টিউলিপের তদন্ত: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে নিয়ে অপপ্রচার, টার্গেট ব্রিটিশ এমপিরা

ব্রিটিশ এমপিরা মনে করেন, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থের সন্ধানে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিকে হেয় করার জন্য একটি 'বিভ্রান্তিকর তথ্য' প্রচারণার লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্পর্কে একাধিক ই-মেইল পাওয়ার পর ব্রিটিশ এমপিরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মনসুরকে গত বছর বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ১৩ আগস্ট তাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ড. আহসান এইচ মনসুর বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন। তিনি সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সাহায্য চাইছেন। তার উদ্দেশ্য, হাসিনা সরকারের সহযোগীদের চুরি করা কোটি কোটি ডলার উদ্ধার করা। তিনি ধারণা করছেন, কিছু টাকা যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি কেনার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
তার সফর নিয়ে ইতোমধ্যে তীব্র বিতর্কে দেখা গেছে, যা হাসিনার ভাগ্নি এবং যুক্তরাজ্যের সাবেক সিটি মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের সাথে সম্পর্কিত। এই বছর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) টিউলিপের বিরুদ্ধে একটি অপরাধমূলক মামলা দায়ের করে। এরপর তিনি পদত্যাগ করেন। তবে, টিউলিপ সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এখন এমপিরা উদ্বিগ্ন। তারা আশঙ্কা করছেন, ভুয়া সাংবাদিকরা ড. মনসুরকে নিয়ে অপপ্রচার চালানোর ফলে বাংলাদেশকে ব্রিটেনের সহায়তা করার প্রচেষ্টা আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
৪৭ সদস্যবিশিষ্ট সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি গ্রুপ (এপিপিজি) অন রেসপনসিবল ট্যাক্স অ্যান্ড করাপশনের সংসদ সদস্যরা সোমবার মনসুরের সঙ্গে এক অধিবেশনের আগে ই-মেইল পেয়েছিলেন। প্রেরক নিজেকে সাংবাদিক বলে দাবি করেন এবং 'ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্ট' নামের একটি ওয়েবসাইটের লিংক পাঠান। সেখানে মনসুরের কন্যার বিত্তবৈভবের প্রদর্শন সম্পর্কিত কিছু নিবন্ধ ছিল। সেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, কেন তার মেয়েকে নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে না।
প্রতিবেদনগুলোর কথিত লেখকদের কোনো সাংবাদিক পরিচয় নেই। দ্য গার্ডিয়ান তাদের ছবি সম্পর্কে খোঁজ করে জানতে পারে, আসলে স্টক ইমেজ (ছবি)।
মনসুর ও কমিটির সংসদ সদস্যরা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, এই ইমেইলগুলো একটি সংগঠিত বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার অংশ হতে পারে।
মনসুর এর আগে আইএমএফ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ওয়াশিংটনে বসবাস ও কাজ করেছেন। তিনি বলেন, অর্থপাচার তদন্তের আওতায় থাকা ব্যক্তিরা 'আমার সুনাম ক্ষুণ্ন করতে ও বিভিন্নভাবে লক্ষ্যবস্তু বানাতে চাইছেন'।
তিনি আরও বলেন, তার মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং বাংলাদেশের সঙ্গে তার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।
এপিপিজি সদস্য রুপা হক 'ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্ট'-এর লিংকসহ যুক্তরাজ্যের জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান প্যালাটিন কমিউনিকেশনস থেকে আলাদা একটি ই-মেইল পান।
ইমেইলে বলা হয়, যদি মনসুর 'টিউলিপ সিদ্দিকের সততা প্রশ্নবিদ্ধ' করতে চান, তবে তাকে ও তার পরিবারকেও তদন্তের মুখোমুখি হতে হবে।
ড. মনসুর বলেন, তিনি কখনোই টিউলিপ সিদ্দিক সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি।
তবে, তিনি মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ড. ইউনূসের মেয়াদেই দুর্নীতি দমন কমিশন ২০১৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে করা একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তির তদন্তে টিউলিপ সিদ্দিক ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে।
রুপা হক বলেন, এ ধরনের ই-মেইল পাওয়া 'অনেক বেশি অস্বাভাবিক'। তিনি এটিকে সেই প্রতিবাদের সঙ্গে তুলনা করেন, যেখানে সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে তার বক্তব্যের বিরোধিতা করা হয়েছিল। তার মতে, দুটোই 'সংসদ ও এমপিদের স্বাভাবিক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ ও ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে করা হয়েছে'।
এপিপিজির সদস্যরা এই ইমেইলগুলো সংসদের সাইবার নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের কাছে পাঠিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি, এগুলো সংসদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতেও পাঠানো হয়েছে, যা বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা নিয়ে তদন্ত করছে।
এপিপিজি-এর সদস্য ফিল ব্রিকেল বলেন, 'যদি এই বার্তা যুক্তরাজ্যের রাজনীতিবিদদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়ে থাকে, বিশেষ করে একটি গুরুতর দুর্নীতির ঘটনায়, তাহলে আমাদের সত্যিই উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।'
তিনি সংসদীয় কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'কে এর পেছনে রয়েছে এবং কেন এটি করা হয়েছে, তা জানা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে নিজেদের সুরক্ষিত রাখা যায়।'
প্যালাটিন কমিউনিকেশনের এক মুখপাত্র বলেন, 'আমাদের গ্রাহকদের তথ্য গোপনীয়। যেই ই-মেইল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এই প্রতিবেদনের লেখক সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই এবং এতে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে এটিকে আমরা নির্ভুল বলে দাবি করিনি। অনেক গণমাধ্যমের মতোই, এটি বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে, যা এমপিদের বিবেচনার যোগ্য বলে আমরা মনে করি।'
ইন্টারন্যাশনাল পলিসি ডাইজেস্টের এক মুখপাত্র জানান, প্রতিবেদনের প্রকৃত লেখক নিজেকে গোপন রাখতে চেয়েছেন। তবে তারা নিশ্চিত, এর বিষয়বস্তু 'মোটামুটি সঠিক'।