আওয়ামী লীগের পতনের সাথে সাথে যেভাবে মালিকানায় পরিবর্তন হলো স্বদেশ প্রপার্টিজের

গত বছরের ৫ আগস্টে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকার পতনের পর কয়েক হাজার কোটি টাকা মূল্যের আবাসন খাতের কোম্পানি স্বদেশ প্রপার্টিজের মালিকানা সাবেক আওয়ামী সংসদ সদস্য (এমপি) ওয়াকিল উদ্দিনের থেকে বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুমের কাছে হস্তান্তর হয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে হয় এ হাতবদল। ওয়াকিল উদ্দিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার দায়ে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে, বর্তমানে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপত্তি হারালেও কোম্পানিতে এখনো তার বিপুল শেয়ার রয়ে গেছে, ফলে পালিয়ে থাকা অবস্থাতেও তিনি এর সুবিধাভোগী হচ্ছেন কিনা– এমন প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে।
এদিকে স্বদেশ প্রপার্টিজের বিরুদ্ধে সরকারি খাস জমি ও ফ্লাড ফ্লো জোনের জমি দখলের অভিযোগ আছে। কার্যক্রম বন্ধে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নোটিশ দেওয়ার পরেও, নতুন মালিকানার অধীনে তা চলমান রয়েছে।
স্বদেশ প্রপার্টিজের বর্তমান পরিচালক ও কাইয়ুমের ছেলে নাভিদ তানভিন অনন্ত দাবি করেন, কোম্পানির শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন তার বাবা। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জোর করে তাকে বের করে দেন ওয়াকিল উদ্দিন।
তবে কোম্পানির নথিপত্রে এটি গঠনের সময় কাইয়ুমের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে পাওয়া কাগজপত্র বলছে, ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বদেশ প্রপার্টিজ নামের এই কোম্পানিটি নিবন্ধন পায়। ওয়াকিল উদ্দিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এবং তার দুই ছেলে– মো. ফরসাদ উদ্দিন ও মো. রিয়াসাদ উদ্দিন ছিলেন পরিচালকদের মধ্যে। কিন্তু, সেসময় এম এ কাইইয়ুমের সম্পৃক্ততার কোনো রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
আরজেএসসির রেকর্ডে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বরে স্বদেশ প্রপার্টিজের মালিকানা পরিবর্তনের আবেদন দাখিল করা হয় সংস্থাটির কাছে। ১ অক্টোবর কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নিয়োগ পান এমএ কাইয়ুম, এবং পরিচালক হন তার ছেলে– নাদিদ তানভিন অনন্ত। ওয়াকিল উদ্দিন ও তার দুই ছেলে মো. ফরসাদ উদ্দিন ও মো. রিয়াসাদ উদ্দিন ছিলেন এখনো কোম্পানির পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। কোম্পানির ২০ লাখ শেয়ারের মধ্যে— তাদের নামে এখনো প্রায় ১০ লাখ শেয়ার রয়েছে।
মালিকানায় পরিবর্তনের পরও রাজউকের নোটিশকে পাত্তা দেওয়া হয়নি
স্বদেশ প্রপার্টিজ লিমিটেড প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন- ২০০০ ও রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ লঙ্ঘন করায় গত ১২ ডিসেম্বর নোটিশ দেয় রাজউক।
কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, খাস জমি, ফ্লাড-ফ্লো জোন, বন্য এলাকা ও জলধারা ভরাটের কাজ এখনো চলছে।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'স্বর্ণালী আবাসন প্রকল্প রাজউকের অনুমতি নেয়নি স্বদেশ প্রপার্টিজ লিমিটেড। এজন্য তাদের কার্যক্রম স্থগিত করে নোটিশের মাধ্যমে জবাব চাওয়া হয়।'
রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় ৩০০ ফিট সড়কের পাশে প্রায় ২৫০ বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠা স্বদেশ প্রপার্টিজের 'স্বর্ণালী আবাসন' প্রকল্পটি আইন লংঘন করে খাস জমি, জলাধার, বন-এলাকা ও ফ্লাড-ফ্লো জোন দখল করে গড়ে ওঠেছে বলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও রাজধানীর মাদানী এভিনিউ এলাকায় ১০০ ফুট সড়কের পাশে গড়ে তেলা সানভ্যালি আবাসন প্রকল্পে ৩,৩০০ বিঘা সম্পত্তির মধ্যে বিশাল পরিমাণ সরকারি খাস জমি ও জলাধার রয়েছে বলে জানিয়েছে রাজউক।
