আট বছর পর আবার বড় জাহাজ ভিড়ানোর সক্ষমতা বাড়ানো হলো চট্টগ্রাম বন্দরের

আট বছর পর আবারো চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে বড় আকারের জাহাজ ভিড়ানোর সক্ষমতা তৈরি হলো। সোমবার (১৬ জানুয়ারি) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানোর কার্যক্রম।
এর ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের সাথে সরাসরি কন্টেইনার জাহাজ চলাচলের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বহির্নোঙ্গেরের পরিবর্তে বন্দরের জেটিতে পণ্য খালাস করা যাবে। এতে কমে আসবে পণ্য খালাসের খরচ।
শিপিং খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বড় আকারের জাহাজ ভিড়ার সক্ষমতা তৈরি হওয়ায় আকারভেদে কন্টেইনার জাহাজের ক্ষেত্রে ১,০০০ থেকে ১,১০০ টিইইউএস (টুয়েন্টি ফুট ইকুয়েভিলেন্ট ইউনিট) কন্টেইনার বেশি পরিবহন করা যাবে। এছাড়া ১৫ থেকে ২০ হাজার মেট্রিক টন খোলা পণ্য বেশি পরিববহন করা সম্ভব হবে ।
তবে কর্ণফুলী নদীর গুপ্তবাঁক এলাকায় ড্রেজিং করলে শিগগিরই চট্টগ্রাম বন্দরে ১১ মিটার ড্রাফট এবং ২২৫ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভিড়ানো যাবে বলে মনে করছেন শিপিং সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের এই সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে বন্দরে পণ্য পরিবহনে সময় এবং খরচ দুটোই কমবে। বাজারে পণ্যের মূল্য কমে আসবে। ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে জাহাজ চলাচল বাড়বে।
২০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বার্থিংয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দরে ১০ মিটার ড্রাফট নিশ্চিত করা দেশের জন্য গর্ব ও অহংকারের। আমাদের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক অন্য রকম। বন্দরের ইতিহাসেও যুক্তরাজ্যের ভূমিকা রয়েছে'।
তিনি বলেন, বে- টার্মিনাল ২০২৪ সালে চালুর লক্ষ্য ছিল। কিন্তু করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আশা করছি, ২০২৫ সালের শেষে অথবা ২০২৬ সালের শুরুতে বে-টার্মিনাল অপারেশনে যাবে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরও অপারেশনে যাবে ২০২৬ সালে। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল এর কাজ শেষের পথে। ৯৫ ভাগ কাজ শেষ। দ্রুত এটি চালু হবে।
অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভিড়ানো বাংলাদেশের জন্য গর্বের। এতে আমরা নিজেরাও গর্বিত। কারণ ব্রিটিশ নেভির একটি দক্ষ টিম এই ড্রাফট তৈরিতে চট্টগ্রাম বন্দরকে সহযোগিতা করেছে। এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ছে, যা খুবই দরকার'।
তিনি আরো বলেন, অধিক ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ার কারণে আরও বেশি পণ্য নিয়ে জাহাজ বন্দরে বার্থিং করতে পারবে। এতে খরচ কমে যাবে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যুক্তরাজ্যের বাজারে কম খরচে পণ্য পাঠাতে পারবে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে তাদের অংশগ্রহণ আরো বাড়বে। বন্দরের সক্ষমতা বাড়লে যুক্তরাজ্যের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের সরাসরি রুট চালুর সুযোগ সৃষ্টি হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ১৬০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৭.৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৯৮০ সালে ১৭০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৮ মিটার ড্রাফট, ১৯৯০ সালে ১৮০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৮.৫ মিটার ড্রাফট, ১৯৯৫ সালে ১৮৬ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯.২ মিটার ড্রাফট, ২০১৪ সালে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৯.৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের শুরুতে বন্দর জেটিতে ভিড়লো ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ।
চট্টগ্রাম বন্দর ২০২২ সালে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে ২.২৮ শতাংশ এবং জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ে ৩.২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। তবে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি কমে যায় ২.৬০ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই সক্ষমতাকে আরো বাড়াতে হলে বন্দরের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বন্দর সংশ্লিষ্টদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, বড় আকারের জাহাজ ভিড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করা একটি যুগান্তকারী সিন্ধান্ত। বড় জাহাজ বার্থিংয়ের ক্ষেত্রে কন্টেইনার জাহাজের পাশাপাশি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজকেও প্রাধান্য দিতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এলসিএল এবং এফসিএল কার্গো ডেলিভারি অন্যত্র সরানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সহজ শর্তে নতুন আইসিডি নির্মাণের অনুমোদন দিতে হবে। এসব সুযোগ নিশ্চিত করলে- জাহাজ থেকে পণ্য লোডিং ও আন-লোডিংয়ের সময় ৪৮ ঘন্টা থেকে ২৪ ঘন্টায় নেমে আসবে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিল্পনগরে নতুন বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য চট্টগ্রাম বন্দর সচল রাখতে কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং চালু রাখতে হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তফা কামাল, যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক পরামর্শক সংস্থা এইচআর ওয়ালিংফোর্ড- এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. মনজুরুল হক প্রমুখ।