জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ: ঐক্য, সহাবস্থান, সুস্থ রাজনীতিতে জোর নেতাদের

আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আজ শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জুলাই আন্দোলনে শহীদ ইসমাইল হোসেন রাব্বির বোন মিম আক্তার দলটির নাম ঘোষণা করেন।
একইসঙ্গে তিনি দলের আহ্বায়ক হিসেবে নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব হিসেবে আখতার হোসেনের নাম ঘোষণা করেন।

অনুষ্ঠানে আখতার হোসেন আনুষ্ঠানিকভাবে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নাম ঘোষণা করেন। তারা হলেন, সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, আরিফুল ইসলাম আদীব, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব নাহিদা সারওয়ার নিবা, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী ও সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ।
এর আগে বিকেল ৪টা ২০ মিনিটের দিকে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। পরে পবিত্র গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়৷ ধর্মগ্রন্থ পাঠের পর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।
পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহিন সরকার বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টি মনে করে সব শহীদের স্বপ্ন এবং আহতদের স্পিরিট ধারণ করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য পারস্পরিক সহাবস্থান জরুরি। এক্ষেত্রে আমাদের পার্টি সামনে থেকে ভূমিকা রাখবে।
আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে নতুন ছাত্র-নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল 'জাতীয় নাগরিক পার্টি'
অনুষ্ঠানে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের ওপর নির্মিত একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। প্রামাণ্য চিত্র শেষে পর্দায় 'জাতীয় নাগরিক পার্টি' লেখাটি ভেসে ওঠে।
এরপর এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্ব ও সিনিয়র নেতারা মঞ্চে ওঠেন।
অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, 'এক ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে ৫ আগস্ট উৎখাত করা হয়েছে। ১৮৫৭, ১৯৪৭, '৯০-এ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতিসত্তার বিকাশ ঘটেছে। এই বাংলায় হাজারো চিন্তার, মতের সম্মিলন ঘটেছে। ঐতিহাসিক সমৃদ্ধশালী পূর্ব বাংলা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, বৈদেশিক দালালদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এসবের ধারাবাহিকতায় আজকের ২৪ এসেছে। আগস্টে বৈদেশিক দালালের মহাদানবকে তাড়িয়ে দিয়েছে জনগণ।'

তিনি বলেন, 'জনগণের এখন নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। কোনো এলিটগোষ্ঠী, পরিবারতন্ত্রের আনুগত্য করতে জনগণ আর রাজি নয়। আগামীতে আমাদের নেতা হবে দিনমজুর খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিকদের সন্তান। জনগণের সেই আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নকে লালন করতেই এই নতুন দলের আবির্ভাব হচ্ছে। এই লড়াই চলবে, এই লড়াইয়ে আমাদের জিততে হবে। এজন্য প্রস্তুত জাতীয় নাগরিক পার্টি।'
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম বলেন, 'আমাদের দল হবে শুধুই বাংলাদেশপন্থী, যারা শুধু বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে। আগামীর বাংলাদেশ হবে সুস্থ রাজনীতির বাংলাদেশ। সংকটের সময়ে সবার একটাই প্রাধান্য থাকবে বাংলাদেশ। আমরা এজন্য দায়বদ্ধ থাকব।'

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, 'আগামীর বাংলাদেশ হবে গণতন্ত্রের। আগামীর বাংলাদেশে কোনো চাঁদাবাজি থাকবে না। আগামীর বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে সহিংসতায় প্রাণ যাবে না। আগামীর বাংলাদেশ হবে তারুণ্যের বাংলাদেশ।'
এর আগে স্লোগানে স্লোগানে মিছিল নিয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জড়ো হন বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতা। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন তারা। কেউ এসেছেন রংপুর থেকে, কেউ এসেছেন খুলনা থেকে।
অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন জুলাই আন্দোলনে আহত, হতাহতের পরিবার ও রাজনৈতিক দলের নেতারাও
নতুন এ রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ইতোমধ্যে উপস্থিত হয়েছেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ জাবির ইব্রাহিমের (৬) বাবা।
তিনি বলেন, 'শেখ হাসিনা ছিল সিরিয়াল কিলার। সে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা দিয়ে শুরু করে জাবিরকে দিয়ে হত্যা শেষ করেছে। আমরা আর রক্তক্ষরণ চাই না। এই দলকে হাজারো শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা।'
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাসহ কূটনৈতিক ব্যক্তিরাও অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরোয়ার, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ও লেবার পার্টির সেক্রেটারি মিরাজুল ইসলাম।

পাকিস্তান হাইকমিশনের পলিটিক্যাল কাউন্সেলর কামরান দাঙ্গাল, ভ্যাটিকান সিটির রাষ্ট্রদূতও উপস্থিত হয়েছেন।
এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির নেতারা, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর আহমদ আলী কাসেমী, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন রাজী, সহ-সভাপতি জসিম উদ্দিন এবং জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমীর নুরুল ইসলাম বুলবুলও মঞ্চে যোগ দিয়েছেন।
আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে গত বছরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পরিবার উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।

এদিকে অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সংসদের সামনে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের একটি অংশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ফলে বিপরীত দিক দিয়ে দুইপাশের যানবাহন চলাচল করছে। এতে সড়কের খোলা অংশ ও আশপাশের মোড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সাধারণ যাত্রীরা।

জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহবায়ক সারোয়ার তুষার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকল্প যেখানে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে, তেমন একটি রাষ্ট্র বাস্তবায়ন করাই হবে আশু লক্ষ্য। পাচার ও লুটপাটবিরোধী উৎপাদনশীল অর্থনীতি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা তৈরিতে বিশেষ প্রণোদনা দেয়া হবে। এর বাইরে দীর্ঘমেয়াদি আরও কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করবে দলটি।'
প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৫১ থেকে ২০১ জন হতে পারে বলে জানান তিনি।
