করোনার নতুন ঢেউয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি

এক দিনের ব্যবধানে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে শনাক্তের হারও। সংক্রমণ মোকাবেলায় স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি করোনা পরীক্ষার পরিধি বাড়ানো, হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ানো ও টিকাদানের পরিধি বাড়াতে কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আগামী ১৩ জানুয়ারি থেকে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে নতুন বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছে।
গণপরিবহনে যাত্রীদের সংখ্যা সীমিতকরণ, উন্মুক্ত স্থানে সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জমায়েত নিষিদ্ধ এবং মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে নতুন ঘোষণাকৃত বিধিনিষেধে।
বাস, ট্রেন ও লঞ্চসহ গণপরিবহনগুলোকে ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী বহন করতে হবে।
শপিং মল, মার্কেট, হোটেল ও রেস্তোরাঁ সহ সকল পাবলিক স্থানে মাস্ক পরতে হবে, অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রেস্তোরাঁয় খেতে ও আবাসিক হোটেল ভাড়া করতে হলে টিকা গ্রহণের সনদ দেখাতে হবে।
১২ বছরের বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদের আগামী ১৫ জানুয়ারির পরে টিকা না দেওয়া পর্যন্ত সশরীরে শ্রেণিকক্ষে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে না।
স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংয়ের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পোর্টগুলোতে ক্রুদের জাহাজের বাইরে আসার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করতে হবে। স্থলবন্দরগুলোতেও আগত ট্রাকের সঙ্গে শুধু চালক থাকতে পারবে। কোনো সহকারী আসতে পারবে না। বিদেশগামীদের সঙ্গে আসা দর্শনার্থীদের বিমানবন্দরে প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
ট্রেন, বাস ও লঞ্চে ধারণক্ষমতার অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নেওয়া যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কার্যকারিতার তারিখসহ সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করবে। সব ধরনের যানবাহন চালক ও সহকারীদের আবশ্যই কোভিড-১৯ টিকা নিতে হবে এবং সনদধারী হতে হবে।
বিদেশ থেকে আসা যাত্রীসহ সবাইকে বাধ্যতামূলক কোভিড-১৯ টিকা সনদ প্রদর্শন করতে হবে।
স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন ও মাস্ক পরার বিষয়ে সব মসজিদে জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা সংশ্লিষ্টদের সচেতন করবেন। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
জণসাধারণের করোনা টিকা ও এর বুস্টার ডোজ গ্রহণ ত্বরান্বিত করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় প্রচার প্রচারণার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে তারা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নেবে। এছাড়া উন্মুক্ত স্থানে সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং সমাবেশ পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডাঃ আহমেদুল কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বিধিনিষেধ কঠোরভাবে মেনে চললে আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে রাখা যাবে। সংক্রমণে দেরি করা গেলে, সব রোগীকে চিকিৎসা দেয়া যাবে, হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে। অদৃশ্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেরি করতে সবাই এভাবেই কাজ করে; আমাদেরও তাই করতে হবে।"
সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে ৩ জন কোভিড রোগীর মৃত্যু হয়েছে এবং নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ২৩১ জন।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা ২৮ হাজার ১০৫ এবং মোট সংক্রমণের সংখ্যা ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ৯৩১ জন।
সারাদেশে ২৬ হাজার ১৪৩টি নমুনা পরীক্ষায় বর্তমানে দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্তের হার ৮.৫৩ শতাংশ।
পরীক্ষা ও টিকাদানের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে
ডিজিএইচএস-এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা টিবিএসকে বলেন, "সংক্রমণ বাড়ছে তাই কোভিড রোগী শনাক্তে অ্যান্টিজেন ও আরটিপিসিআর টেস্ট বাড়ানো হচ্ছে। কোভিড সাসপেক্টেট সবাইকে আমরা পরীক্ষা করতে বলছি। এছাড়া, কোভিড-১৯ রোগীদের সংস্পর্শে আসাদেরও টেস্ট করতে সিভিল সার্জনদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমাদের দিনে ৫০ হাজারের বেশি টেস্ট করার সক্ষমতা আছে। রোগী বাড়লে টেস্টের পরিধি আরো বাড়ানো হবে।"
অধ্যাপক সেব্রিনা ফ্লোরা আরও বলেন, "সংক্রমণ কমে যাওয়া কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে কিছুদিন নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা করা হলেও সংক্রমণ বাড়ায় সেগুলো আবারও কোভিড রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। কোভিড রোগীদের জন্য অক্সিজেন বেশি জরুরি তাই জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতেও সেন্ট্রাল অক্সিজেনের লাইন বসানো হয়েছে।"
"এছাড়া জেলা পর্যায়ের অধিকাংশ হাসপাতালে অক্সিজেন কনসেনটেটর বসানো হয়েছে, কয়েকটিতে বসানোর কাজ চলছে। আমরা নিয়মিত মিটিং করে দ্রুত সেসব কাজ শেষ করার তাগিদ দিচ্ছি", যোগ করেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সারাদেশে কোভিড রোগীদের জন্য ১৩ হাজার ৪১২টি সাধারণ বেড রয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে রোগী ভর্তি আছে ২ হাজার ১৩৬ জন।
গেল বছরের ডিসেম্বরে করোনার নতুন ধরন শনাক্ত হওয়ার পর, বাংলাদেশে আরও ৯ জন নতুন করে ওমিক্রনে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে।
জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক ডেটাবেজ সংস্থা গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটা (জিআইএসএআইডি)-এর তথ্য অনুসারে, সোমবার সকাল পর্যন্ত দেশে ওমিক্রন ধরনে আক্রান্তের মোট সংখ্যা ৩০।
ইনস্টিটিউট অফ এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডাঃ এম মুশতাক হোসেন টিবিএসকে বলেন, "সংক্রমণ প্রায় দ্বিগুণ হারে বাড়ছে, এটি ওমিক্রনের লক্ষণ। বড় বড় শহরগুলোতে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। কোভিড মোকাবেলায় হাসপাতালের বাইরে আউসাইট ব্যবস্থাপনায় এখন জোর দিতে হবে। অ্যান্টিজেন পরীক্ষা আরো বাড়াতে হবে। যাতে আক্রান্তদের দ্রুত শনাক্ত করে আইসোলেশনে পাঠানো যায়। এছাড়া, এখনো যারা টিকা নেইনি মৃত্যু কমাতে তাদের দ্রুত টিকার আওতায় আনতে হবে।"
সংক্রমণ মোকাবেলায় টিকাদানের পরিধি আরো বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে সরকার।
অধ্যাপক সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, "গত তিন-চার মাস সংক্রমণ কমে যাওয়ায় টিকা নিতে মানুষের মধ্যে ধীরতা এসেছিল। এখন রেস্টুরেন্টে যেতে বা শপিংয়ে যেতে টিকা সনদ দেখানোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এতে আমরা মানুষকে ভয় দেখাতে চাচ্ছিনা, এসব করা হচ্ছে যাতে মানুষ টিকা নেয়।
দেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইসের টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৭ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এবং দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন ৫ কোটি ৪৮ লাখ মানুষ। এছাড়া বুস্টার ডোজ নিয়েছেন ৪ লাখ ২৮ হাজার মানুষ।