পাহাড়ে শুরু বর্ষবরণ উৎসব

নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান, চাকমাদের বিজু এবং তঞ্চঙ্গ্যাদের বিষু উৎসব।
এ উপলক্ষ্যে আজ শনিবার (১২ এপ্রিল) সকালে কয়েক শত চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের শিশু ও নারী-পুরুষ বান্দরবানে সাঙ্গু নদীতে ফুল ভাসান। এর মাধ্যমে পুরাতন বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেন তারা।
বিজুর তাৎপর্য তুলে ধরে ফুল ভাসাতে আসা রিয়েলি চাকমা বলেন, 'ফুল বিজু মানে নদী ও পানির সঙ্গে একটা আধ্যাত্মিক বিশ্বাস আছে। এই বিশ্বাসের মাধ্যমে আমরা নদীকে পবিত্র মনে করি। নদী বা গঙ্গাকে সম্মান করে ফুল ভাসিয়ে ফুল বিজু পালন করা হয়।'

বালাঘাটা এলাকার বাসিন্দা সুপ্রিয়া তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, 'প্রতিবছর ১২ এপ্রিল পুরাতন বছরকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। পুরাতন দুঃখ-কষ্ট ধুয়ে মুছে নতুন জীবন গড়ব। নতুন স্বপ্ন দেখব। আমরা পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসী সম্প্রদায় সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে চলতে চাই। সবার সঙ্গে সহযোগিতা করে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চাই। এভাবে মঙ্গল কামনা করে গঙ্গা বা নদীকে পূজা করে বিঝুর ফুল ভাসিয়েছি।'
বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য ও তঞ্চঙ্গ্যা কেন্দ্রীয় বিষু উৎসব উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক রাজুময় তঞ্চঙ্গ্যা জানান, 'বিষু উপলক্ষ্যে আজকের শনিবার বিকালে বান্দরবান সদর উপজেলার রেইছা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বর্ষবরণের উৎসব পালন করা হবে। সেখানে তঞ্চঙ্গ্যাদের জাতীয় ঘিলা খেলা, আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক থানজামা লুসাই এবং রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কৃষিবিদ কাজল তালুকদার অতিথি থাকার কথা রয়েছে।'

চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায় ফুল ভাসানোর দিনটিকে ফুল বিঝু নামে পালন করে। দ্বিতীয় দিন পালন করে মুল বিঝু এবং শেষের দিন পালন করা হয় গইজ্যা পইজ্যা নামে। এসব দিনে পাচন নামে এক ধরনের খাবার রান্না হয়, যেগুলোতে থাকে হরেক রকম মিশ্র সবজি। উৎসবের দিনে বেড়াতে আসা অতিথিদের পরিবেশন করা হয় এসব পাচন খাবার।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১১টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে বম, পাংখোয়া ও লুসাই সম্প্রদায় ছাড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজন ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রতিবছর বর্ষবরণ উৎসব পালন করে থাকে। পুরাতন বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণের উৎসবকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রিপুরা ভাষায় বৈসু, মারমা ভাষায় সাংগ্রাই, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় যথাক্রমে বিঝু ও বিষু এবং একসাথে 'বৈসাবি'ও বলা হয়।
এদিকে বর্মী পঞ্জিকা অনুসরণকারী চাক সম্প্রদায় সাংগ্রাই, ম্রোরা চাংক্রান, খেয়াংরা সাংলান ও খুমীরা সাংক্রাই নামে বর্ষবরণ উৎসব পালন করেন। তাদের উৎসব শুরু হয় ১৩ এপ্রিল থেকে। তারাও হরেক রকমের ফুলে ঘরবাড়ি সাজিয়ে, নানান আনুষ্ঠানিকতায় বরণ করে নেয় নতুন বছরকে।

মারমাদের ৮ দিনের সাংগ্রাই উৎসব
এদিকে মারমাদের বর্ষবরণ উৎসব সাগ্রাই পোয়ে উদযাপনে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বান্দরবানে অবস্থিত মারমাদের উৎসব উদযাপন পরিষদ। তার মধ্যে ২ এপ্রিল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, চূড়ান্ত খেলা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আজ শনিবার সুয়ালক থেকে শহরের রাজারমাঠ পর্যন্ত ম্যারাথন দৌড় এবং রাজারমাঠে ফুটবল প্রীতি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া বিকাল ৩টার দিকে সাংগ্রাই লোকজ ক্রীড়া উৎসব অনুষ্ঠিত হবে।
আগামীকাল ১৩ এপ্রিল সকাল ৭টায় রাজার মাঠ হতে মঙ্গল শোভাযাত্রা, সকাল ১০টায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউটের অডিটোরিয়ামে বয়োজ্যেষ্ঠ পূজা অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি।

১৪ এপ্রিল দুপুর ২টায় রাজগুরু বৌদ্ধ বিহার হতে বুদ্ধ মূর্তি নিয়ে যাত্রা এবং উজানী পাড়ার খেয়া ঘাটে বুদ্ধ স্নান করা হবে। এদিন রাত ৮টায় পাড়ার বিভিন্ন স্থানে পিঠা উৎসব অনুষ্ঠিত হবে।
১৫ থেকে ১৮ এপ্রিল চারদিন ব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, তৈলাক্ত বাঁশ আরোহণ, ঐতিহ্যবাহী লোকজ ক্রীড়ানুষ্ঠান ও মৈত্রী পানি বর্ষণ প্রতিদিন দুপুর ৩টা থেকে শহরের রাজার মাঠে অনুষ্ঠিত হবে। এতে একেক দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকার কথা রয়েছে– বান্দরবান রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম রাকিব ইবনে রেজওয়ান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক থানজামা লুসাই, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার।