এলডিসি উত্তরণের পর রপ্তানিকারকদের যেভাবে সুবিধা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার

শুল্কমুক্ত রপ্তানি, সরাসরি নগদ সহায়তা ও কারেন্সি রিটেনশনের মতো বেশকিছু সুবিধার মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে আসায় দেশের রপ্তানিকারকদের শক্তিশালী করা এবং স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পর রপ্তানিচালিত শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতার লক্ষ্যে সরকার আসন্ন রপ্তানি নীতিতে উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর দেখা রপ্তানি নীতি ২০২৪–২৭-এর খসড়ায় নগদ প্রণোদনার বিকল্প হিসেবে প্রধান রপ্তানি পণ্য উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যুৎ বিলের ওপর ৫–১০ শতাংশ রেয়াতের প্রস্তাব করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এছাড়া রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সকল ধরনের লাইসেন্সিং ফি মওকুফ করা এবং মূলধনী ও খুচরা যন্ত্রপাতি আমদানিতে আরোপিত শুল্কহার সর্বোচ্চ ১ শতাংশ বহাল রেখে বাকি সব ধরনের শুল্ককর হতে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে বলেও প্রস্তাব করেছে মন্ত্রণালয়। এটি রপ্তানিকারকদের জন্য ব্যবসায়িক খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করবে।
প্রতি তিনবছর পরপর প্রণীত রপ্তানি নীতিতে রপ্তানিকারকদের জন্য দেওয়া সহায়তা প্যাকেজে এ ধরনের সংশোধন খুব কমই দেখা যায়। চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ নীতিমালার সর্বশেষ খসড়া অনুমোদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)-এর জ্যেষ্ঠ ফেলো ড. মোস্তফা আবিদ খান টিবিএসকে বলেন, দেশের এলডিসি-পরবর্তী রপ্তানি পরিস্থিতি সরকারের নীতির ওপর নির্ভর করবে।
তিনি বলেন, 'এলডিসি উত্তরণের পর নগদ সহায়তার বিকল্প হিসেবে সরকার কি কি সুবিধা দেবে, তা বিস্তারিতভাবে রপ্তানি নীতিতে উল্লেখ করা যৌক্তিক হচ্ছে না। রপ্তানিখাতে বিদ্যুৎ বিলে যে রেয়াত দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, ডব্লিউটিও'র [বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা] নিয়মানুযায়ী তা আদৌ দেওয়া সম্ভব হবে কি না, সেটাও অনিশ্চিত,' তিনি বলেন।
মোস্তফা আবিদ বলেন, ভারত রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউটিও'র কাছে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে। এখন ভারত এ সুবিধাগুলোর বেশ কয়েকটি প্রত্যাহার করার চিন্তা করছে।
২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণ বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় একটি মাইলফলক হলেও এটি নানা চ্যালেঞ্জও তৈরি করবে। রপ্তানি খাত অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি হারানো এবং বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।
মোস্তফা আবিদ বলেন, ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন [ইইউ] এবং যুক্তরাজ্য উভয় দেশেই বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা বজায় থাকবে এবং বর্তমান রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না।
'বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৭৩ শতাংশ প্রেফারেন্সিয়াল [অগ্রাধিকার] সুবিধার আওতায় পরিচালিত হয় — এর বেশিরভাগ সুবিধা পাওয়া যায় ইইউ ও যুক্তরাজ্যের বাজারে। জাপানের সঙ্গে ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (ইপিএ) স্বাক্ষর হলে সেখানেও শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে,' বলেন তিনি।
পরিকল্পনা বিভাগের একটি সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা হাতছাড়া হওয়ার কারণে আনুমানিক সাত বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তবে এ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সরকার ২০২৭ সালের মধ্যে পণ্য ও সেবা রপ্তানিতে ১১০ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে, যাকে উচ্চাভিলাষী বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকেরা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, ভারত তার শিল্প খাতে পাঁচ রুপিতে এবং রপ্তানিমুখী শিল্পে তিন রুপিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বাংলাদেশে শিল্পখাতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ১৩ টাকা — ১০ শতাংশ তথা এক টাকা তিন পয়সা ছাড় দেওয়া হলে তা খুবই নগণ্য হবে। এটা রপ্তানিকারকদের খুব একটা সাহায্য করবে না।
'সরকারের কাছে বিদ্যুৎ এবং গ্যাস উভয় বিলেই ছাড় দেওয়ার বিকল্প রয়েছে। এছাড়া বর্তমানে রপ্তানিকারকদের ওপর বিদ্যমান ১ শতাংশ অগ্রিম আয়কর কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা যেতে পারে,' তিনি বলেন।
'ভারত সরকার রপ্তানিকারকদের প্রতি কেজি সুতা, ফ্যাব্রিক বা তৈরি পোশাক রপ্তানির বিপরীতে ১১ রুপি মূল্যের বন্ড প্রদান করে। যদি কোনো ব্যবসায়ী এসব পণ্যের এক লাখ কিলোগ্রাম রপ্তানি করেন, তারা পরবর্তীকালে গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে বন্ড থেকে ১১ লাখ রুপি ব্যবহার করতে পারেন,' বাংলাদেশে একই ধরনের সুবিধা রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন হাতেম।
নতুন নীতিমালায় কী আছে?
খসড়া রপ্তানি নীতিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে রপ্তানিখাতে থাকা প্রণোদনার মধ্যে রয়েছে ডিউটি ড্রব্যাক স্কিম, সুদহারে ভর্তুকি, স্পেশাল বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা, ব্যাক-টু-ব্যাক লেটার অব ক্রেডিট (ঋণপত্র) ব্যবস্থা, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) সুবিধা, রপ্তানিমুখী শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি, নগদ প্রণোদনা, আয়কর রেয়াত, কারেন্সি রিটেনশন স্কিম, রপ্তানি ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল, রপ্তানির ওপর ভ্যাট অব্যাহতি, রপ্তানিকারকদের জন্য ভ্যাট ফেরত দেওয়া ইত্যাদি।
প্রস্তাবিত নীতি অনুযায়ী, প্রাপক দেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে রপ্তানি প্রণোদনা, আয়কর রেয়াত ও কারেন্সি রিটেনশন স্কিম বাড়ানো যাবে না। তবে ডিউটি ড্রব্যাক, আমদানি ও রপ্তানিকৃত উৎপাদন ইনপুটগুলোর ওপর ভ্যাট অব্যাহতি, রপ্তানিকারকদের ভ্যাট ফেরত, ইপিজেড সুবিধা, ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা ও স্পেশাল বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা চালু রাখা যাবে।
বর্তমানে পণ্য রপ্তানিকারকেরা তাদের রপ্তানির বোর্ডভ্যালুর ওপর ৬০ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা রিটেনশনের কোটা পান।
রপ্তানি ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের কার্যকারিতা এলডিসি উত্তরণের পরে দীর্ঘমেয়াদি অপারেটিং খরচ অন্তর্ভুক্ত করার ওপর নির্ভর করে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে দেওয়া ঋণের সুদহার আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে বিদ্যমান সুদহারের চেয়ে কম হতে পারে না।
খসড়া রপ্তানি নীতি অনুসারে, ইডিএফ রপ্তানিমুখী যেসব শিল্প কারখানায় সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় সেগুলোতে গ্রিন এনার্জি ইউনিট স্থাপনের জন্য স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করবে। বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র (ইটিপি) এবং পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণের জন্যও ঋণ দেওয়া হবে।
রপ্তানি শিল্পের জন্য বন্ড সুবিধা সম্প্রসারণের বিষয়ে খসড়া নীতিতে রপ্তানি পণ্যের জন্য আমদানি করা কাঁচামালের ওপর শুল্ক হার ধীরে ধীরে কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য একটি কেন্দ্রীয় বন্ডেড ওয়্যারহাউজ স্থাপনের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সম্ভাব্যতা মূল্যায়ন করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
একটি জাতীয় লজিস্টিক নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে লজিস্টিক সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমানোর চেষ্টা করা হবে। এছাড়া খসড়া রপ্তানি নীতির আরেকটি লক্ষ্য হলো গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি) উদ্যোগের মাধ্যমে গ্রাহকের চাহিদা পূরণের জন্য উদ্ভাবনী, অধিক মূল্য সংযোজিত পণ্যের উন্নয়ন এবং রপ্তানিকে উৎসাহিত করা।
খসড়া নীতিতে বলা হয়েছে, রপ্তানি পণ্যের গুণগত মান যাচাই ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে সরকারি সহায়তায় আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করা হবে। রপ্তানিকারকদের প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান, পণ্যের ব্র্যান্ডিং ও মান উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের পাশাপাশি সেবা খাতে রপ্তানি বাড়াতে কনসালটেন্সি সার্ভিস, সফটওয়্যার বাস্তবায়ন, ডেটা প্রসেসিং, ডেটাবেইজ, আইটি ও আইটি-সক্ষম পরিষেবার গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া হবে।
আন্তঃসীমান্ত সেবা রপ্তানির ক্ষেত্রে রপ্তানি আয় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে লেনদেন করলে ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হবে। একইভাবে বিদেশে সেবা তৈরির পর ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আয় দেশে ফিরিয়ে আনলে রপ্তানিকারক রেমিট্যান্স প্রণোদনার সমান হারে প্রণোদনা পাবেন। যদি বাংলাদেশি জাহাজ দ্বারা ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি'র অধীনে পণ্য পরিবহন করা হয়, তাহলে শিপিং কোম্পানি ফ্রেইট চার্জের ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা পাবে।
সেবা রপ্তানি বাড়াতে সরকার সারাদেশে সাশ্রয়ী মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করবে। ই-কমার্সের মাধ্যমে রপ্তানি বাড়াতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, ই-কমার্সের মাধ্যমে রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রাপ্য বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক একটি স্বতন্ত্র, কার্যকর ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এটি বাংলাদেশি সেবাদাতাদের সেবা রপ্তানির জন্য বিদেশে অফিস, শাখা বা সহায়ক সংস্থা স্থাপনের অনুমতি দেবে।
বাংলাদেশে পর্যটক ভিসা পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করা হবে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আকৃষ্ট করতে উন্নতমানের আবাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বাস্তবায়ন করা হবে।
জনশক্তি রপ্তানিতে গুণগত মান বাড়াতে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে। পাশাপাশি ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি, চীনা মান্দারিন, ফরাসি, স্প্যানিশ, আরবি ও জাপানিজের মতো বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভাষার শিক্ষা প্রসারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রস্তাবিত রপ্তানি নীতি অনুযায়ী বেসরকারিভাবে ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে প্রণোদনা দেওয়া হবে।
উচ্চাভিলাষী রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা
বিদ্যমান নীতি আদেশ ২০২১-২৪-এ দেশের রপ্তানি আয় ৮০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
তবে বিশ্বজুড়ে কোভিড সংক্রমণ এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মন্দা পরিস্থিতিতে তা অর্জন সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২–২৩ অর্থবছর শেষে পণ্য ও সেবা রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ মোট আয় করেছে ৬৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরের জুনের শেষ নাগাদ ৭২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।