শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ায় বেকারত্ব কমে ৩.৬ শতাংশ হয়েছে

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত সাম্প্রতিক শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুসারে, নারী ও তরুণদের কর্মসংস্থান বাড়ার কারণে ২০২২ সালে দেশে বেকারত্বের হার কমে ৩.৬ শতাংশে পৌঁছেছে। এর আগের প্রতিবেদনে ২০১৬-১৭ সালে দেশের বেকারত্বের হার ছিল ৪.২ শতাংশ।
গত পাঁচ বছরে দেশে বেকারের সংখ্যা ৭০,০০০ কমেছে। বর্তমানে দেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার।
বাংলাদেশে কর্মসংস্থান বলতে এমন অবস্থাকে বোঝায় যেখানে মানুষ মজুরি, বেতন, কমিশন, টিপস বা অন্য কোনো পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করে। এমনকি কেউ আগের সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করলেও তিনি বেকার নন। বিবিএসের সংজ্ঞানুসারে, কেউ যদি সপ্তাহে এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ না পান, তাহলে তাকে বেকার হিসেবে ধরা হয়।
জরিপে কর্মসংস্থানের ধারায় একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। সেটি হলো, কৃষি ও সেবাখাতে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে এবং শিল্পখাতে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা কমেছে।
কর্মশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ২০২২ সালে বেড়েছে, যার প্রতিফলন দেখা গেছে জাতীয় পর্যায়ে।
এছাড়া যুব শ্রমশক্তিও বেড়েছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা বাড়াতে পারে।
বুধবার প্রকাশিত এই জরিপটি বাংলাদেশে পরিচালিত প্রথম ত্রৈমাসিক জরিপ। দেশ সামনে এ ধরনের জরিপ চালিয়ে যাবে।
শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দেশে মোট শ্রমশক্তি ৭৩.৪১ মিলিয়ন। এর মধ্যে পুরুষ শ্রমশক্তি ৪৭.৪৮ মিলিয়ন এবং নারী ২৫.৯৩ মিলিয়ন। গত পাঁচ বছরে শ্রমবাজারে ৯.৯১ মিলিয়ন শ্রমশক্তি যোগ হয়েছে।
জরিপে দেখা গেছে, ১৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সী শ্রমশক্তির বাইরে থাকা মোট জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪৬.৯ মিলিয়ন। আর গত পাঁচ বছরে শ্রমশক্তির বাইরে অবস্থান করছে এমন জনসংখ্যা ১.৪ মিলিয়ন বেড়েছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, কম নিয়োগ এবং অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের কারণে বেকারত্বের এই পরিসংখ্যানে সম্ভবত দেশে বেকারত্বের প্রকৃত মাত্রা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'স্বল্প কর্মসংস্থানকে বিবেচনায় নেওয়া হলে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখের বদলে ১ কোটি হবে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এ অধ্যাপকের মতে, যুব-বেকারত্ব গভীর উদ্বেগের বিষয়। কারণ আগের সমীক্ষায় যুব বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ দেখানো হয়েছিল, যা ৪.২ শতাংশ সামগ্রিক বেকারত্বের হারের চেয়ে অনেক বেশি।
জরিপের ওপর মতামত দিতে গিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম দুজনেই বলেছেন, মহামারিকালে দেশের দারিদ্র্য কমেছে এবং সেইসঙ্গে কমেছে বেকারত্বের হারও।
এম এ মান্নান জানান, কোভিড-পরবর্তী সময়ে ঢাকা শহরের ওপর এক জরিপ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। এতে দেখা গেছে, কোভিডের সময় ঢাকা শহরে দারিদ্র্যের হার এবং অতিদারিদ্র্যের হার কমেছে।
এর কারণ হিসেবে মন্ত্রী বলেন, 'আমাদের দেশে কোভিডের সময় শিল্পকারখানা শতভাগ বন্ধ করা হয়নি। লকডাউন হয়েছে সীমিত আকারে। একই সঙ্গে সরকারের প্রণোদনা চালু করা হয়েছিল। এসব দারিদ্র্য কমাতে সহায়ক ভুমিকা রেখেছে।'
শামসুল আলম বলেন, 'কোভিড আমাদের নতুন ধরনের শিক্ষা দিয়েছে। বেকারের সংখ্যা কমাতে ভুমিকা রেখেছে কোভিড।'
কৃষিতে শ্রমশক্তি বেড়েছে
জরিপ অনুসারে, ২০২২ সালে মোট কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী ৭০.৭৮ মিলিয়ন, যার মধ্যে পুরুষ ৪৫.৭৯ মিলিয়ন এবং নারী ২৪.৯৯ মিলিয়ন।
কৃষি খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তি বেড়ে ৪৫.৩৩ শতাংশ হয়েছে। এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ হার ছিল ৪০.৬ শতাংশ।
শিল্প খাতে কর্মসংস্থান ২০.৪ শতাংশ থেকে কমে ১৭.০২ শতাংশ হয়েছে। আর সেবা খাতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী ২৩.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৬.৬৫ শতাংশ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, শিল্প খাতে কর্মসংস্থান কমলেও সেটি সাময়িক। কৃষি খাতে একটা সময় কর্মসংস্থান কমে আসবে।
তিনি বলেন, কোভিডের সময় শহরের মানুষের একটা অংশ গ্রামে চলে যায়। তারা গ্রামে গিয়ে কোনো না কোনো উৎপাদনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এ কারণে কৃষিতে কর্মসংস্থান বেড়েছে। নতুন নতুন ফসল এবং ফল এখন দেশে উৎপাদিত হচ্ছে।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, 'আরএমজিসহ আমাদের উৎপাদন শিল্পে অনেক বছর ধরে কর্মসংস্থান ৪০ লাখে আটকে আছে। এ কারণে উৎপাদন শিল্পে সার্বিক কর্মসংস্থান বাড়েনি।'
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহসান-ই-ইলাহি বলেন, 'শিল্পে এখন শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না, বিশেষ করে দক্ষ শ্রমিক। বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ অনেকে আমাদের এ কথা জানিয়েছে।'
নারীদের অংশগ্রহণ
বিবিএসের জরিপে উঠে এসেছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২.৬৮ শতাংশে; পাঁচ বছর আগেও এটি ছিল ৩৬.৩ শতাংশ। বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে কর্মক্ষেত্রে বৃহৎ পরিসরে অংশগ্রহণ বাড়ছে নারীদের।
বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে গ্রামীণ নারীদের অংশগ্রহণ ৫০.৮৮ শতাংশ, শহরাঞ্চলে যা ২২.৫৮ শতাংশ।
শামসুল আলম বলেন, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণে ভারত, পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। 'এটা আমাদের নতুন দিক। প্রতিবেশী এই দুই দেশের চেয়ে বাংলাদেশে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় দ্বিগুণ।'
কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণের প্রশংসা করে এম এ মান্নান বলেন, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সেরা।
'এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য ভালো। কিন্ত গৃহিণীদের এই শ্রমশক্তির হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বাড়িতে গৃহিণীরা যে কাজ করেন তা যদি জিডিপিতে যোগ হতো, তাহলে আমাদের জিডিপির আকার বাড়ত। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ গৃহিনীদের কাজের মূল্যায়ন করছে,' বলেন তিনি।