বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ 'মিথ্যা' ও 'ভিত্তিহীন' প্রচারণা চালাচ্ছে, দাবি টিউলিপের

সাবেক লেবার মন্ত্রী এবং যুক্তরাজ্যের এমপি টিউলিপ সিদ্দিক অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ তাকে 'লক্ষ্যবস্তু' বানিয়ে তার বিরুদ্ধে 'ভিত্তিহীন' প্রচারণা চালাচ্ছে। খবর বিবিসির।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে সিদ্দিকের আইনজীবীরা বলেন, টিউলিপের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো 'মিথ্যা ও হয়রানিমূলক'। তারা দাবি করেন, আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে কিছু জানানো হয়নি, অথচ গণমাধ্যমে এসব অভিযোগ প্রচার করা হচ্ছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ে অর্থনৈতিক সচিবের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন সিদ্দিক। সে সময় তিনি জানান, কোনো অন্যায় করেননি, তবে সরকারের কাজে 'বাধা' হতে চান না।
তবে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বিবিসিকে জানান, তাদের তদন্ত নির্ভর করছে 'দুর্নীতির যথাযথ প্রমাণের ওপর'। তিনি বলেন, 'টিউলিপ সিদ্দিক আদালতে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ পাবেন। আমি তাকে আহ্বান জানাই, যেন তিনি যথাযথ আইনি সহায়তা নিয়ে তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।'
টিউলিপের আইনজীবীরা দুদকের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুললেও, মোমেন তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, দুদক পেশাদারভাবে কাজ করে এবং গণমাধ্যমকে নিয়মিত ব্রিফিং দেওয়া তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমের অংশ।
এর আগে, টিউলিপ নিজেই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের নৈতিকতা উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাসের কাছে বিষয়টি তদন্তের জন্য পাঠান। ম্যাগনাস তার প্রতিবেদনে জানান, তিনি কোনো অনিয়মের প্রমাণ পাননি। তবে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার আত্মীয় হওয়ার কারণে টিউলিপের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল।
মূলত জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম-এর প্রতিষ্ঠাতা ববি হাজ্জাজের করা অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতের ব্যয় থেকে প্রায় ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক।
আদালতে দাখিল করা দলিল থেকে বিবিসি জানতে পেরেছে, ববি হাজ্জাজ অভিযোগ করেছেন, ১০ বিলিয়ন পাউন্ডের রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নিয়ে রাশিয়ার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের মধ্যস্থতা করেছিলেন টিউলিপ সিদ্দিক। এখানে খরচ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল বলে দাবি করা হয় অভিযোগে।
এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ল ফার্ম স্টিফেনসন হারউডের মাধ্যমে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে মস্কোর ক্রেমলিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সিদ্দিকের একটি ছবি থাকলেও, তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তিতে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, 'রাষ্ট্রীয় সফরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকার ঘটনা বিরল কিছু নয়।'
এতে আরও বলা হয়, ২০০৪ সালে লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় সিদ্দিককে উপহার দেওয়া ৭ লাখ পাউন্ডের একটি ফ্ল্যাট নিয়ে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা 'অযৌক্তিক ও অবাস্তব', কারণ ওই সম্পত্তি তিনি পারমাণবিক প্রকল্প চুক্তির ১০ বছর আগেই পেয়েছিলেন।
তবে লরি ম্যাগনাস অভিযোগের তদন্তে বলেছেন যে, দীর্ঘ সময় ধরে, কিংস ক্রসের ফ্ল্যাটে তার মালিকানার উৎস সম্পর্কে অবগত ছিলেন না টিউলিপ, যদিও সেই সময়ে উপহার সংক্রান্ত একটি ভূমি হস্তান্তর নিবন্ধন ফর্মে স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি।
লরি ম্যাগনাস আরও বলেন, টিউলিপের ধারণা ছিল, তার বাবা-মা তার জন্য সম্পত্তিটি কিনেছেন কিন্তু সরকারের মন্ত্রী হওয়ার পর তাকে রেকর্ডটি সংশোধন করা উচিত ছিল।
তিনি এটিকে 'দুর্ভাগ্যজনক ভুল বোঝাবুঝি' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যার ফলে, জনসাধারণ 'এই উপহারদাতার পরিচয় সম্পর্কে অসাবধানতাবশত বিভ্রান্ত হয়েছে'।
টিউলিপ সিদ্দিকের আইনজীবীরা নিশ্চিত করেন যে, ফ্ল্যাটটি তাকে উপহার দিয়েছিলেন আব্দুল মোতালিফ নামের এক ব্যক্তি, যাকে তারা 'ঘনিষ্ঠ পারিবারিক বন্ধু ও অভিভাবকতুল্য' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, দুদক যেভাবে গণমাধ্যমে সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থাপন করেছে, তা 'যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অপচেষ্টা'। এতে দাবি করা হয়, 'দুদক বা বাংলাদেশ সরকারের কোনো সংস্থা কখনও সিদ্দিকের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অভিযোগ উপস্থাপন করেনি।'
চিঠিতে আরও বলা হয়, 'কোনো পর্যায়েই টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো ন্যায়সঙ্গত, সঠিক ও স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করা হয়নি, বরং আদৌ কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগও তোলা হয়নি—দুদক বা বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে।'
এতে উল্লেখ করা হয়, 'দুদকের উচিত অবিলম্বে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ তৈরি বন্ধ করা এবং গণমাধ্যমে সিদ্দিকের মানহানি করার উদ্দেশ্যে দেওয়া ব্রিফিং ও প্রকাশ্য মন্তব্য থেকে বিরত থাকা।'
চিঠিতে টিউলিপের আইনজীবীর স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, 'দুদককে অবিলম্বে ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে প্রশ্ন উত্থাপন করতে হবে', অন্যথায় তারা ধরে নেবে যে, 'টিউলিপের বিরুদ্ধে কোনো বৈধ প্রশ্ন নেই।'
এদিকে, দুদক বিবিসিকে জানিয়েছে, তারা টিউলিপের আইনজীবীদের উদ্দেশে একটি জবাব পাঠিয়েছে। দুদকের একজন মুখপাত্র ওই চিঠিতে দাবি করেন, টিউলিপ সিদ্দিক তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশিরভাগ সময় 'আওয়ামী লীগের দুর্নীতিগ্রস্ত সহযোগীদের মালিকানাধীন বাড়িতে' কাটিয়েছেন, যা তার এই দল দ্বারা সুবিধাপ্রাপ্ত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
তিনি আরও বলেন, টিউলিপের 'শেখ হাসিনার শাসন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার দাবি বিশ্বাসযোগ্য নয়'। এবং দুদক টিউলিপের আইনজীবীদের সঙ্গে 'যথাসময়ে' যোগাযোগ করবে বলেও জানানো হয়।