ডেঙ্গুতে মৃত্যু: হাসপাতালে ভর্তির ৩ দিনের মধ্যেই মারা গেছেন ৮১% রোগী

চলতি বছর ডেঙ্গুতে যত মৃত্যু হয়েছে তার মধ্যে ৮১% রোগীর মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে।
বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এর সর্বশেষ পর্যবেক্ষণে এ তথ্য উঠে এসেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, হাসপাতালে ভর্তির তিনদিনের মধ্যে ডেঙ্গু রোগী বেশি মারা যাচ্ছে- এর অর্থ হলো যারা মারা যাচ্ছেন, তারা দেরি করে হাসপাতালে আসছেন। যখন রোগীরা হাসপাতালে আসছেন, তখন চিকিৎসকদের তেমন কিছু করার থাকছে না।
জ্বর হলে ডেঙ্গু পরীক্ষা ও ডেঙ্গু সনাক্ত হলে ফিজিশিয়ানদের কাছে যাওয়া ও ডেঙ্গুর ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষণ দেখলেই হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, রোববার (৩ আগস্ট) সকাল পর্যন্ত দেশে ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও ১৬ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে, ফলে মশাবাহিত এ রোগে সর্বশেষ মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৩৪ জনে। এছাড়া, প্রায় ২,৬০৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর ফলে এ বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ১ লাখ ৩০ হাজার ৩০২-এ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাশাপাশি, হু বাংলাদেশের তীব্রতর হতে থাকা ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হু'র একটি পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট অনুসারে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৫৯৩ জন। তাদের মধ্যে ৩২৭ জন বা ৫৫% ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তির এক দিনের মধ্যে। এবং হাসপাতালে ভর্তির ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে মারা গেছেন ১৫২ জন বা ২৬% রোগী।
তারা আরো জানিয়েছে, ৪-৫ দিন হাসপাতালে থাকার পর মৃত্যু হয়েছে ৭% রোগীর। ১০ দিন বা তার বেশি সময় ধরে যারা হাসপাতালে ভর্তি থেকেছেন তাদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম; ৩%।
এই বছর, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় ৬৪% মৃত্যু হয়েছে শক সিনড্রোমের কারণে, ২৪% হয়েছে ডেঙ্গু সিনড্রোমের ব্যাপ্তির কারণে, ৮% ডেঙ্গু রক্তক্ষরণজনিত জ্বরের কারণে এবং ৪% মৃত রোগীর দেহে আগে থেকেই অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগ ছিল।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম মানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তচাপ খুব দ্রুত কমে যায়, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়, দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব হয় না এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়।
"রোগী বেশিক্ষণ শকে থাকলে, মাল্টি-অর্গান ফেইলিউর ঘটে। সেজন্যই এখন ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে বেশি রোগী মারা যাচ্ছে। তাই কেউ জ্বরে আক্রান্ত হলে তাকে ঘরে বেশি করে তরল দিতে হবে যাতে তারা শকে না চলে যায়," যোগ করেন তিনি।
রোগীরা দেরিতে হাসপাতালে আসাটাই বড় চ্যালেঞ্জ: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের লাইন ডিরেক্টর প্রফেসর ডা. নাজমুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "দ্বিতীয় বা তৃতীয় দফায় আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীরা বেশি মারা যাচ্ছেন। আমাদের দেশের রোগীরা ডেঙ্গু হলে ভাবে কাল বা পড়শু হাসপাতালে যাবো। ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খায় অনেকেই। এরমধ্যে রোগী শকে চলে যায়। রোগীদের দেরিতে হাসপাতালে আসা আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জিং।"
"হাসপাতালে যখন একটা শকের রোগী আসে তখন ডাক্তার হন্যে হয়ে সে রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই বাঁচানো সম্ভব হয় না, সেজন্য মৃত্যু বাড়ছে। জ্বর হলে কেউ যেন একদিনও দেরি না করে টেস্ট করে, ডাক্তারের কাছে যায় এটা রোগীদের প্রতি আমার অনুরোধ," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের মহাসচিব ডক্টর আহমেদুল কবিরও মনে করেন, ডেঙ্গুর মতো সহজ, নিরাময়যোগ্য রোগে মৃত্যুর সংখ্যা বিভিন্ন কারণে কমানো যাচ্ছে না।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "সমস্যা হলো রোগীরা খুব দ্রুত শকে চলে যাচ্ছে। রোগীর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। বেশিরভাগ রোগী মনে করেন, তারা বাড়িতেই রোগের চিকিৎসা করতে পারবেন। এ ধরনের রোগীর অবস্থারই সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়।"
"জ্বরে আক্রান্ত প্রত্যেক রোগীর অবশ্যই একজন যোগ্য চিকিৎসকের কাছে চেকআপের জন্য যাওয়া উচিত। ডাক্তার তখন রোগীর কোনো গুরুতর উপসর্গ আছে কি না বা শকে যাওয়ার ঝুঁকি আছে কিনা তা নির্ণয় করতে পারেন। কিন্তু রোগীরা যদি গুরুতর অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে আসেন, তাহলে সে অবস্থায় তাদেরকে সুস্থ করা আমাদের জন্য বেশ কঠিন," বলেন তিনি।