ঢাকায় এক হাতে রিকশা চালানোর ৫০ বছরের সংগ্রাম

ইস্কাটন গার্ডেন রোডের পরীবাগের মাথায় হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনে রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রুবেল নামের এক রিকশাচালক। সে তার ডান হাত তুলে যাত্রীদের ডাকছেন।
যাত্রীরা যখন এসে ভাড়া নিয়ে তার সঙ্গে দরকষাকষি করেন, তখন লক্ষ্য করেন তার শার্টের বাঁ হাতাটা খালি ঝুলছে— মানে তার বাঁ হাত নেই। এটা দেখে কোনো কোনো যাত্রী কিছুটা ইতস্তত করেন।
তবে রুবেল তাদের আশ্বস্ত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। তার হাত একটি হলেও, তিনি একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ রিকশাচালক। এমনকি ঢাকার যে কোনো দুই হাত থাকা চালকের চেয়েও তিনি ভালো রিকশাচালাতে পারেন বলে দাবি করেন তিনি।
৬০ বছর বয়সী রুবেল বলেন, 'আমি এই শহরের এক নম্বর রিকশাচালক। আমি ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে রিকশা চালাচ্ছি। অন্যদের চেয়ে আমি ভাল রিকশা চালাতে পারি।'
রিকশা চালানোর সময় কোনো যাত্রী জিজ্ঞাসা না করলে, তিনি কখনোই নিজের হাত না থাকার কথা বলেন না।
আর যদি কোনো যাত্রী জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে সে তার গল্প শোনায়; যে গল্প এই শহরের এক মিলিয়ন রিকশা চালকের সংগ্রামের সঙ্গে মিলে যায়।
তার গল্প সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার। রাজধানীর দরিদ্রতম অংশের ছোট্ট একটি পরিবারের গল্প, যারা দিন এনে দিন খেয়ে বেঁচে থাকেন।
এই গল্প বাবার অক্লান্ত পরিশ্রম, রক্ত ও ঘামে বেঁচে থাকা অভাবের মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশুদের।
কী হয়েছিল রুবেলের?
১৯৭৪ সালে বগুড়ার একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন রুবেল। তার বাবা ছিলেন একটি দলিল লেখক এবং সে ছিল তার ক্লাসের সবচেয়ে সুদর্শন ও স্বাস্থ্যবান ছেলে। তার ভবিষ্যত ছিল খুব সম্ভাবনাময়। কিন্তু সে বছর বাংলাদেশ যখন দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ার পর তার জীবনের সবকিছু বদলে যায়।
রুবেল স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'আমি বাড়ির একটি বরই গাছের ডাল ছাঁটতে উঠেছিলাম, হঠাৎ অনেক উঁচু থেকে পড়ে যাই।'
তাকে দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু সেখানে কোনো চিকিৎসক পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, 'একজন কম্পাউন্ডার আমার হাতে একটি রড ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, ঠিক যেভাবে ডাক্তাররা ভাঙা হাড়ের ক্ষেত্রে করেন। কিন্তু এতে আমার হাত পচতে শুরু করে।'
অবশেষে চিকিৎসকরা যখন তাকে পরীক্ষা করেন, তারা সিদ্ধান্ত নেন যে তার জীবন বাঁচাতে হাতটি কেটে ফেলা প্রয়োজন। সুস্থ হয়ে ওঠার পর, আবারও এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে—তার বাবা মারা যান। ফলে রুবেল এবং তার ভাই-বোনরা অনাথ হয়ে যান এবং তার মা অসহায় হয়ে পড়েন।
ঢকায় রিকশা চালানোর পাঁচ দশক
রুবেল তার হাত এবং বাবাকে হারানোর বছরেই ঢাকায় চলে আসেন। তিনি এক হাতেই রিকশা চালানো শুরু করেন।
তিনি বলেন, 'তখন আমি প্রতি খ্যাপে ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা আয় করতাম। দিনে প্রায় ২০ টাকা আয় করতাম।'
