রূপপুর প্রকল্পের ঋণ ছাড়ের সময়সীমা ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়াতে রাজি হয়েছে রাশিয়া

রুশ পারমাণবিক কর্পোরেশন রোসাটম বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের (আরএনপিপি) জন্য গৃহীত ঋণের ব্যবহারের সময়সীমা দুই বছর বাড়াতে সম্মত হয়েছে।
বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ আন্তঃসরকারি ঋণ চুক্তি (আইজিসিএ) সংশোধনের বিষয়ে সম্মতি জানান। এর ফলে ঋণ ব্যবহারের সময়সীমা ২০২৬ সালের শেষ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, উভয় পক্ষ প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে দ্রুত 'প্রোটোকল নং ২' স্বাক্ষরের বিষয়ে একমত হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, রূপপুর প্রকল্পের মোট ব্যয় আনুমানিক ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ১১.৩৮ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ার ঋণ, আর বাকি ১০ শতাংশ বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়ন। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ঋণ বিতরণ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে প্রায় ৭.৭০ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। তবে কোভিড-১৯ মহামারি এবং পরবর্তীকালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রকল্পের গতি শ্লথ হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পুরো অর্থ গ্রহণ সম্ভব হয়নি।
ফলে, বাংলাদেশ ২০২৪ সালের জুনে রাশিয়াকে ঋণ বিতরণের সময়সীমা ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর অনুরোধ জানায়। তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত হয়। ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, যার ফলে বাংলাদেশ চুক্তির আওতায় অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি।
চুক্তি সংশোধনের পর বাংলাদেশ ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রাশিয়া থেকে অবশিষ্ট ৩.৬৮ বিলিয়ন ডলার পাবে।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, প্রধান উপদেষ্টা ও রোসাটমের মহাপরিচালক প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি সফলতা নিশ্চিত করতে কর্মীদের প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
সহযোগিতা সম্প্রসারণের আহ্বান
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস লিখাচেভকে জানান, বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও সম্প্রসারণে আগ্রহী। তিনি শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তিতে দুই দেশের অভিন্ন স্বার্থ ও অগ্রগতির ওপর গুরুত্ব দেন।
রোসাটমের মহাপরিচালক সর্বশেষ ২০২৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে চলমান সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়।
আলোচনার সময় অধ্যাপক ইউনূস বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে রোসাটমের অব্যাহত সহায়তার প্রশংসা করেন এবং বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে শেষ করার ওপর জোর দেন।
'আমরা আপনার সহায়তার জন্য অপেক্ষায় আছি, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,' লিখাচেভকে উদ্দেশ করে বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোচ্ছে কাজ
লিখাচেভ জানান, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে চলছে এবং ইতোমধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জিত হয়েছে।
'বাংলাদেশের জনগণের যেকোনো সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ,' বলেন তিনি।
তিনি ইউনূসকে জানান, বর্তমানে প্রকল্পের ড্রাই রান চলছে এবং শিগগিরই পরীক্ষামূলক পরিচালনা শুরু হবে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ড্রাই রান এমন একটি পরীক্ষা, যেখানে প্রকৃত সরঞ্জাম বা সম্পদ ব্যবহার না করেই পরিচালনার মহড়া দেওয়া হয়। এরপর পরীক্ষামূলক পরিচালনা শুরু হবে, যেখানে প্রকৃত সরঞ্জাম ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যক্রম পরীক্ষা করা হবে।
লিখাচেভ আরও আশ্বস্ত করেন, রোসাটম সুরক্ষা, গুণগত মান ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সফল সমাপ্তির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাবে।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া, সিনিয়র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন এবং ইআরডি সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার খোজিন, ফেডারেল এনভায়রনমেন্টাল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড নিউক্লিয়ার সুপারভিশন সার্ভিসের ডেপুটি চেয়ারম্যান আলেক্সি ফেরোপন্টভ, রোসাটমের ফার্স্ট ডেপুটি-ডিরেক্টর আন্দ্রে পেট্রোভ এবং এএসই জেএসসির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও রূপপুর এনপিপির প্রকল্প পরিচালক আলেক্সি ডেরি।
রাশিয়ার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া
