তেঁতুলিয়ায় ফুটেছে রং-বেরঙের টিউলিপ; দেখতে দলে দলে আসছে মানুষ

চতুর্থবারের মতো ফুটেছে নানা রঙের টিউলিপ ফুল। টিউলিপ ফুলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ইকো-ট্যুরিজম ব্যবস্থা; আসছে দলে দলে পর্য়টক। পর্যটনের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে টিউলিপ বাগান। টিউলিপ চাষে লাভবান হওয়ায় সচ্ছলতা ফিরেছে নারী উদ্যোক্তাদের পরিবারে।
নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিতে নারী উদ্যোক্তাদের সহযোগিতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) টিউলিপ চাষের এই উদ্যোগ নিয়েছে। পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার দর্জিপাড়া গ্রামে এবার ১৩ জন নারী উদ্যোক্তা এক একর জমিতে চতুর্থবারের মতো টিউলিপ ফুল চাষ করেছেন।
টিউলিপ ফুল নেদারল্যান্ডস বা কাশ্মীরে চাষ হলেও শীতপ্রধান এলাকা হিসেবে তেঁতুলিয়ায় এর চাষাবাদ হচ্ছে। এ বছর সানি রাজকুমার, পিঙ্ক আর্ডোর, প্যারেড, অক্সফোর্ড, কমলা ভ্যাব বরলশ, ফেরডেক্স, অ্যাপেলডুম, ব্লাশিং এলিট ও মেস্টিক ভ্যান ইউজক নামের ৯ প্রজাতির ফুল চাষ করা হয়েছে।

চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি সীমান্তঘেঁষা দর্জিপাড়া গ্রামে রোপণ করা হয় টিউলিপ ফুল। মাত্র ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে চারা গজিয়ে সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে টিউলিপ। আগামী দুই মাস টিউলিপ ফুল তার রাজসিক সৌন্দর্য ও সৌরভ ছড়াবে।
প্রতিদিন ভ্রমণে আসা ও বনভোজনে আসা পর্যটকও দর্শনর্থীরা রং-বেরঙের টিউলিপ ফুলে মুগ্ধ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পরিবার-পরিজন নিয়ে আসা ফুলপ্রেমীরা ফটোসেশন ও ভিডিও ধারণে ব্যস্ত। কেউ ছুঁয়ে দেখছেন, কেউ সেলফি তুলছেন। কেউ কেউ ১৫০ টাকা দিয়ে ফুল বা ফুলের কলি কিনছেন।
মাঠে-ঘাটে, পাথর কোয়ারি, চা বাগান আর নদীতে কাজ করে আসা প্রত্যন্ত পল্লির নারীরা সংসারের কাজের ফাঁকে এই ফুল চাষাবাদ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন।
নারী উদ্যোক্তারা জানান, প্রবেশ ফি দিয়ে পর্যটকরা ফুল বাগানে প্রবেশ করছেন। পঞ্চগড় জেলাবাসীর জন্য ২০ টাকা এবং অন্য জেলার পর্যটকটকদের জন্য ৫০ টাকা প্রবেশ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। অল্প সময়ে বেশি লাভ পাচ্ছেন তারা। গম বা ভুট্টা চাষ করলে এত লাভ হয় না।

নারী উদ্যোক্তা সুমি আক্তার ও মুর্শিদা খাতুন বলেন, টিউলিপ বাগানে পর্যটকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০টি ফুল বিক্রি হচ্ছে। আগের তিনবার ফুল চাষ করে মৌসুম শেষে প্রত্যেক নারী উদ্যোক্তা ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে পেয়েছেন। এবারও লাভবান হওয়ার আশা প্রকাশ করেন তারা।
সুমি ও মুর্শিদা আরও বলেন, 'লাভের এই টাকা দিয়ে আমাদের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। সংসারের অভাব ঘুচেছে। আমরা স্বাবলম্বী হয়েছি। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারছি।'
ইএসডিওর প্রজেক্ট ম্যানেজার কল্যাণ মহন্ত জানান, ইএসডিও ও পিকেএসএফ (পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন) ২০২২ সালে তেঁতুলিয়ায় প্রথমবারের মতো পাইলট প্রকল্প হিসেবে উপজেলার শারিয়ালজোত ও দর্জিপাড়া গ্রামের আটজন নারী উদ্যোক্তার মাধ্যমে ৪০ শতাংশ জমিতে ৬ প্রজাতির ৪০ হাজার টিউলিপ ফুল চাষ করা হয়েছিল। তৃতীয় ও চতুর্থবার ইএসডিওর নিজস্ব অর্থায়নে টিউলিপ ফুল চাষ করেছে। এবার এক একর জমিতে ৯টি প্রজাতির টিউলিপ ফুল চাষ করা হয়েছে। ১৩জন নারী উদ্যোক্তা টিউলিপ চাষাবাদ করেছেন।

