচামালের ব্যবহার এবং 'ইন হাউস বডি কম্পোজিশন' পণ্যটিকে চকচকে ও স্বচ্ছ করতে সাহায্য করে। সীসা এবং ক্যাডমিয়াম মুক্ত রঙ প্রিন্টিংয়ে ব্যবহার করা হয়, যা আকিজ টেবিলওয়্যার পণ্যকে আরও স্বাস্থ্যকর করে তোলে। আমাদের পণ্যগুলো স্ক্র্যাচ রেজিস্ট্যান্স। ৩০০ টিরও বেশি সাইকেল ডিশওয়াশার ব্যবহার করা হয় আমাদের পণ্যে। এছাড়া, আমাদের ইনগ্লেজ (উচ্চ তাপমাত্রা) ফায়ারিং প্রোডাক্ট গ্রাহকদেরকে 'মাইক্রোওয়েভ প্রুফ' পণ্য সরবরাহ করে।
আমি বলবো সিরামিকসের তৈজসপত্র স্বাভাবিক ভাবেই পশ্চাত্যের অনুসরণ করে। আপনি যদি দেশীয় পাত্রের আকৃতি দেখেন, দেখবেন সেগুলো একটু ভারি বা একটু গভীর ধরনের; অন্যদিকে পশ্চাত্যের গুলো অনেক বেশি ফ্ল্যাট, অনেক স্ট্রেইট, আকারের মধ্যে একটা জিওম্যাট্রিক ব্যাপারও আছে। কালের বিবর্তনে আমাদের সাংস্কৃতিতে দেশীয় নকশাগুলো খাপ খাওয়ানো হয়েছে, সেগুলো মাথায় রেখে নিজস্ব ডিজাইনার দিয়ে স্থানীয় বাজারের চাহিদা আমরা পূরণ করে থাকি এবং বিদেশি ক্রেতাদের সরবরাহ করা ডেকোর অনুযায়ী আমরা পণ্য পুনরুৎপাদন করে আন্তজার্তিক বাজারে বিক্রি করি।
সিরামিকস খাতে আকিজের ব্যবসা কত বড়? নতুন টেবিলওয়্যার খাতে বিনিয়োগ কেমন?
২০১৮ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে ২৫ একর জায়গায় আমরা আকিজ টেবিলওয়্যার কারখানা গড়ে তুলেছি। গ্যাস সংযোগ না পাওয়াতে উৎপাদনে যেতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। আকিজ টেবিলওয়্যারে এ পর্যন্ত বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মতো। ধীরে ধীরে কারখানাটি সম্প্রসারণ করা হবে এবং এখানে কর্মসংস্থান হবে ৩ হাজার জনেরও বেশি মানুষের।
ত্রিশালের যেখানে আকিজ টেবিলওয়্যার কারখানা সেখানেই ১৫০ একর জায়গার ওপর আমরা পুরো সিরামিকস শিল্প গড়ে তুলেছি, যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে। যেভাবে সেখানে কারখানা সম্প্রসারণ করা হচ্ছে, তাতে আগামী কয়েকবছরের মধ্যে এটি হবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সিরামিকস পল্লী। বর্তমানে সিরামিকস শিল্পে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ আছে এবং কর্মসংস্থান আছে প্রায় ৭ হাজার জনেরও বেশি।
আকিজ সিরামিকসের কোন ধরনের পণ্য বাজারে রয়েছে?
আকিজ টেবিলওয়্যারে আমাদের কাছে ডিনার সেট, টি সেট, কফি সেট, ফিরিনি সেট, রাইস বোল, চায়ের কাপ-সসার, কফির মগ, স্যুপের বাটি, বিভিন্ন আকার ও ডিজাইনের ফুলদানি ইত্যাদি পণ্য রয়েছে। একজন মানুষের টেবিলওয়্যারের প্রয়োজনীয়তার সম্পূর্ণ সমাধান দিতে সক্ষম আকিজের প্রোডাক্ট রেঞ্জ।
স্থানীয় এবং রপ্তানি বাজারে টেবিলওয়্যারের সম্ভাবনা কেমন? ভবিষ্যতে আরো বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে কি?
আমাদের মাথাপিছু আয় যেমন গতিশীলভাবে বাড়ছে, তেমনি সুযোগও গতিশীলভাবেই বাড়ছে। স্পষ্টতই, উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আধুনিক জীবনযাপনের আকাঙ্খা রয়েছে। এবং বাংলাদেশ এখন নান্দনিক ও প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পণ্যের চাহিদা মেটাতে প্রচুর পরিমাণে সিরামিক পণ্য আমদানি করে। আমরা মনে করি এটি একটি ভালো সুযোগ তৈরি করেছে।
প্ল্যান্টটির দৈনিক ৫৫ হাজার পিস টেবিলওয়্যার তৈরির ক্ষমতা রয়েছে এবং ২০২২ সালের শেষ নাগাদ এটি বাড়িয়ে প্রতিদিন ১ লাখ ২৫ হাজার পিস উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অতিরিক্ত এই ক্ষমতা কোম্পানিটিকে শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় টেবিলওয়্যার কারখানাগুলোর মধ্যে একটি করে তুলবে।
ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশে উৎপাদিত তৈজসপত্রের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার রপ্তানি করছে। তবে চাহিদা পূরণে এটি যথেষ্ট নয়, এখানে আমাদের সক্ষমতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, আমরা সামনের ১০ থেকে ১৫ বছরে রপ্তানি বাজারে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ বৃদ্ধির সুযোগ দেখতে পাচ্ছি।
আগামী ১০ বছর পর বাজারে আপনাদের অবস্থান কেমন দেখতে চান?
আমরা আমাদের ব্যবসার টেকসইতায় বিশ্বাস করি এবং ভবিষ্যৎই আমাদের কাছে আজকের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা নিজেদেরকে সিরামিক পণ্য শিল্পের দেশীয় ও রপ্তানি, উভয় বাজারেই বাংলাদেশের এক নম্বর ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে চাই।