কন্যাশিশু: হোক অদম্য বাধাহীন ছকের বাইরের পরিপূর্ণ মানুষ

২০০৯ সালে রাধার বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ। তখন ওর বিয়ে ঠিক হয়। দিনাজপুর জেলার দারিদ্রপীড়িত এক গ্রামে বেড়ে উঠেছে রাধা। মা-বাবাও ছিলেন আর্থিক সংকটে। মেয়ের বিয়ে দিতে পারলেই ওর ভবিষ্যত নিশ্চিত হযে যাবে, এই ছিল তাদের ধারণা।
রাধা কিন্তু জানতেন অল্পবয়সে বিয়ের ফলে মেয়েদের কী কী বিপদ হতে পারে সে কথা। কিশোরী বধূ শারীরিক ও যৌননির্যাতনের শিকার হতে পারে। গর্ভবতী হলেও তার সন্তান নিয়ে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে কিশোরী মায়ের।
মা-বাবা এসব বিষয়ে সচেতন ছিলেন না বলে রাধাকেই নিজের বিয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হল। সে ঘটনার পর দশ বছর পেরিয়ে গেছে। চব্বিশ বছর বয়সী রাধা এখন স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া করছেন। পড়াশুনা শেষের পথে তার। এই ফাঁকে নিজের এলাকায় কন্যাশিশুদের বিয়ে বন্ধ করতেও কাজ করছেন রাধা।
তবে তার মতো ভাগ্য সবার হয় না। এদেশে প্রতিদিনই কিশোরীরা বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। দারিদ্র, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপদ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগের অভাব, সামাজিক চাপ, যৌননিপীড়ন, নানা রকমের বলপ্রয়োগ ও হুমকি-ধামকি তো রয়েছেই— এমনকি বিয়েতে যৌতুকের মতো ঘটনাগুলোর জন্য মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চান অভিভাবকরা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ২০১৭ সালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আঠারোর আগে দেশের অর্ধেকের বেশি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। ১৯ জেলায় ওরা জরিপটি পরিচালনা করেছিল। তবে জরিপে বাল্যবিয়ের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসার চিত্রও উঠে এসেছে।
সরকারের জন্য বাল্যবিয়ে বরাবরই একটি উদ্বেগের বিষয়। দেশ থেকে এটি পুরোপুরি নির্মূল করতে সরকারকে নানা সময় নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে হয়েছে। কারণ বাল্যবিয়ে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
২০৪১ সালের মধ্যে দেশ থেকে বাল্যবিয়ে দূর করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রযেছে একটি করমুক্ত হেলপলাইন স্থাপন। ১০৯৮ নম্বরে ফোন করে যে কেউ দেশের যে কোনো স্থানে বাল্যবিয়ে সংঘটন এবং শিশুর প্রতি সহিংসতা ও নিফড়িনের বিষয়ে রিপোর্ট করতে পারেন।
শিক্ষার সঙ্গে বাল্যবিয়ের সংযোগ নিবিড়। কন্যাশিশুর বিয়ে হয়ে গেলে সে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পড়াশুনাটা চালিয়ে যেতে পারে না। জাতিসংঘের উপাত্তে এই চিত্র উঠে এসেছে। মাধ্যমিক স্তর বা তার চেযে উচ্চতর স্তরে যে মেয়েরা পড়তে পেরেছে-- এর চেযে কম লেখাপড়ার সুযোগ পাওয়া মেয়েদের চেয়ে তাদের বিয়ে কমপক্ষে পাঁচ বছর পরে হয়েছে।
প্রতি বছর স্কুলে মেয়েদের ভর্তি হওয়ার হার বাড়ছে। কিন্তু একই সঙ্গে বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে মেয়েদের লেখাপড়া ছেড়ে দেবার হারও এখনও উচ্চ রয়ে গেছে।

এতসব সমস্যার পরও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে ছেলেদের চেয়ে বেশি ভালো ফলাফল করছে মেয়েরা। এ বছর এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-ফাইভ পাওয়া শিক্ষার্থীদের অর্ধেকরও বেশি মেয়ে।
সামগ্রিকভাবে এইএসসিতে মেয়েদের পাশের হারও বেশি। ৭৬.৪৪ শতাংম মেয়ে এবার উর্ত্তীণ হতে পারলেও ছেলেদের মধ্যে এ হার ৭১.৬৭ শতাংশ।
তারপরও নেতিবাচক চিত্রগুলো এড়ানো যায় না। এদেশে এখনও ৪০ শতাংশ কিশোরীকে স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। ওদিকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেইসলাইন সার্ভে ২০১৪ অনুযায়ী, শহরাঞ্চলে মাত্র ২১ শতাংশ কিশোরী মাসিক ঋতুস্রাবের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারে।
কিশোরীর পুষ্টি চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ না হওয়াও আরেকটি সমস্যা। বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উপর ইউএসএইডের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৫-১৯ বছর বয়সী মেয়েদের এক-তৃতীয়াংশের ওজন বয়স অনুযায়ী কম।
যে কিশোরী শারীরিক ও মানসিকভাবে শিশুর জন্ম দেবার জন্য তৈরি নয়, তাকে বিয়ে দেওয়া হলে অবস্থা গুরুতর হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে এখনও পরিণত বয়সে পৌঁছুবার আগে প্রায় ৮৪ শতাংশ কিশোরী বধূ সন্তানের জন্ম দেয়।বৈশ্বিক শিশু পরিস্থিতির রিপোর্টে এ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
সাধারণত এই কিশোরীদের জন্য মাতৃত্ব ঝুঁকিপূর্ণ। কিশোরী মায়ের গর্ভস্থ শিশু ও সদ্যপ্রসূত শিশুর মৃত্যুঝুঁকিও বেশি।
বাংলাদেশের কন্যাশিশুদের সামগ্রিক চিত্রটি সামান্য হলেও উন্নত হয়েছে বলে তথ্য-পরিসংখ্যান সাক্ষ্য দিচ্ছে। কিন্তু অপুষ্টি, বাল্যবিয়ে, ঋতুস্রাবের সময় যথাযথ স্বাস্থ্য-সুরক্ষা না পাওয়াসহ নানান সামাজিক বেড়াজাল ও প্রতিবন্ধকতায় কিশোরীর সুন্দর ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
নারীর অধিকার সুরক্ষিত করা, তাদের বেশিসংখ্যককে দক্ষ শ্রমশক্তিতে যুক্ত করা এবং সমাজে লিঙ্গ-সমতা প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি। আর সেজন্যই দরকার কিশোরীদের জন্য সমাজে সুস্থ একটি পরিবেশ। যেখানে ওরা বেড়ে উঠবে বাধাহীন, অদম্য, ছকের বাইরের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে।