কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার জন্য মাকে দায়ী করা কেন?

মেয়ে সন্তানের জন্ম যে অনেক পরিবারেই কাঙ্ক্ষিত নয়, তা আমরা জানি। শুধু গ্রামে নয়, শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারেও পুত্র সন্তানের ব্যাপক চাহিদা। এদের সবারই ধারণা ছেলে সন্তান বংশের বাতি, সম্পত্তি রক্ষা করবে ও ছেলে সন্তান বাবা-মায়ের দেখাশোনা করবে। আর পরিবারে এই ছেলে সন্তান উপহার দেয়ার দায়িত্ব নারীর অর্থাৎ মায়ের। একইভাবে 'অপয়া' কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার দায়ও মায়েরই।
তাইতো কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলায় একজন বাবা কন্যাসন্তান হওয়ায় রাগে-ক্ষোভে সন্তানকে দেখতে এসেছেন প্যাকেটে মিষ্টির পরিবর্তে বালু-মাটি নিয়ে। প্রসূতি আছমা বেগম অভিযোগ করেছেন, 'বিয়ের পর থেকে আমার স্বামী আমাকে নির্যাতন করতো। আমার গর্ভে সন্তান এসেছে, এ খবর জানার পর আরও বেশি নির্যাতন করতো। বলতো, ছেলে হলে সুখ পাবে, আর মেয়ে হলে দুঃখ পাবে। পরে আমার মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। এ সংবাদ পেয়ে আমার স্বামী আমাদের বাড়িতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসে। বাড়ির লোকজন প্যাকেট খুলে দেখে বালুভর্তি। ওই প্যাকেটে মিষ্টি ছিল না।' তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত মোকছেদুল ইসলাম।
এই ধারণা শুধু কুড়িগ্রামের মোকছেদুল ইসলামের নয়, বাংলাদেশের অনেক পুরুষের। পুরুষ একা নয়, নারীও এই অবৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্বাস করেন এবং নিজেকে দায়ী মনে করেন। বাংলাদেশে অবৈজ্ঞানিক ও নেতিবাচক সামাজিক ধারণার কারণে কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মায়েদের দায়ী করা হয়। অথচ বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এর বিপরীত কথা বলে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাব থেকে, লিঙ্গ নির্ধারণ সম্পর্কে এই ভুল ধারণার সৃষ্টি।
লিঙ্গ নির্ধারণের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে স্পষ্টতই বলা আছে সন্তানের লিঙ্গ পিতার শুক্রাণু দ্বারা নির্ধারিত হয়, যা এক্স (X) ও ওয়াই (Y) ক্রোমোজোম বহন করে। যদি শুক্রাণুর X ক্রোমোজোম মায়ের Y ক্রোমোজোমের সাথে মিলিত হয়, তবে ফলাফল হবে কন্যা (XX); যদি Y ক্রোমোজোম মিলিত হয়, তবে ফলাফল হবে পুত্র (XY)।
এই প্রক্রিয়াটি নিজের মতো কাজ করে এবং বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য নারীদের দায়ী করার কোন মানে হয় না। সন্তানের লিঙ্গের উপর মায়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কারণ এটি গর্ভধারণের সময় নির্ধারিত হয়। আর সবচেয়ে জরুরি কথা হচ্ছে লিঙ্গ নির্বিশেষে, প্রতিটি সন্তান সমানভাবে মূল্যবান।
সাধারণত কম শিক্ষিত, দরিদ্র ও গ্রামের মানুষের মধ্যে এই ধারণা বেশি প্রচলিত। অবশ্য বিভিন্ন শহুরে ও শিক্ষিত পরিবারেও এই কথাই বিশ্বাস করা হয়। বিজ্ঞান বলে সন্তানের লিঙ্গ বাবার শুক্রাণু দ্বারা নির্ধারিত হয়, মায়ের দ্বারা নয়। কাজেই মাকে দায়ী করা একেবারে অন্যায্য।