তিনি বলেন, 'নেদারল্যান্ডস থেকে বাল্ব (বীজ) সংগ্রহ করতে হয়। প্রতিটি বাল্ব কিনতে ৮০ থেকে ৯০টাকা ব্যয় হয়। গত তিনবারে আমরা নানাভাবে বাল্ব সংরক্ষণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু সফল হইনি। গাছ হলেও কাঙ্ক্ষিত ফুল হচ্ছে না। সরকারিভাবে কোয়ারেন্টিইন ফি ও ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলে টিউলিপ চাষাবাদের পরিমাণ আরও বাড়বে।'
বাগান দেখতে আসা শিক্ষার্থী আসিফুজ্জামান আসিফ বলেন, 'টিউলিপ ফুল নেদারল্যান্ডস ও কাশ্মীরে হয় শুনেছি। ইউটিউবেও দেখেছি। এই ফুল এখন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় চাষ হচ্ছে। ফুলটি দেখে আমার মন ভরে গেছে।'
বগুড়া থেকে আসা এক দম্পতি বলেন, 'গত বছর দেখতে এসেছিলাম, কিন্তু আসার আগেই মৌসুম শেষ হয়েছিল বলে দেখতে পাইনি। এবার তাই আগাম ছুটি নিয়ে সপরিবারে দেখতে এসেছি। অনেক ভালো লাগল।'

ঢাকা থেকে আসা সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী আব্দুল মজিদ বলেন, 'অসংখ্যবার তেঁতুলিয়ায় এসেছি। টিউলিপ ফুলের বাগান সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল না। তেঁতুলিয়ায় টিউলিপ বাগান আছে শুনে আমরা টিউলিপ ফুলের বাগান দেখতে এসেছি। সীমান্ত গ্রামে এত সুন্দর একটা বাগান গড়ে উঠেছে তা দেখে সত্যিই আমরা অভিভুত মুগ্ধ।'
ইএসডিওর সহকারী ভ্যালু চেইন ফ্যাসিলিটেটর মো. আসাদুর রহমান বলেন, ইএসডিও বাল্ব সরবরাহ ও প্রযুক্তি সরবরাহ করে থাকে। জমি ও চাষাবাদ নারী উদ্যোক্তাদের। যেহেতু এই ফুলটি শীতকালীন ফুল, এজন্য উচ্চ কৃষি প্রযুক্তিসহ তাপ নিয়ন্ত্রণের একটি বিশেষ শেডের (ছাউনির) নিচে ফুলগুলো চাষ করা হয়। রোদের তেজ নিয়ন্ত্রণও এটি কাজ করে।

তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. ফজলে রাব্বী বলেন, 'টিউলিপ বাগান পর্যটনের ক্ষেত্রে তেঁতুলিয়াকে সমৃদ্ধ করেছে। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভূমিকা রাখছে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও।'

ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলেন, 'তেঁতুলিয়ায় এগ্রো ইকো-ট্যুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য এখানে আমরা টিউলিপ ফুলের চাষাবাদ করছি। পর্যটন ও এ্যাগ্রো ইকো-ট্যুরিজমের লক্ষ্যে ভবিষ্যতে আরও নানা ধরনের ফুল চাষ করার উদ্যোগ নেয়া হবে।'

বাল্ব (বীজ) আমদানিতে সরকারিভাবে শুল্ক প্রত্যাহার করা হলে টিউলিপ চাষ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তাসহ সংশ্লিষ্টরা।