সামাজিক নিয়মে পাহাড়ে ‘লকডাউন’

প্রবেশ পথ বন্ধ। বাইরের কেউ পাড়ায় ঢুকতে পারবে না। নভেল করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে পাড়ার প্রবেশ পথে বাঁশ দিয়ে পথ আটকানো। এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
ভাইরাল হওয়া ছবিটি বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের রাংলাই ম্রো পাড়ার। পাড়াটি শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে।
পাড়ার কারবারী (গ্রামপ্রধান) লেংপুং ম্রো জানিয়েছেন, সম্প্রতি একটি ভাইরাসের নাম শুনেছি। ছোঁয়াচে এ রোগ নাকি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়ায়। পাড়ার মানুষদের রক্ষা করতে এমন ব্যবস্থা নিয়েছি।
তিনি আরও জানান, এক সময় হাম ও বসন্ত রোগে ম্রোদের অনেকেই মারা গেছেন। এগুলো মহামারি রোগ। ঠিক সময় ব্যবস্থা নিতে না পারলে এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় ছড়িয়ে যায়। আগে এমন পরিস্থিতিতে মানুষের যাতায়াত বন্ধ রাখতে বাঁশ অথবা গাছ দিয়ে পথ আটকিয়ে রাখা হতো। এবারও সেটি করা হলো।
তিনি বলেন, 'আদিকাল থেকে ম্রো সমাজ এমন চর্চা করে আসছে। পাড়ায় জরুরি প্রয়োজনে কেউ এলে বাইরে থেকেই ডাক দিতে হবে।'
আশির দশকের লেখা জার্মানির বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী লুফলা তার গবেষণার বই 'দ্য ম্রো'তে পাড়ার এমন সুরক্ষা ব্যবস্থাকে বোঝাতে 'লকডাউন' এবং 'হোম কোরেন্টিন' শব্দ ব্যবহার করেছিলেন।
এদিকে ভাইরাল হওয়া এ ছবি অনেকেই শেয়ার করেছেন। সাধুবাদ জানিয়ে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নববিক্রম ত্রিপুরা মন্তব্য করেন, বান্দরবানের ম্রো জনগোষ্ঠীর একটি গ্রাম লকডাউনের জন্য অনন্য উদাহরণ।
মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মী ডনাইপ্রু নেলী লিখেছেন, গতানুগতিক শিক্ষা এদের না থাকলেও জ্ঞানের ভাণ্ডারে কমতি নেই। শহুরে সার্টিফিকেটধারীরা এখনো সচেতন হয়নি, অথচ পশ্চাৎপদ ম্রো জনগোষ্ঠী গ্রামবাসীরা তাদের গ্রামকে সুরক্ষিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
একটি বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করা কংচাই মারমা লিখেছেন, জেনে ভালো লাগছে যে, এ মহাদুর্দিনে কোথাও কোথাও আমার প্রিয় পাহাড়বাসী তাদের ঐতিব্যহী 'পাড়াবন্ধ' প্রথাকে ফিরিয়ে এনেছে।
'পাহাড়ে করোনা আক্রমণ করবে না-- এটি কোনোভাবে এড়িয়ে যাবেন না', এমন মন্তব্য করে ছবিটি শেয়ার করেছেন মারমা এ মং নামে এক ব্যক্তি।
বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে সবাই যার যার ঘরে। দেশে সরকার ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর নিয়ম ভেঙ্গে গ্রামমুখী হয়েছে শহরের মানুষ। পাহাড়ে ম্রো সমাজের পাড়া প্রতিরোধক এমন ব্যবস্থার ছবি চোখ এড়ায়নি অনেকের।
এ নিয়ে রাজধানীতে বসবাসকারী আহমেদ আমান মাসুদ নামে এক ব্যক্তির মন্তব্য ছিল, পাড়াবন্ধ পাহাড়ের একটা অতি প্রাচীন পদ্ধতি। যখনই কোনো ধরনের দুরারোগ্য অথবা ছোঁয়াচে ব্যাধি মহামারি আকারে দেখা দেয় কিংবা শঙ্কা তৈরি করে, তখন পাহাড়িরা তাদের পাড়া ও নিজেদের স্বার্থে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে।

পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করা ওয়াইল্ড ওয়াচ নামে একটি ফেসবুক পেজে লেখা হয়েছে, 'আদিবাসীদের মধ্যে সবচাইতে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী ম্রো। তারা দেখিয়ে দিলো লকডাউন।'
এর আগে ২৩ মার্চ থেকে মহামারি করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করতে পাড়ায় পাড়ায় ম্রো ভাষায় লিফলেট বিতরণ করেন একদল ম্রো তরুণ।
এর প্রধান উদ্যোক্তা ইয়াঙান ম্রো জানান, বেশির ভাগ ম্রোই বাংলা জানে না। সারা দেশে কী হচ্ছে, তাদের জানা নেই। তাই করোনা ভাইরাসের বিপদের সম্পর্কে তাদের সহজে বোঝাতে ম্রো ভাষায় লিফলেট করা হয়েছে।
'বিভিন্ন ম্রো পাড়ায় তরুণরা লিফলেট বিতরণ করছে। সচেতন করে তুলছে। অনেক দুর্গম এলাকাতেও করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে', বলেন ইয়াঙান।
বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য সিংইয়ং ম্রো বলেন, ছোঁয়াচে মহামারি রোগ দেখা দিলে ম্রোদের এমন সুরক্ষার ব্যবস্থা আদিকালের। বিপদে পড়ে কেউ এসে থাকলেও পাড়ার বাইরে একটি টং ঘরে রাখা হয়। যেন সে পাড়াবাসীদের সংস্পর্শে না আসে।
ইতোমধ্যে ম্রোদের পাড়ায় বাইরে কেউ যেন ঢুকতে না পারে, সেজন্য সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারা সেখান থেকে বের হতেও পারবে না। এটি এক ধরনের ম্রো সামাজিক নিয়মে 'লকডাউন'।
পার্বত্য বান্দরবান জেলায় ২০১১ সালের আদমশুমারিতে ম্রো জনসংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার ৬৫৬ জন। কিন্তু সামাজিক সংগঠন ম্রো সোস্যাল কাউন্সিলের বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে এখন এ সম্প্রদায়ের প্রায় ৮০ হাজার জনসংখ্যা রয়েছে বলে জানা গেছে।