মাকে দায়ী করার এই প্রবণতা নারীর প্রতি সামাজিক কলঙ্ক আরোপ এবং দুর্ব্যবহারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য অনেক পরিবারে মায়েদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করা এবং হয়রানিও করার হয়। এই কারণে মায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে। কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার জন্য মাকে দায়ী করা পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবের সাথে সম্পর্কিত।
মাকে দায়ী করার পাশাপাশি এরা কন্যা শিশুর জন্মকেও অস্বীকার করে। এই ধারণা "পশ্চাৎপদ ও কূপমণ্ডূক সমাজে" প্রচলিত। সেখানে সঠিক জ্ঞানের অভাব মানুষকে অভব্যতার দিকে নিয়ে যায়। যে সমাজে এই ধারণা থাকে, সেই সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য টিকে থাকে।
কুড়িগ্রামের আসমা খাতুন একা নন, যাকে কন্যা জন্ম দেয়ার কারণে মাটির ঢেলা পাঠানো হয়েছে। ঢাকা শহরে ব্যাংকে কর্মরত একজন নারীকে পুত্র সন্তান পাওয়ার আশায় চতুর্থবারের মতো সন্তানের মা হতে হয়েছে। পরপর তিনবার সিজার করায় এখন তার অবস্থা আশংকাজনক। নারীর স্বাস্থ্য চিন্তা এখানে উপেক্ষিত।
২৬ বছরের বিবাহিত জীবনে পাঁচটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়ার দায়ে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছ থেকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন সাবিনা (ছদ্মনাম)। পুত্র সন্তান না হওয়াটাকে তারা সাবিনার ব্যর্থতা হিসেবে দেখেছে। এজন্য সাবিনাকে দুর্ব্যবহার, অনাহারে রাখা এবং শ্বশুরবাড়ি থেকে বের করে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।
এইসব ঘটনা দেখে প্রশ্ন জাগে যে আমরা কি 'আইয়ামে জাহেলিয়া' যুগে ফিরছি? যে যুগে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। বাংলাদেশের মতো আরও দেশ আছে যেখানে পুত্র সন্তানই কাঙ্ক্ষিত। বিশ্বজুড়ে ছেলে সন্তানের আশায় বছরে ১৫ লাখ মেয়ে শিশুর ভ্রূণ নষ্ট করা হয় এবং জন্ম নেয়ার পর আরও ১৭ লাখ মেয়ে শিশুর মৃত্যু হয় অবহেলা ও বৈষম্যজনিত কারণে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক তহবিলের (ইউএনএফপিএ) পরিসংখ্যানে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
'পক্ষপাতমূলক লিঙ্গ নির্ধারণের ঝুঁকি' শীর্ষক এক আলোচনায় বলা হয়েছে ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর ১ কোটি ৪২ লাখ নারী বিশ্বাস করেন, শুধু মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ার কারণে তারা পরিবার ও সমাজ থেকে নিগৃহীত হয়েছেন। বেশিরভাগ সময় এদের পরিবার থেকে শুনতে হয়, তার পরিবার একজন মেয়ে নয়, বরং ছেলে সন্তান প্রত্যাশা করেছিলো।
সংস্থাটির বাংলাদেশে পরিচালিত জরিপের তথ্য বলছে, ১০০ মেয়ে সন্তানের বিপরীতে বর্তমানে ১০৫ জন ছেলে সন্তান জন্ম নিচ্ছে। জরিপের তথ্য থেকে আরও জানা যায়, দেশে ১৮ শতাংশ নারী ছেলে সন্তান চান। ১২ শতাংশ নারী চেয়েছেন মেয়ে সন্তান। ৪০ শতাংশ মানুষ ছেলে না মেয়ে সন্তান হবে, তার আগাম পরীক্ষা করছেন। আর ৬ শতাংশ মানুষ সন্তান নেয়ার ক্ষেত্রে মেয়ে ভ্রূণ নষ্ট করছেন। মায়েরা কেন ছেলে সন্তান চাইছেন, কেন মেয়ে সন্তানের ভ্রূণ নষ্ট করছেন? কারণ সমাজের চাপ এবং শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব। তারাও মেয়ে সন্তানকে 'কম লাভজনক' বা 'অপ্রয়োজনীয়' মনে করছেন। সেইসাথে তারা ভাবছেন মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়ার দায়ে তারা নির্যাতিত হতে পারেন।
