শতাধিক আসনে নৌকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ দলের স্বতন্ত্র হেভিওয়েট প্রার্থী

শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের জয়ের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দলের হেভিওয়েট স্বতন্ত্র প্রার্থী। এসব প্রার্থীর মধ্যে রয়েছেন দলের মনোনয়ন বঞ্চিত ২৬ এমপি, সদ্য পদত্যাগকৃত উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী নেতারা।
আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা বলছেন, তারা মনে করেছিলেন নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র দাখিলের আগেই দলের সিদ্ধান্ত আসবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা আসেনি। এদিকে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা মনোনয়ন বাছাই শেষে ঝুঁকিপূর্ণ এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নির্বাচনের যোগ্য বলে ঘোষণা করেছে।
তবে দলের কেন্দ্র বলছে আগামী ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনের আগেই দলের পক্ষ থেকে এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে নির্দেশনা দেবেন দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নির্বাচনের আগে এসব আসনে দলীয় ও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনাও ইতোমধ্যে ঘটেছে।
যেমন বরিশাল-৫ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রতীকের প্রার্থী হলেন বর্তমান পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম। এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের জন্য জেলা রিটার্নিং অফিসার দ্বারা যোগ্য হিসেবে চূড়ান্ত হয়েছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র, বর্তমান নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ।
এই আসনে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর মনোনয়ন প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রীসহ দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অনুরোধ জানিয়েছেন দলের মনোনীত প্রার্থী জাহিদ ফারুক। কিন্তু নির্বাচনে লড়ার ঘোষণায় এখনো অনড় সাদিক আব্দুল্লাহ।
ফরিদপুর-৩ আসনে দলের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এ কে আজাদ নির্বাচন করছেন।
এ কে আজাদ দেশের তৈরি পোশাক খাতে একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও একটি বেসরকারি টেলিভিশন এবং প্রভাবশালী একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার মালিক। এই ব্যবসায়ী অনেক বছর আগে থেকে এলাকায় ব্যক্তিগতভাবে নানাধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করে আসছেন। এছাড়াও দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাথে বেশ সখ্যতা তৈরি এলাকায় বেশ প্রভাব তৈরি করেছেন।
শুধু এরকম স্বতন্ত্র প্রার্থীই নয়। দলের মনোনয়ন বঞ্চিত বর্তমান ৭১ এমপির মধ্যে ২৬ জনই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে জেলা রিটার্নিং অফিসে যোগ্য ঘোষিত হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নেতারা জানিয়েছেন, এরকম শতাধিক আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের জয়লাভের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতা ও মনোনয়ন বঞ্চিত এমপিরা।
দলের মনোনয়ন বঞ্চিত ৭১ এমপির মধ্যে ২৬ জন নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করলেও বঞ্চিত অন্যরাও নৌকার জয় ঠেকাতে কৌশলে অবস্থান নিয়েছে বলে দলের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা টিবিএসকে জানিয়েছেন।
যদিও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বুধবার টাঙ্গাইলের একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, 'নৌকার বাইরে যারা নির্বাচন করছে, আমার দৃষ্টিতে তারা অবশ্যই বিদ্রোহী প্রার্থী।'
তিনি বলেন, 'আমি মনে করি, দলের কোনো নেতাকর্মীর দল বা নৌকার বাইরে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। যারা দলের আদর্শ মেনে চলে তাদের অবশ্যই নৌকার পক্ষে কাজ করতে হবে। এই নৌকাকে আমরা বলি হক ভাসানীর নৌকা, এই নৌকা বঙ্গবন্ধুর নৌকা, এই নৌকা আওয়ামী লীগের নৌকা, এই নৌকা শেখ হাসিনার নৌকা। তাই নৌকার বাইরে কাজ করার সুযোগ নেই।'
আওয়ামী লীগ গত ১৮ থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ৩৩৬২টি দলীয় মনোনয়ন বিক্রয় করে। ২৬ নভেম্বর যার মধ্যে থেকে ২৯৮ আসনে ৩০৪ জন প্রার্থী চূড়ান্ত করে। চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ পড়েন ৭১ জন বর্তমান এমপি। দলীয় প্রার্থী ঘোষণার আগে দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল মনোনয়ন প্রত্যাশীর সাথে ২৬ নভেম্বর সকালে মতবিনিময় সভা করেন। ওই সভায় দলের যেকোনো নেতা 'ডামি' প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারবে বলে নির্দেশনা দেন।
এরপরই বাদ পড়া ৭১ জন এমপির মধ্যে ২৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন থেকে মনোনয়ন নেয়। এছাড়াও দলের মনোনয়ন নিয়ে বিভিন্ন উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়া ৫০ জন দলটির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করার জন্য ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে তারাও স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করতে মনোনয়ন সংগ্রহ করে। প্রায় সাড়ে ৪০০ আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে মনোনয়ন নিয়েছিলেন। স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়ন নেয়া এসব প্রার্থীদের মধ্যে প্রায় আড়াইশ প্রার্থী নির্বাচনে যোগ্য বলে ঘোষিত হয়েছে জেলা রিটার্নিং অফিসে।
দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় 'স্বতন্ত্র' প্রার্থী নয়, 'ডামি' প্রার্থীর কথা বলা হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী আর ডামি প্রার্থী এক জিনিস নয়। ডামি প্রার্থী জেতার প্রার্থী নয়। এটা বলা হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাতে নির্বাচন না হয় সেজন্য। আর স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থীর ব্যাখ্যা অন্য জিনিস। নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করতে অনেকেই ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কিনেছিলেন তারা কোনো অবস্থাতেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করতে পারবেন না। কেউ করলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। এ বিষয়ে তৃণমূলকে সহজ-সরল ভাষায় পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেওয়া হবে বলেও জানান আওয়ামী লীগের এই নেতা।
তিনি বলেন, দলের প্রধান শিগগিরই নির্দেশনা দেবেন এ বিষয়ে। যারা মানবে না, তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।
যেসব আসন নৌকার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করেছে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী
ঢাকা-১৯ আসনে বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ডা. এনামুর রহমান, এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মোহাম্মদ তৌহিদ জং মুরাদ। রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন আওয়ামী লীগ থেকে তিনবার মনোনয়ন পেয়ে এমপি হওয়া ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক এনা। এছাড়াও রাজশাহীর আরো দুইটি আসনে দলের মনোনয়ন বঞ্চিত ২ এমপি স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন। পঞ্চগড়-১, গাইবান্ধা-৪, নওগাঁ-৩, নওগাঁ-৪, মেহেরপুর-২, ঝিনাইদহ-৩, যশোর-৪, সাতক্ষীরা-২, বরিশাল-৪, টাঙ্গাইল-৫, জামালপুর-৪, ময়মনসিংহ-৩, ঢাকা-৫, গাজীপুর-৩, সুনামগঞ্জ-১, সুনামগঞ্জ-২, হবিগঞ্জ-১, হবিগঞ্জ-২,কুমিল্লা-৮, চট্টগ্রাম-১২, কক্সবাজার-১, ফরিদপুর-৩ আসনে নৌকা প্রতীকের মনোনীত প্রার্থীর পাশাপাশি স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত বর্তমান এমপিরা।
এছাড়াও নরসিংদী-৩ (শিবপুর) আসনে হেভিওয়েট স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম।
দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত প্রায় ২৬ জন উপজেলা চেয়ারম্যান স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করার জন্য যোগ্য ঘোষিত হয়েছে।
একইসাথে বিভিন্ন আসনে দলের স্থানীয় প্রভাবশালীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের যোগ্য বলে ঘোষণা করেছে জেলা রিটার্নিং অফিস।