পাখির জন্য প্রেম

ব্যাপারটা আজবই লাগছিল মৌলভীবাজারের খোকন থৌনাউজামের। মনিপুরী মিউজিয়ামে অ্যাসাইনমেন্ট করার সময় মাথায় ঘুরছিল অনলাইন গেম- লুডু লিগ। সারাদিন খেলেননি বলে বন্ধুদের কাছ থেকে পিছিয়ে যাওয়ার কথা মনে হচ্ছিল তার; ভেবেছিলেন, প্রথম স্থান দখল করা বোধহয় আর সম্ভব হবে না।
ভানুগাছ বাজার এলাকা পার হতেই অনুজপ্রতিম বিকাশ তাকে সেলফোনে কল করেন। উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, 'দাদা ইনবক্সে ছবি দিছি, দেখেন। একটা পাখি। কুকুর তাড়া করতেছিল। বৃষ্টির পরে উড়তে পারে না। বাসায় নিয়ে আসছি; কী করা যায়?'
বিকাশও খোকনের মতো পাখিপ্রেমী। ছবি দেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান খোকন। কাঠঠোকরার ছানা। কতটুকু আহত হয়েছে? বাঁচানো যাবে তো?
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গাছের বাকল ছিলে পোকা খুঁজে এই পাখিকে কীভাবে খাওয়াবেন, ভাবনায় পড়ে যান। রাতে না খেলে সকালে পর্যন্ত বাঁচবে তো?
খোকন তখন বন্ধু অর্ণবের বাইকে। গতি বাড়িয়ে সোজা চলে এলেন বিকাশের বাসায়।
তারপর ভয়ে ভয়ে হাত বাড়ালেন বাচ্চা কাঠঠোকরাটার দিকে। এদের ঠোঁট খুব শক্ত আর সুচালো। ঠক করে ঠোকর দিয়ে হাত ছিদ্র করে ফেলা অসম্ভব কিছু না। তাই খানিকটা ইতস্তত করছিলেন খোকন।
পাখিটির ছবিসহ সেই অভিজ্ঞতা ফেসবুকে শেয়ার করে খোকন লিখেছেন, 'পিটপিট করে কতক্ষণ চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকল হাতের তালুতে বসে। ভালো করে নেড়ে চেড়ে দেখলাম। না, খুব একটা আহত নয়। ডান পাশের ডানাটা একটু নামানো। কোথাও হাড় ভাঙেনি। কয়েকদিন পরিচর্যা করলে হয়তো উড়তে পারবে।'
খোকনকে পাখিটা দিয়ে দিলেন বিকাশ।
নিজের বাসায় ঢুকতেই খোকনের পোষা কাঠবিড়ালি 'লিটিল লিও' বিকট চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পাশের রুমে ঢুকে দরজার আড়াল থেকে তাকিয়ে রইল।
খোকন লিখছেন, 'বাচ্চাটা তখন আমার গায়ে চড়ে বসে চারপাশে ঘুরছে। ওয়াইল্ডে মানুষ দেখলে গাছের চারপাশে ঘুরে যেভাবে আড়াল নেয়, ঠিক সেভাবে।'
'লিওর চিৎকারে ভয় পেয়েছে বাচ্চাটা। লিওর ধারণা ছিল, শক্ত ঠোঁট দিয়ে মাথায় উঠে ঠোকর দিয়ে ছিদ্র করে ফেলবে মাথা। কাছে আসতে চাইছিল না। সমানে চিৎকার করে যাচ্ছিল। তাকে আশ্বস্ত করে একটু একটু করে কাছে এগুতে বললাম। লিও এগুলেই সেও আড়াল নিচ্ছে আমার পিঠে, পেটে।'
'আস্থা অর্জন করলে বন্যরা কখনোই মানুষের ক্ষতি করে না। মানুষের সাথে তাদের আস্থার সম্পর্কটা খুবই নাজুক। এজন্য আমরাই দায়ী। তথাকথিত সৃষ্টির সেরা হিসেবে দাবিদার আমরা নিজেদের সেই উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারিনি কোনোদিন,' ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন খোকন।
আরও লিখেছেন, 'বাচ্চাটা এখন কোমরের দিকে ট্রাউজার আকড়ে ধরে টিশার্টের নিচে মুখে লুকিয়ে ঘুমাচ্ছে। মাঝে মাঝে পেটে আলতো করে ঠোট ছুঁয়ে দিচ্ছে।'
'অনেকক্ষণ বসা ছিলাম। নড়তে ভয় হচ্ছিল। পাছে যদি ভয় পেয়ে ঘুম ভাঙ্গে। বিশ্রাম দরকার তার। দ্রুত শক্তি ফিরে পাওয়া দরকার। খুব দ্রুত ফিরে যেতে হবে তাকে তার নিজের চেনা জগতে।'
বাচ্চা কাঠঠোকরাকে পেয়ে অনেক পছন্দের লুডু লিগ খেলতে একদমই ইচ্ছে করেনি খোকনের। কেননা, পাখিটার ঘুম ভাঙাতে চাননি তিনি।