অদ্ভ'ত ব্যাপার হচ্ছে পরিবার যদি জানতে পারে কোন গর্ভবতী নারীর কন্যা হবে, তাহলে সেই নারীর কম যত্ন নেয়া হয়। গর্ভে পুত্র সন্তান থাকলে তার যত্ন বেশি নেওয়া হয়। সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। একাধিক কন্যা সন্তানেরা মায়েরা দুর্ব্যবহার, বিবাহ বিচ্ছেদ বা এমনকি প্রাণ হারানোর ভয়ও করেন।
গ্রামীণ এলাকায়, বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারে, কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার পর মাকে প্রায়ই শ্বশুরবাড়ি ও সমাজের তিরস্কারের মুখে পড়তে হয়। রংপুরের একটি গ্রামে একজন মা টানা তিনটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর তার শাশুড়ি ও স্বামী তাকে "বংশের উত্তরাধিকারী" না দেওয়ার জন্য মানসিক নির্যাতন করেছিল। এমনকি, স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার হুমকি দিয়েছিল। (প্রথম আলো)।
কন্যা সন্তান জন্মের পর যৌতুকের চাপ বাড়তে পারে। ব্র্যাকের এক প্রতিবেদনে (২০২১) উল্লেখ করা হয়েছিল যে খুলনার একটি গ্রামে একজন মা কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে অতিরিক্ত যৌতুকের জন্য চাপ দিয়েছিল। তারা মনেকরতো কন্যা সন্তান পরিবারের জন্য "অর্থনৈতিক বোঝা"। এই ধরনের ঘটনা মাকে দায়ী করার পাশাপাশি তার উপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়ায় মাকে সামাজিক কটূক্তির মুখে পড়তে হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পুত্র সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। পাশাপাশি আছে কন্যা সন্তানের প্রতি প্রবল ঘৃণা। বাংলাদেশের মতো সেইসব দেশেও সন্তানের লৈঙ্গিক পরিচয়ের জন্য মায়েদেরই দায়ী করা হয়। প্রায় সব ধরনের পরিবারেই কন্যা সন্তান ধারণ করার ব্যাপারে মাকেই দায়ী করা হয়। দেখা গেছে সম্ভ্রান্ত ও গৃহস্থ পরিবারের স্বামী, তার স্ত্রীকে এবং তাদের দুই কন্যাকে অস্বীকার করেছে। ছেলে পাওয়ার জন্য দুই/তিনবার বিয়ের ঘটনাও আকছার ঘটছে। কন্যা শিশু হত্যা এবং লিঙ্গ-নির্দিষ্ট গর্ভপাত বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে "খুব বেশি ও সাধারণ ঘটনা"।
কন্যা সন্তান হওয়ার জন্য মাকে দায়ী করা ও কন্যা সন্তান গ্রহণ না করার মানসিকতা পারিবারিক কাঠামোকে দুর্বল, অস্থিতিশীল ও অসুখী করে তোলে। লিঙ্গ বৈষম্যকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক সুযোগ প্রাপ্তিতে বাধার সৃষ্টি করা হয়। যদিও সমাজে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে, তবুও সেকেলে কিছু চিন্তা ও কুসংস্কার এখনো প্রভাব ফেলে।
আবারও বলছি কন্যা সন্তান জন্মানোর জন্য মাকে দায়ী করা এবং কন্যা সন্তানের ভ্রূণ নষ্ট করা এক ধরনের সামাজিক ব্যাধি। এই সমস্যা বা রোগ মোকাবিলার জন্য প্রচুর প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। সরকারি ও এনজিও উদ্যোগ, গণমাধ্যম, নারী শিক্ষা, লিঙ্গ সংবেদনশীলতা প্রোগ্রাম এবং বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে মেয়ে ও ছেলে সন্তান দুইই পরিবার ও সমাজের জন্য সমান আদরণীয় ও নির্ভরযোগ্য।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।