বাহাদুর শাহ জাফরকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে!

শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর তার শাসনামালে নিজের পরিবার ও ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছিলেন। তবে দিল্লির জনসাধারণের কাছে তার স্থানটি ছিল বিশেষ। আর প্রজাদের সঙ্গে তার এ সম্পর্ক বজায় ছিল ১৮৫০-এর দশকের পুরোটা সময়। যদিও তখন সম্রাটের রাজনৈতিক ক্ষমতা ক্রমশ অস্তমিত হচ্ছিল।
অবশ্য নাগরিকেরা রাজদরবারের ব্যর্থতাগুলো নিয়ে কখনোই চুপ ছিল না। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোতে দরবারের কাজকারবার নিয়ে প্রায়ই নেতিবাচক কথা লেখা হতো। দরবারের কর্মকর্তাদের আর্থিক তছরুপের অভিযোগ বিষয়ে কড়া সমালোচনা খুবই স্বাভাবিক ছিল। সেই সঙ্গে মসনদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিদের অজ্ঞতা, অযোগ্যতা ও অদক্ষতা নিয়েও কথা বলতেন সাধারণ মানুষ।
কথিত আছে, কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে কেল্লার ভেতরে বাস করা দরিদ্রদের না খেয়ে থাকতে হতো। তবে সাধারণ মানুষ সম্রাটের সমালোচনা করতেন না। তারা বিশ্বাস করতেন, সম্রাটকে তার আশেপাশের লোকেরা পরিস্থিতি বিষয়ে অন্ধকারে রাখতেন, নাহলে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ কখনোই দরিদ্র প্রজাদের ওপর নিপীড়ন বরদাস্ত করতেন না।
আদতে উর্দু সংবাদপত্রগুলোতে সম্রাট প্রসঙ্গে কেবল সম্মান ও অনুরাগের কথাই দেখা যেত। দিল্লি উর্দু আকবর পত্রিকার লেখা থেকে জানা যায়, ধার্মিক, প্রজ্ঞাবান, ধৈর্যশীল,ও মেধার পৃষ্ঠপোষক বাহাদুর শাহর দীর্ঘ জীবনের জন্য সবাই প্রার্থনা করত। দিল্লি উর্দু আকবর পত্রিকা ও কিরান-উস-সাদাইন গ্রন্থ উভয় লেখাতেই সম্রাটের সুস্বাস্থ্যের জন্য আন্তরিক প্রার্থনা ও তার আরোগ্যের জন্য স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উল্লেখ পাওয়া যায়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটা ছিল মোগল সম্রাটদের তাদের প্রজাদের সঙ্গে গড়ে ওঠা শক্তিশালী সম্পর্কের ফল। এর কিছুটা তৈরি হয়েছিল সম্রাটদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা ও দান-খয়রাতের মতো উদারমনা কার্যক্রমের কারণে। বাহাদুর শাহ জাফর তার শোভাযাত্রার সময় আশেপাশে জড়ো হওয়া দরিদ্রদের মধ্যে মোহর ছুঁড়ে দিতেন। দোকানদারেরা তাদের পণ্য প্রাসাদে নিয়ে আসতেন বিক্রির জন্য, আর সম্রাটের হিসাব থেকে তার পুরোটাই কিনে নেওয়া হতো। বিভিন্ন শিল্পী ও মনোরঞ্জনকারীকে প্রাসাদ থেকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হতো।
মল্লযোদ্ধা, অ্যাক্রোব্যাট ও অভিনয়শিল্পীরা প্রায়ই প্রাসাদে এসে তাদের নৈপুণ্য প্রদর্শন করে যেতেন। বিনিময়ে জুটত মোটা অংকের পারিতোষিক। কেউ যদি প্রাসাদে এসে নিজের দুঃখের কথা জানাত, তাহলে তাকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হতো। এমনকি কোনো আগন্তুক যদি নগরে আসার পথে দস্যুদের হাতে পড়ে সর্বস্ব খোয়াতেন, তারাও সম্রাটের কাছ থেকে অর্থকড়ি পেতেন। রাজকীয় বিভিন্ন ভূমির বাসিন্দারা এসে খাজনা বা ভাড়া মওকুফের প্রার্থনা জানালে সম্রাট তা তাৎক্ষণিকভাবে মঞ্জুর করে দিতেন। নগরের কোতোয়াল ১৮৫২ সালে একবার তার কাজের জন্য ১২৫ রুপি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
একবার বাহাদুর শাহ জাফর কিছুদিন মেহরৌলিতে থাকতে গিয়েছিলেন। তখন নজরানা হিসেবে কৃষকেরা দুধ, দই এসব সম্রাটকে দিয়ে যেতেন। বিনিময়ে তারা দিল্লিশ্বর থেকে অর্থ পুরস্কার পেতেন। তবে গ্রামীণ প্রজাদের সঙ্গে সম্রাটের সম্পর্ক অবশ্য সবসময় মসৃণ ছিল না। স্থানীয়রা নীলগাই, ময়ুর ইত্যাদি হত্যা করত না, আর সম্রাটের শিকারিদের এসব নিয়ম মেনে চলতে হতো। ১৮৫০-এর দশকে বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা হরিণ ও খরগোশ শিকারেও আপত্তি জানাতে শুরু করেছিল।
সাম্রাজ্যের জমিগুলো থেকে খাজনা আদায়েও সম্রাটের প্রতিনিধিদের দীর্ঘসময় ধরেই অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছিল। ১৮৪০ সালে কোট কাসিম পরগনায় সশস্ত্র লড়াই ছড়িয়ে পড়ে। ওই লড়াইয়ে স্থানীয় জমিদারেরা সম্রাটের সৈন্যদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। বাহাদুর শাহ তার সাম্রাজ্যের জমিজমা দেখভালের দায়িত্ব শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ প্রশাসনের হাতে তুলে দিতে রাজি হওয়ার এটাই ছিল অন্যতম প্রধান কারণ।
ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সবসময় মার্জিত আচরণ করতেন সম্রাট বাহাদুর শাহ। যদিও যতই দিন যাচ্ছিল, ইংরেজদের দিক থেকে সম্রাটের জন্য সম্মানবোধ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছিল। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা সম্রাটের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ সম্রাটকে তারা গুরুত্বপূর্ণ কেউ মনে করেননি।
তারপরও ১৮৫০-এর দশকজুড়ে বাহাদুর শাহ নিয়মিত ইংরেজ এজেন্ট এ প্যালেস গার্ডের কমান্ডান্টের কাছে ফল, শাকসবজি, শিকার, রান্না করা খাবার ইত্যাদি পাঠাতেন। প্রাসাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ইংরেজ কর্মকর্তাদের প্রতি মার্জিত ব্যবহার করতেন বাহাদুর শাহ। প্রাসাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত ইংরেজ কর্তাদের আরাম-আয়েশের ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকতেন দিল্লির সম্রাট।
মোগল দরবারের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সুদৃঢ় সম্পর্ক ছিল। মোগল শাসনামলে দরবারের কোনো কর্মকর্তা মারা গেলে তার চাকরি তার সন্তানকে দেওয়া হতো। তবে কখনো সরাসরি কাজ দেওয়া সম্ভব না হলে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির মাইনের একটা বড় অংশ তার পরিবারকে দিয়ে দেওয়া হত। তবে কর্মকর্তারা অবসর নেওয়ার পরও সম্রাটের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ থাকত। বাহাদুর শাহ তার সাবেক মুক্তারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচ পাঠিয়েছিলেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
রাজসভাসদ ও রাজকর্মচারীদের পরিবারে কারও বিয়ে বা জন্ম হলে সম্রাট সেসব অনুষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হতেন। বাহাদুর শাহ তার হিন্দু কর্মকর্তাদের সন্তানদের বিয়েতে বিয়ের পোশাক উপহার পাঠাতেন। একবার একজন হিন্দু কর্মকর্তা তার নবজাতক সন্তানের নাম রাখার জন্য সম্রাটকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, এবং সম্রাট তা রক্ষা করেছিলেন। বিভিন্ন সময় এসব কর্মকর্তাদের আয়োজন করা সঙ্গীত ও নৃত্যানুষ্ঠানে সম্রাট নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেন।
হিন্দু কর্মকর্তারা তীর্থ থেকে ফিরলে তাদেরকে দরবারে বিশেষভাবে অভ্যর্থনা জানানো হতো। এ উপলক্ষে সম্রাট তাদেরকে একটি শালও উপহার দিতেন। সম্রাটের সঙ্গে তার কর্মকর্তাদের সম্পর্ক বেশ খোলামেলা ছিল বলেই উল্লেখ পাওয়া যায়। একবার এক কর্মকর্তা রামলীলায় যাওয়ার জন্য রাজকীয় হাতি ধার নিয়েছিলেন। তবে যারা বাহাদুর শাহের কাছ থেকে এ ধরনের অনুগ্রহ পেতেন, মাঝেমধ্যে তারাও সম্রাটকে বিভিন্ন ভেট দিতেন।
প্রাসাদের সঙ্গে সম্পর্ক, অর্থাৎ দরবারে সম্মানের সঙ্গে স্বাগতম লাভ, সম্রাটের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ইত্যাদি তখন পর্যন্ত দিল্লিতে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মর্যাদার চিহ্ন ছিল। রামজি দাস গুরওয়ালার মতো দিল্লির মহাজনদেরকে মাঝেমধ্যে দরবারে দেখা যেত। দিল্লি উর্দু আকবর পত্রিকার সম্পাদক ও সরকারি চাকুরিজীবী মোহাম্মদ বাকার প্রায়ই বাহাদুর শাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন।
সম্রাটের অধীনে কাজ করেন না এমন ব্যক্তিদের খিলাত প্রদান করতে ব্রিটিশরা নিরুৎসাহিত করতেন। তা সত্ত্বেও সম্রাটের কাছ থেকে খিলাত লাভ করতে অনেকেই ইচ্ছুক ছিলেন। এমনকি ব্রিটিশদের সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নিবিড় সম্পর্ক থাকা অনেক ব্যক্তিও বাহাদুর শাহর কাছ থেকে খিলাত পেতে চাইতেন। দিল্লির উপ-সহকারী সার্জন চিমন লাল সম্রাটের চিকিৎসা করেছিলেন। সরকারি নিয়মের কারণে তিনি সম্রাটের কাছ থেকে খিলাত গ্রহণ করতে পারেননি, তার বদলে তিনি বাহাদুর শাহর কাছ থেকে একটি সার্টিফিকেট চেয়ে নেন।
- স্ক্রল ডটইন-এ প্রকাশিত স্বপ্না লিডলের 'দ্য ব্রোকেন স্ক্রিপ্ট: ডেলহি আন্ডার দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি অ্যান্ড দ্য ফল অব দ্য মুঘল ডিনাস্টি, ১৮০৩-১৮৫৭' গ্রন্থের সারাংশ থেকে সংক্ষেপে অনুবাদ।