রমরমা বরফ ব্যবসা: ১৯ শতকে বরফের চাঁই রপ্তানি হতো সারাবিশ্বে, এসেছিল ভারতবর্ষেও

রেফ্রিজারেটর, আইস-ডিসপেন্সার তৈরির আগে বরফ ছিল একপ্রকার বিলাসদ্রব্য। তখন বরফ দেওয়া পানীয়কে দেখা হতো আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে। বরফকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল কয়েক মিলিয়ন ডলারের বরফশিল্প।
নরওয়ে তখন বছরে এক মিলিয়ন টন প্রাকৃতিক বরফ রপ্তানি করত। উনিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রেও বরফের ব্যবসা ছিল রমরমা। সে সময় দেশটিতে প্রাকৃতিক বরফের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল প্রায় ৯০ হাজার মানুষ ও ২৫ হাজার ঘোড়া।
উনিশ শতকে লন্ডনে মার্কিন বরফের তুমুল চাহিদা ছিল। ১৮৫৬ সাল নাগাদ দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া, পার্সিয়ান উপসাগর, এবং ভারতে মার্কিন বরফের বড় বাজার তৈরি হয়।
পুকুর, হ্রদ, নদীর ওপর প্রাকৃতিকভাবে জমাটবাঁধা বরফ কেটে নেওয়া হতো। বরফ কাটার জন্য দরকার হতো প্রচুর শ্রমিকের। তারা বরফের স্তূপ থেকে বড় বড় খণ্ডে বরফ কেটে নিতেন।
১৮৩০-এর দশকে বরফ ব্যবসা করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যান ফ্রেডেরিক টিউডর নামক বোস্টনের এক ব্যবসায়ী। ওই সময় তাকে ডাকা হতো 'আইস কিং' বা বরফরাজা নামে। টিউডরের বরফ শ্রমিকেরা প্রথমে হাত দিয়েই বরফ কাটতেন।
কিন্তু এক পর্যায়ে টিউডরের সহযোগী নাথানিয়েল জার্ভিস ওয়াইথ দুই ব্লেডযুক্ত ঘোড়ায় টানা বরফ কাটার যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এর ফলে স্বল্প সময়ে অনেক বেশি পরিমাণ বরফকে বর্গাকারে কাটা সম্ভব হয়। এতে বরফ সংগ্রহের পরিমাণ তিনগুণ বেড়ে যায়।
অন্যদিকে কানাডার বরফ শ্রমিকেরা ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। তারা প্রথমে বরফের বড় বড় স্তূপ পরিষ্কার করে নিতেন। এরপর একটি স্লেজের সঙ্গে লাগানো ছয় ফুট বড় করাত দিয়ে ওই বরফ কাটতেন। একইভাবে বরফ সংগ্রহ করা হতো গ্রিনল্যান্ডেও। এ ধরনের বড় করাত দিয়ে বরফ কাটার জন্য সবমিলিয়ে ২৫–৩০ জন মানুষ লাগত।
বরফ কাটার কাজটি ঝুঁকিপূর্ণও ছিল। অনেক সময় বরফের তলায় মানুষ বা ঘোড়া ডুবে যেত, গায়ের ওপর বরফের বড় টুকরা পড়েও মৃত্যুর ঝুঁকি ছিল। নদী বা বড় জলাশয়ের ওপর জমে থাকা বরফ কাটার সময় অনেকে পানিতে ডুবে মারা যেতেন।
বরফ সংগ্রহের কাজটি মৌসুমি ছিল। আর ব্যবসায়ীরা বরফ কাটার জন্য কেবল নির্দিষ্ট একটা সময় পেতেন। তাই পরিবেশ খুব বেশি ঠান্ডা না হলে অথবা তাপমাত্রা বাড়ার ফলে বরফ গলতে না শুরু করলে বরফ শ্রমিকদেরকে দিনরাতই কাজ করতে হতো।
বরফ কাটা শেষ হওয়ার পর সেগুলোর বিশাল বিশাল চাঁইকে লাঠির মাঝখানে বেঁধে দুইজন লাঠির দুই দিক কাঁধে তুলে বয়ে নিয়ে যেতেন। কখনো কখনো স্লেজ ব্যবহার করা হতো বরফ পরিবহনের জন্য। সংগৃহীত এসব বরফের গন্তব্য হতো 'আইস হাউজ' বা বরফঘর।
এসব বরফঘর থেকে দেশের ভেতরে বা সারাবিশ্বে বরফ পাঠানো হতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বরফের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল বিয়ার প্রস্তুতকারকেরা।
ব্রুয়ারিগুলো (বিয়ার তৈরির কারখানা) তখন বছরে প্রায় এক মিলিয়ন টন বরফ ব্যবহার করত কেবল বিয়ার তৈরি ও পরিবহনের কাজে। আর বিয়ারকে ঠান্ডা করা ও পরিবেশন করার পেছনে ব্যয় হতো আরও দুই মিলিয়ন টন বরফ।

