টমেটো কেন ফল?

উদ্ভিদজগতে এমন কিছু ফল আছে যেগুলোকে আমরা সবজি বলে ভুল করি। এই যেমন, টমেটো, বেগুন, মিষ্টিকুমড়া, মটরশুঁটি, মরিচ—এসবই নাকি ফল! উদ্ভিদবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা উপেক্ষা করেও ফলকে এখনও নির্দ্বিধায় সবজি বলেন অনেকে। ফলে শুরু হয় 'ফল নাকি সবজি'র বিতর্ক।
এককালে এই বিতর্ক যুক্তরাষ্টের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ানোর নজিরও আছে। তাই রন্ধনশৈলী তো বটেই, 'ফল নাকি সবজি'র রাজনৈতিক ইতিহাসও আছে! সে ইতিহাস উঠে এসেছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর এক প্রতিবেদনে।
সবজি ও ফলের মূল পার্থক্য কোথায়?
উদ্ভিদবিজ্ঞানের ভাষায়, ফল হলো কোনো ফুলদায়ী গাছের পুনরুৎপাদনশীল অংশ বা জঠর থেকে বের হয়ে আসা বস্তু। ঠিক এ সংজ্ঞার কারণেই আপেল, আম, নাশপতি, এপ্রিকট ও তরমুজ যেমন ফল, তেমনি টমেটো, মিষ্টিকুমড়া, শসা, মরিচ, শিম এবং মটরশুঁটিও ফলের তালিকাতেই পড়ে।
অন্যদিকে, সবজি হলো ফল বাদে গাছের অন্যান্য ভোজ্য অংশ। যেমন, পাতা (শাক, লেটুস, বাঁধাকপি), মূল (মূলা, বীট-পালং, শালগম, ডাঁটা (শতমূলী), কন্দ (আলু, পেঁয়াজ) এবং ফুল (ফুলকলি এবং ব্রকলি)।
টমেটোর যে ঘটনা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল
'ফল নাকি সবজি'—এ নিয়ে আমেরিকায় একটি মজার কাহিনী প্রচলিত আছে।

১৮৮৬ সাল, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক। আমদানিকারক জন নিক্স আর তার সহকর্মীরা একগাদা পশ্চিম ভারতীয় টমেটো নিউ ইয়র্ক বন্দরে পৌঁছান। বন্দরটিতে কাস্টম কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন এডওয়ার্ড হেডেন। তিনি তৎকালীন প্রচলিত মার্কিন শুল্ক আইন ১৮৮৩ অনুসারে, নিক্সকে 'বৈদেশিক সবজি'র ওপর ১০ শতাংশ কর ধার্য করে দেন। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞান রাখা নিক্স এতে আপত্তি তোলেন। কারণ টমেটো যে সবজি নয়, ফল! সুতরাং এটি হওয়া উচিত করমুক্ত।
এই ঘটনা একসময় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। ১৮৯৬ সালে বিচারপতি হোরেস গ্রে টমেটোকে সবজি বলে রায় দেন। তিনি বলেছিলেন, 'উদ্ভিদবিজ্ঞান মতে, শসা, মটরশুঁটি এবং শিমের মতোই টমেটোও একটি ফল। কিন্তু মানুষের সাধারণ ব্যবহারে এসব ফল মূলত ভোজের সময় কিংবা মাছ, মাংসের সাথে বা পরে খাওয়া হয়, ফলের মতো ডেজার্ট হিসেবে খাওয়া হয় না।'
'ফল নাকি সবজি'—এই বিতর্কে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কিংবা শেষ ঘটনা কোনোটাই ছিল না। ১৮৮৬ সালে বিচারপতি জোসেফ ব্র্যাডলি শিমকে সবজি বলে রায় দেন।
পরবর্তীতে আদালত ট্রাফল, পেঁয়াজ ও পানিফলকেও সবজি বলে রায় দেন। তবে স্ট্রবেরি-রেউচিনি পাই-এর জনপ্রিয়তা ছিল বলে রেউচিনিকে ফল বলেই রায় দেওয়া হয়!
২০০১ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) মূলা, মিষ্টিআলু ও টমেটোকে ফল বলে ঘোষণা দেয়।
ওকলাহোমা রাজ্যের সবজি: তরমুজ!
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আইনসভাগুলো ফল-সবজির জলকে আরও ঘোলা করেছিল।
১৮৯৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্ব কলম্বাস প্রদর্শনী নামক এক মেলা, যা শিকাগো ওয়ার্ল্ডস ফেয়ার নামেও পরিচিত। এ মেলায় অংশ নিয়েছিলেন প্রায় দুই কোটি সত্তর লক্ষ দর্শক। মেলার ৬৫ হাজার প্রদর্শনীর মধ্যে ছিল জাতীয় ফুল প্রদর্শনী, যার জন্য প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যকে প্রতিনিধিত্বমূলক ফুল বাছাই করতে বলা হয় (ঠিক যেমন জাতীয় ফুল বা জাতীয় ফল কিংবা জাতীয় গাছ থাকে, তেমন রাজ্য ফুল)।
এই মেলার পরপর অঙ্গরাজ্যের অন্যান্য প্রতীক বাছাই করার পর্ব শুরু হয়। ফুল বাদেও পাখি, গাছ, প্রাণী, কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ, জীবাশ্ম, খনিজ, গান, রত্ন পাথর এবং লোকনৃত্য—আরও কত কিছুর রাজ্যপ্রতীক বাছাই করা হয়। এই যেমন, মেইন, ম্যসাচুসেটস ও নর্থ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যের রাজ্য-বোট হলো 'শ্যাড বোট', যা এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত বোট। আবার টেক্সাসের কাউবয় বুটকে ধরা হয় 'রাজ্য পাদুকা'।