ইস্কাটন গার্ডেন রোডে বসে কথা বলার সময় রুবেল নিজের হতাশা লুকাতে পারছিলেন না। তিনি যখন প্রথম এসেছিলেন, সেসময় ঢাকা শহরটি খুব সুন্দর ছিল। কিন্তু বছরের পর বছর এটা একটি কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে উঠেছে।'
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'আমি তখন খিলগাঁওয়ে থাকতাম। শহর জুড়ে ছিল গাছপালা, পুকুর ও খোলা জায়গা। কিন্তু এখন সব বদলে গেছে।'
ক্রমবর্ধমান দূষণ এবং ধুলাবালির জন্য তার খুব কষ্ট হয়, যেমনটা অন্য রিকশা চালকদেরও হয়।
সম্প্রতি আমরা বেশ কয়েকজন রিকশা চালককে সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তারা সবাই শহরের ধূলাবালির কারণে কীভাবে তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা হচ্ছে এবং প্রতিদিনের সংগ্রামের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
ঢাকায় রিকশা চালানোর পুরোনোদের মধ্যে অন্যতম রুবেলের বিয়ে হয় আশির দশকে। তবে তাদের কোনো সন্তান হয়নি।
তিনি বলেন, 'আমার স্ত্রীর কিছু জটিলতা ছিল।'
তাই তারা দুটি মেয়ে দত্তক নিয়েছিলেন। পরে তারা গাজীপুরের টঙ্গীতে চলে যান এবং দুই মেয়েকে বিয়ে দেন। অবশেষে ২০১০ সালে তাদের নিজেদের একটি ছেলে হয়।
রুবেল হাসতে হাসতে বলেন, 'আমার ছেলে আমার মতোই সুদর্শন— সে আপনার [সাংবাদিকের] চেয়েও অনেকটা লম্বা হয়ে গেছে।
তিনি তার ছেলে হওয়ায় মনে পূর্ণতা অনুভব করেন, তবে এখন তিনি তার পরিবারের ভরণপোষণ নিয়ে চিন্তিত।
তিনি বলেন, 'আমার কোনো জমি বা সম্পত্তি নেই। আমরা আসলেই ভূমিহীন মানুষ। আর এভাবেই আমাদের জীবন চলবে।'
রুবেল প্রতিদিন বাসে দুই ঘণ্টা জার্নি করে টঙ্গী থেকে ইস্কাটন আসেন। প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা রিকশা চালান, দিনে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করেন তিনি, নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
কিন্তু বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায়, এই আয় তার পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
তিনি অটোরিকশা চালাতে পারেন না, কারণ এক হাতে এটা নিয়ন্ত্রণ করা তার জন্য খুব কঠিন।
বয়স বেড়ে যাওয়া এবং শক্তি কমে যাওয়ায় বর্তমানে তিনি শুধু ইস্কাটন ও পরীবাগ এলাকায় স্বল্প দূরত্বে রিকশা চালান। এই তুলনামূলকভাবে নিরাপদ এলাকায়ও একবার তিনি একটি দুর্ঘটনার শিকার হন। বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মোটরসাইকেল তাকে ধাক্কা দেয়।
তিনি বলেন, 'আমার শরীরে ছয়টি সেলাই দেওয়া হয় এবং প্রায় ২০ দিন ধরে আমি বেকার ছিলাম। সংসার চালানোর জন্য সেসময় আমাকে অনেক টাকা ঋণ করতে হয়েছিল।'
তার স্ত্রীও নানা ধরনের জটিল রোগে ভুগছেন বলে জানান তিনি। এখন তার একমাত্র ভরসা তার ছেলে।
রুবেল বলেন, তিনি জানেন আর বেশি দিন রিকশা চালাতে পারবেন না।
যদিও তিনি জোর দিয়ে বলেন, তার শরীরে এখনও শক্তি আছে, তবে তার শরীর দেখে ভিন্ন কথা মনে হয়।
হতাশা লুকাতে না পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুবেল বলেন, 'আমার একটাই চাওয়া, ছেলেটা তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠুক। কিন্তু এই যুগের ছেলেমেয়েরা তো কিছুই বুঝতে চায় না। ওর বোনেরা ওকে একটা ফোন কিনে দিয়েছিল, এখন সারাদিন ওই ফোন ঘেঁটে সময় নষ্ট করে।'