লোকসান থেকে বের হতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত উসমানিয়া গ্লাস

প্রতি বছর কাচের চাহিদা বাড়লেও লাভের মুখ দেখছে না দেশের প্রথম গ্লাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি। গত পাঁচ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠান লোকসান গুনেছে ৩০ কোটি টাকা। এরই মধ্যে কারখানার দুটি ইউনিটের (ফার্নেস) মধ্যে একটি ইউনিট ২০১৮ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
লাভজনক অবস্থায় পূঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটি শেয়ার হোল্ডারদের প্রতি বছর বোনাস শেয়ার ও ডিভিডেন্ড দিত। কিন্তু লোকসানের কারণে ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ক্যাশ ডিভিডেন্ড ও ২০১৮-১৯ সাল থেকে বোনাস শেয়ার দেওয়া বন্ধ রেখেছে উসমানিয়া।
অদক্ষ পরিচালনা, নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় লোকসান থেকে বের হতে পারছে না এক সময়ের লাভজনক গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি উসমানিয়া।
ইতোমধ্যে লোকসানের ঘাটতি মেটাতে চার কোটি ৭৮ লাখ টাকার এফডিআর ভেঙেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে এফডিআর সাত কোটি ৯০ লাখ টাকা। যদি বিনিয়োগ ও উন্নত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে সংযোজন করা না হয়, তাহলে কোম্পানিটি ভবিষ্যতে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বেকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে প্রতিষ্ঠানের ৩০০ কর্মীর।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ভবন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ নানা স্থাপনায় কাচের ব্যবহার বাড়ছে। তাই প্রতি বছর দেশে কাচের চাহিদা বাড়ছে প্রায় আট থেকে ১০ শতাংশ হারে। কাচ তৈরিতে ব্যবহৃত বালু ও গ্যাস দেশে সহজলভ্য। এজন্য এই খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ আসছে।
বর্তমানে সারা দেশে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার কাচের বাজার রয়েছে। দেশে বার্ষিক কাচের চাহিদা ২৫ কোটি বর্গফুট। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে দেশে মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৩২ কোটি বর্গফুট। শিল্পগ্রুপগুলো উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতির দিয়ে উন্নতমানের কাচ উৎপাদন করছে।
বেসরকারিখাতে পিএইচপি, নাসির ও এমইবি গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে উন্নতমানের কাচ তৈরি করছে। এসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। অথচ কাচ শিল্পে পথ দেখানো উসমানিয়ার লোকসান প্রতি বছরই বাড়ছে।
উসমানিয়ার গ্লাসের ২০১৪-১৫ অর্থবছরের লোকসানের পরিমাণ ছিল এক কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লোকসান হয়েছে সাত কোটি ৯১ লাখ টাকা। এ ছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সাত কোটি ৮৮ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই কোটি ৩৮ লাখ টাকা লোকসান হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ১০ কোটি ৮২ লাখ টাকা লোকসান হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে।
চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি ১৯৫৯ সাল থেকে সাদা রঙের গ্লাস শিট উৎপাদন শুরু করে। এক সময় দেশে গ্লাস সরবরাহের অন্যতম ভরসা ছিল এই প্রতিষ্ঠান। স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে ৩০০ জন। উসমানিয়ার উৎপাদন ক্ষমতা ছিল প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার বর্গফুট। একটি ইউনিট বন্ধ থাকায় এখন উৎপাদন ক্ষমতা কমে দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার বর্গফুট।
প্রায় ৬০ বছর পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে গ্লাস শিট উৎপাদন করে উসমানিয়া। অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে এখানে নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন হয়নি। তাই পণ্যের মান নিম্নমানের হলেও উৎপাদনে ব্যয় বেশি হয়। ফলে লোকসানের পরিমাণ বাড়ছে।
উসমানিয়ায় উৎপাদিত নিম্নমানের গ্লাসের চাহিদাও কম। তাই প্রতিযোগিতার বাজারে প্রতিষ্ঠানটির টিকে থাকা প্রায়ই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উসমানিয়া সিবিএর সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেদ বলেন, এক সময় উসমানিয়া গ্লাসের চাহিদা সারাদেশে ছিল। লাভজনক প্রতিষ্ঠানটি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে ডুবতে বসেছে। ২০১৪ সালের নিয়োগে তৎকালীন প্রশাসন অনিয়ম করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দিয়েছে।
সচেতন নাগরিক কমিটি চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী বলেন, দেশে নতুন নতুন কাচ ফ্যাক্টরি হচ্ছে। বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানি তাদের উৎপাদন ক্ষমতা দিন দিন বাড়াচ্ছে। কিন্তু উসমানিয়ার লোকসান বাড়ছে। সহজ কথা- উসমানিয়ায় দুর্নীতি হচ্ছে। মানুষ এসব বোঝে। নয়তো একটি প্রতিষ্ঠান এভাবে লোকসান দিতে পারে না। তাই সেখানে তদারকি বাড়াতে হবে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে অদক্ষ পরিচালনার অভিযোগ মানতে নারাজ উসমানিয়ার কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার বিশ্বাস বলেন, অনেকগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্লাস উৎপাদন করছে। তারা ঘন ঘন দাম কমিয়ে দেয়। এতে করে টিকে থাকা কষ্টকর। কাচামাল ও গ্যাসের দামও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী উসমানিয়ার গ্লাস বাজারে বিক্রি হচ্ছে না। তাই প্রতি বছর লোকসান বাড়ছে।
'গত অর্থবছর শেয়ার হোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেওয়া হয়নি। এজন্য শেয়ারের দামও কমে যাচ্ছে। বর্তমানে দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, নতুন বিনিয়োগ আসছে। শিগগির কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত কনটেইনার প্লান্ট স্থাপনের কাজ শুরু হবে। ফলে পণ্যের মান বাড়লে সহজে আবার লাভজনক অবস্থানে ফেরা যাবে।'
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) পরিচালক (বাণিজ্যিক) আমিন উল আহসান বলেন, উসমানিয়া গ্লাসে নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হবে। এজন্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হচ্ছে। শিগগিরই আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করে উসমানিয়াকে উন্নত মানের গ্লাস উৎপাদন উপযোগী করা হবে।