ইআরডি সচিব শাহরিয়ার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ঋণ বিতরণের সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাবে রাশিয়া ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে আমরা সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিচ্ছি।'
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ান প্রতিনিধিদল ইআরডির সঙ্গে একটি প্রস্তুতিমূলক বৈঠক করে। এতে ইআরডি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ঋণ বিতরণ ও পরিশোধের সময়কাল বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধের নির্ধারিত সময় ১৫ মার্চ ২০২৭। তবে, পুরো অর্থ যথাসময়ে পরিশোধ করা সম্ভব না হওয়ায় বাংলাদেশ ১৫ মার্চ ২০২৯ থেকে পরিশোধ শুরুর প্রস্তাব দিয়েছে। প্রোটোকল স্বাক্ষরের সময় বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।
বর্তমানে রাশিয়ার কাছে বাংলাদেশের দেনার পরিমাণ ৭৫০ মিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণের জন্য নেওয়া হয়েছিল। বাকি অংশ ঋণের সুদ ও বকেয়া সুদের অন্তর্ভুক্ত।
৯৪ শতাংশ সম্পন্ন ইউনিট-১, ৭৬ শতাংশ সম্পন্ন ইউনিট-২
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোকাব্বির হোসেন টিবিএসকে জানান, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিট-১-এর কাজ ৯৪ শতাংশ এবং ইউনিট-২-এর ৭৬ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ঋণ বিতরণের সময়সীমা বাড়ানোয় বাকি কাজ দ্রুত এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের তথ্যানুসারে, গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত কাজের ৬৭.৮ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে এবং আর্থিক অগ্রগতিও একই হারে এগোচ্ছে।
প্রকল্পটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। ২০২৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাশিয়া থেকে পারমাণবিক জ্বালানির প্রথম চালান বাংলাদেশে আসে এবং ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। এ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অনুষ্ঠানে পুতিন জানান, ২০২৬ সালের মধ্যে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরোপুরি চালু হবে।
রাশিয়া থেকে ইউরেনিয়াম সরবরাহের ফলে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পারমাণবিক স্থাপনায় পরিণত হয়েছে। তবে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণে বিলম্বের কারণে ২০২৬ সালে প্রকল্পটির পূর্ণাঙ্গ কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
জাতীয় গ্রিডে ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ হবে
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু হলে জাতীয় গ্রিডে ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হবে। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ২০২৩ সালে গ্রিড সংযোগ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। তবে বিলম্বের কারণে ২০২৪ সালের অক্টোবরে নতুন সময়সীমা নির্ধারণ করা হলেও তা পূরণ হয়নি।
গ্রিড লাইন স্থাপনের দায়িত্বে থাকা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (বাংলাদেশ) জানিয়েছে, আগামী মার্চের মধ্যে কাজ শেষ হবে। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেও পুরো ইনস্টলেশন শেষ নাও হতে পারে।
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি, রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির টিবিএসকে বলেন, ঋণ বিতরণের সময়সীমা বাড়ানো রাশিয়ার একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, যা তাদের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা স্বীকার করার ইঙ্গিত।
তিনি এটিকে বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন এবং রাশিয়ার সিদ্ধান্তকে কৌশলগতভাবে 'সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া' বলে অভিহিত করেছেন। কবির আরও বলেন, রূপপুর প্রকল্প ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য বড় কোনো প্রকল্প বা বাণিজ্য নেই। এছাড়া, রাশিয়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকায় ব্যবসা সম্প্রসারণের সম্ভাবনা অনেকটাই নির্ভর করছে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ওপর।
রূপপুর প্রকল্পের পরিচালক মো. জাহেদুল হাসান জানান, মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গ্রিড লাইন সংযোগের জটিলতাসহ নানা কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন পিছিয়ে গেছে।
তিনি জানান, এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৬ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুরোপুরি চালু হবে।
২০২৫ সালের মধ্যে কেন্দ্রের একটি ইউনিট জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধান যন্ত্রপাতি স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পাইপলাইন পরীক্ষার কাজও শেষ হয়েছে। বর্তমানে স্টার্ট-আপ ও সমন্বয়ের কাজ চলছে।