বিয়ার তৈরিতে ব্যবহার ছাড়াও মাংস ও অন্যান্য কাঁচামালের সজীবতা বজায় রাখার জন্য বরফ দরকার হতো।
১৮৫৬ ও ১৮৮৩ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় যথাক্রমে ৩৫৩ ও ৪৫০ টন বরফ পাঠানো হয়। এসব বরফের কিছুকিছু প্রেসিডেন্সি শহরগুলোর মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে সংরক্ষণ করা হতো। যেসব বছর সরবরাহ কম থাকত, ওই সময় বরফ রেশন করা হতো।
১৮৩৩ সালে প্রথম আইসক্রিমের স্বাদ পান কলকাতাবাসী — ওই আইসক্রিম তৈরি করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস থেকে আনা বরফ দিয়ে।
ওই বছরের ১২ মে ১৮০ টন বরফ নিয়ে বোস্টন থেকে কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে টাসক্যানি নামক একটি জাহাজ। ৬ সেপ্টেম্বর কলকাতার বন্দরে নোঙর করে জাহাজটি। ততদিনে জাহাজটিতে অক্ষত ছিল ১০০ টন বরফ।
কলকাতা বন্দরে বহু মানুষ জড়ো হন আমদানি করা বরফ দেখতে। উপস্থিত প্রত্যেকে ওই বিশাল বিশাল বরফের চাঙড় দেখে অবাক হয়েছিলেন।
উৎসুক দর্শকদের একজন দাবি করেন, ওই বরফ স্পর্শ করে তার হাত পুড়ে গিয়েছিল। এতে অন্যদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আরেকজনতো জাহাজের ক্যাপ্টেকে জিজ্ঞেসই করে বসেন, আমেরিকায় বরফ গাছে ধরে কি না।
আশ্চর্য শোনালেও, বরফের চাহিদা বাড়ার পর গতানুগতিক বরফশিল্পের পতন ঘটতে থাকে। কারণ বেশি চাহিদার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে মানুষ কৃত্রিমভাবে বরফ সংরক্ষণের পদ্ধতি আবিষ্কার করে।
১৮৭০-এর দশকে বরফ তৈরির আধুনিক প্রক্রিয়া আবিষ্কার হয়। ১৮৬৪ সালে টিউডর মারা যান। এরপর তার ব্যবসার হাতবদল হয়।
কাছাকাছি সময়ে ভারতেও বরফ কোম্পানি গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৮৭৮ সালে এ অঞ্চলের প্রথম বরফ কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে দ্য বেঙ্গল আইস কোম্পানি।
ভারতবর্ষে রেলওয়ের বিস্তারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বরফ ব্যবসারও বিস্তৃতি ঘটে। ১৯০৪ সালে ভারতে রেললাইনের সংখ্যা ছিল ২৫টি, ১৯২৫ সালে তা ৬৬-তে পৌঁছে।
রেললাইনের বিস্তারের ফলে বরফ বেশিদিন মজুত করে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে যায়; অল্প সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় বরফ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়। এর ফলে জৌলুশ হারায় বরফঘরগুলো।
অবশ্য প্রাকৃতিক বরফ সংগ্রহের এ ব্যবসা ১৯৫০ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল। কিন্তু আইস বক্স (ও পরবর্তীকালে রেফ্রিজারেটর) আবিষ্কার হওয়ার পর প্রাকৃতিক বরফের বৈশ্বিক ব্যবসার আকর্ষণ কমে যায়।
এছাড়া প্রাকৃতিকভাবেও বরফের উৎপাদন কমে যেতে শুরু করে। ১৯১৪ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রে দুই কোটি ৬০ লাখ টন কৃত্রিম বরফ তৈরি করা হয়। অন্যদিকে একই সময়ে প্রাকৃতিক বরফ আহরণের পরিমাণ ছিল দুই কোটি ৪০ লাখ টন।
দ্য বেঙ্গল আইস কোম্পানি যাত্রা শুরুর পর ভারতবর্ষে বরফ আমদানি করার প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই ফুরিয়ে যায়। এ কোম্পানির কল্যাণে উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের নাগালেও পৌঁছায় বরফ।