আগে আওয়ামী সরকারের সময়ে এই কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিলেও– ওয়াকিল উদ্দিনের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বাস্তবায়ন করতে পারেনি রাজউক। কিন্তু এখন কোম্পানির মালিকানা বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুমের কাছে হস্তান্তর হওয়ায়, তার প্রভাবে কোনো ব্যস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন রাজউক কর্মকর্তারা।
@ প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজনৈতিক দলের নেতার মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক থাকার অভিযোগ
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন— রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) একজন শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'শাসক দলের পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, নিজদের অধিপত্য ধরে রাখতে— আওযামী লীগ নেতা ওয়াকিল উদ্দিন ও বিএনপি নেতা সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর এম এ কাইয়ুম মিলেমিশে বিভিন্ন ব্যবসা করেন। এছাড়াও গুলশান, বাড্ডা ও রামপুরা এলাকায় তাদের আধিপত্য ধরে রাখেন।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন এই ব্যবসা টিকে রাখতে ও নিজের উপার্জন সচল রাখতে— কাইয়ুমকে এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বানিয়েছেন পলাতক ওয়াকিল উদ্দিন। ব্যবসা ও প্রকল্প আগে যেরকম চলেছে, এখনও সেভাবেই চলছে।'
কাইয়ুমের রাজনৈতিক পরিচয়
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের গুলশান এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এম এ কাইয়ুম।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় হত্যার শিকার হন এনজিও কর্মী ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লা সিজার। ওই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের সাথে কাইয়ুমের নাম যুক্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার। এ অভিযোগ অস্বীকার করে কাইয়ুম দাবি করেছেন, সেসময় তিনি মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছিলেন।
বিদেশে নির্বাসিত থাকা অবস্থায় কাইয়ুম ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক হয়েছিলেন। সরকার পরিবর্তনের পর তিনি দেশে ফিরে এসে স্বদেশ প্রপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছেন।
এদিকে সাবেক এমপি ওয়াকিল উদ্দিন মালয়েশিয়া পালিয়ে গেছেন বলে আওযামী লীগের একাধিক সূত্র টিবিএসকে জানিয়েছে।
স্বদেশ প্রপার্টিজের বক্তব্য
কোম্পানির নতুন পরিচালক নাভিদ তানভিন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, 'আমরা আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ওয়াকিল উদ্দিনের আবাসন ব্যবসার হাল ধরেছি— এটি ভিত্তিহীন কথা। কারণ এই কোম্পানির শুরু থেকেই আমার বাবা এম এ কাইয়ুম জড়িত ছিলেন। কিন্তু, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কোম্পানি থেকে আমাদেরকে বের করে দেয় ওয়াকিল উদ্দিন। এখন পটপরিবর্তনের পর আমার বাবা দেশে ফিরেছেন, এবং আইনগত দিকগুলো মোকাবিলা করতে পারছেন। ফলে এখন কোম্পানির দায়িত্ব ফিরে পেয়েছি আমরা।'
স্বদেশ প্রপার্টিজকে রাজউক যে নোটিশ দিয়েছে, সে বিষয়ে নাভিদ তানভিন বলেন, 'কার্যক্রম বন্ধের নোটিশ দেয়ার পর আমরা অফিসিয়ালি (আনুষ্ঠানিকভাবে) উত্তর দিয়েছি। এখানে রাজউকের আর কিছু করার নেই। আমরা বৈধভাবেই ব্যবসা করছি।'
এদিকে একাধিকবার চেষ্টা করেও এম এ কাইয়ুমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা যায়নি।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী টিবিএসকে বলেন, 'কাইয়ুমের বিরুদ্ধে এপর্যন্ত এরকম কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। যে কেউ ব্যবসা করতে পারেন। কিন্তু গণহত্যার সাথে সরাসরি জড়িত কোনো ফ্যাসিস্ট সাবেক এমপির ব্যবসার হাল ধরার অভিযোগ কারো বিরুদ্ধে আসলে— দলীয় ফোরাম সে বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।'