এবার আসা যাক ফলের ক্ষেত্রে। আমেরিকার ছয়টি অঙ্গরাজ্যের প্রতীকি ফল হলো আপেল, যেখানে তিনটি রাজ্যের রাজ্য-ফল স্ট্রবেরি। জর্জিয়া ও সাউথ ক্যারোলাইনা বেছে নিয়েছে পিচ (জামজাতীয় ফল), আর অ্যালাবামা বেছে নিয়েছে ব্ল্যাকবেরি।
সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসকে এড়িয়ে গিয়ে এবং উদ্ভিদবিজ্ঞানকে মেনে, টেনেসি ও ওহাইও—এ দুটি অঙ্গরাজ্য রাজ্য-ফল হিসেবে বেছে নিয়েছে টমেটোকে। অন্যদিকে আরকানসাস রাজ্য করে বসে মজার এক কাণ্ড। টমেটোকে রাজ্য-ফল এবং রাজ্য-সবজি উভয় মর্যাদাই দিয়ে বসে তারা।
আর ২০০৬ সালে ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্য রাজ্য-সবজি হিসেবে বাছাই করেছে তরমুজকে। রাজ্যটির সিনেটর ডন ব্যারিংটনের মতে, তরমুজ জেনেটিক সম্পর্কের ভিত্তিতে শসা এবং লাউয়ের কাছাকাছি গোত্রের। তাছাড়া দেশটির কৃষি বিভাগও (ইউএসডিএ) তরমুজকে সবজির কাতারেই ফেলে।
পাশ্চাত্যের ইতিহাসে ফলের স্থান
ফলের ইংরেজি প্রতিশব্দ 'ফ্রুট' এসেছে লাতিন শব্দ ফ্রুক্টুস অথবা ফ্রুই থেকে, যার অর্থ 'উপভোগ করা'। অন্যদিকে সবজির ইংরেজি প্রতিশব্দ ভেজিটেবল এসেছে ভেজিটেবিলিস শব্দ থেকে, যার অর্থ জন্মানো (গাছে)।
ফলের মূল আকর্ষণ হলো এর মিষ্টত্ব। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বেশিরভাগ ফলে মোট ওজনের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চিনি থাকে। গ্রীষ্মপ্রধান এলাকার ফল আরও সুমিষ্ট। একটি সরস আপেল কিংবা কমলায় প্রায় ২৩ গ্রাম চিনি থাকে, একটি কলায় থাকে ১৭ গ্রাম। আর পিচ ও পাকা ডুমুরে চিনি থাকে যথাক্রমে ১৫ গ্রাম এবং ১০ গ্রাম।
সুমিষ্ট স্বাদের জন্যেই বোধহয় ফল এতটা জনপ্রিয়। কোনো চোর যদি আপনার বাগানে ঢোকে, সে নিশ্চয় শিম না নিয়ে কমলালেবু নিয়ে যাবে।
মার্কিন ইতিহাসে ফলের স্থান বেশ পাকাপোক্ত। শিশুরা যেন ফল চুরি করতে না যায়, সেজন্য একটি গল্প প্রচলিত ছিল। বলা হতো, ফল চুরি এক ধরনের পাপ যা শিশুদের অপরাধের জগতে টেনে নিয়ে যায়।
ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংল্যান্ডে ফল চুরির দণ্ড ছিল নির্বাসন অথবা মৃত্য।
তবে ফল চুরির কথা এলে মার্কিন সাহিত্যিক মার্ক টোয়েনের কথা বলতেই হবে। ঠিক তার বিখ্যাত চরিত্র হাকলবেরি ফিনের মতো টোয়েনও ছিলেন দুর্বিনীত তরমুজ চোর। একটি গল্পে লিখেছিলেন, তিনি নাকি ক্রেতার জন্য অপেক্ষারত এক কৃষকের গাড়ি থেকে তরমুজ নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে খেতে গেলে দেখেন তরমুজটি ছিল কাঁচা, ভেতরটা তখনও সবুজ রয়ে গেছে।
দুষ্টু, তরুণ বালক টোয়েন আবার সেই কৃষকের কাছে ফিরে যান। ক্রেতা সেজে কাঁচা তরমুজ দেওয়ার অভিযোগ করেন এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ হিসেবে একটি পাকা, রসালো তরমুজ নিয়েই আসেন।