চার্লস ঝড়ে মাশরাফির সিলেটকে হারিয়ে কুমিল্লার রেকর্ড শিরোপা

জনজন চার্লসের নেওয়া জয়সূচক রানটি পূর্ণ হতেই মাঠে ভোঁ দৌড় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের ক্রিকেটারদের। মাঠে গিয়ে তাদের উদযাপন শুরু হতেই নিভে গেল মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সব ফ্লাড লাইড। শুরু হয়ে গেল লেজার শো, আলো-আধারীর খেলার মাঝে মাঠে তখন আনন্দে মশগুল কুমিল্লার সবাই। এক পাশ থেকে লেজার শো, অন্য পাশ থেকে আকাশে ফুটতে থাকলো নানা রঙের আতশবাজি। আর রঙের বাহারি ছটায় গা ভাসিয়ে উদযাপন করে যেতে থাকলো বিপিএলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জেতা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।
বিপিএলের ফাইনালে হারেন না মাশরাফি বিন মুর্তজা, হারে না কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সও। অপরাজেয় বনাম অপরাজেয়র লড়াই। এদিন এক পক্ষকে হারতেই হতো, সেই পক্ষটি হলো মাশরাফির সিলেট। লিটন কুমার দাসের পর ম্যাচসেরা জনসন চার্লসের ঝড়ে সিলেটকে হারিয়ে বিপিএলের রেকর্ড শিরোপা জিতলো কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। বৃহস্পতিবার বিপিএলের ফাইনালে সিলেটকে ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে হারিয়েছে কুমিল্লা।
লিগ পর্ব থেকে ছড়ি ঘোরানো কুমিল্লা টানা ১১ ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন হলো। এটা তাদের টানা দ্বিতীয় শিরোপা, সব মিলিয়ে চারবার। যা বিপিএলে কোনো দলের পক্ষে সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তিনটি শিরোপা জিতেছে ঢাকার ফ্র্যাঞ্চাইজি। কুমিল্লার শাসনে মাশরাফির রাজত্বে পড়লো হানা, প্রথমবারের মতো বিপিএলের ফাইনালে হারলেন অধিনায়ক হিসেবে শততম ম্যাচ খেলতে নামা অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার। আগের চারবারই তার মাথায় উঠেছিল সেরার মুকুট। মাশরাফির পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তিনবার অধিনায়ক হিসেবে শিরোপা জিতলেন ইমরুল কায়েস।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামে সিলেট স্ট্রাইকার্স। হাফ সেঞ্চুরি করা নাজমুল হোসেন শান্ত ও মুশফিকুর রহিম ছাড়া কেউ-ই বড় ইনিংস খেলতে পারেনি। ব্যাটিং করা বাকি সাত ব্যাটসম্যানের মধ্যে কেবল একজন দুই অঙ্কের রান করেন, বাকিরা উইকেটে গেছেন আর ফিরেছেন। শান্ত-মুশফিকের ব্যাটে ৭ উইকেটে ১৭৫ রান তোলে সিলেট। জবাবে লিটনের হাফ সেঞ্চুরির পর মঈন আলীকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাট হাতে ঝড় তোলা চার্লস ৪ বল হাতে রেখেই কুমিল্লাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেন।
জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে তৃতীয় ওভারেই উইকেট হারায় কুমিল্লা। সিলেটের পেসার রুবেল হোসেনের বলে ক্যাচ তুলে বিদায় নেন ১০ রান করা ক্যারিবীয় অলরাউন্ডার সুনিল নারিন। অধিনায়ক ইমরুল কায়েসও থিতু হতে পারেননি। পরের ওভারেই তাকে ফিরতে হয়, ৩ বলে ২ রান করেন তিনি। ৩৪ রানে ২ উইকেট হারানো দলকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন লিটন কুমার দাস ও জনসন চার্লস।
পাওয়ার প্লের ৬ ওভার থেকে ৪৯ রান পায় কুমিল্লা। ততোক্ষণে উইকেটে মানিয়ে নেওয়া লিটন ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকেন, খেলতে শুরু করেন নয়নাভিরাম সব শট। সাবলীল ব্যাটিংয়ে চার্লসও দারুণ সঙ্গে দিতে থাকেন। যদি ক্যারিবীয় এই ব্যাটসম্যান ব্যক্তিগত ৮ রানেই ফিরে যেতে পারতেন, কিন্তু তার তোলা ক্যাচ মাটিতে ফেলে দেন রুবেল।
দাপুটে ব্যাটিংয়ে ৩৭ বলে ৫টি চার ও একটি ছক্কায় হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন লিটন। রান তোলার কাজটি তিনিই করে যাচ্ছিলেন, সুযোগে বুঝে শট খেলে লিটনকে স্ট্রাইক দিচ্ছিলেন চার্লস। তৃতীয় উইকেটে ৫৭ বলে ৭০ রানের জুটি গড়েন লিটন-চার্লস। দলকে ১০০ পেরিয়ে দিয়ে বিদায় নেন লিটন। ডানহাতি এই ওপেনার ৩৯ বলে ৭টি চার ও একটি ছক্কায় ৫৫ রান করেন।
লিটনের বিদায়ের পর কুমিল্লার রান তোলার গতিতে ভাটা পড়ে, বাড়তে থাকে রান-বলের ব্যবধান। ১৫ ওভারে মাত্র ৩ রান খরচা করেন জর্জ লিন্ডা। ১৬তম ওভারটিও দারুণভাবে শেষ করেন লুক উড, তার খরচা ৫ রান। ২৪ বলে কুমিল্লার প্রয়োজন দাঁড়ায় ৫২ রান। রান-বলের ব্যবধান ঘুচিয়ে দলকে জয়ের বন্দরে নেওয়ার গুরু দায়িত্ব তখন চার্লস ও মঈন আলীর ওপর।
রানে-বলে আগানো চার্লস পরের ওভারে রুবেলের ওপর চড়াও হলেন, চার-ছক্কার ফুলঝুরি সাজিয়ে ১৭তম ওভার থেকে ২৩ রান তোলেন তিনি। ৩৫ বলে ৩৫ রান করা ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান ৪১ বলে পূর্ণ করে ফেলেন, রান-বলের ব্যবধানও কমে আসে কুমিল্লার। ১৮ বলে ২৯ রান দরকার পড়ে তাদের। পরের ওভার থেকে ৮ রান তুললে ১২ বলে ২১ রানের প্রয়োজন পড়ে দলটির।
উডের করা ১৯তম ওভারের প্রথম দুই বলেই ছক্কা মারেন চার্লস। এরপর মারেন আরও একটি চার, সব মিলিয়ে ১৮ রান তুললে জয়ের জন্য শেষ ওভারে কুমিল্লার প্রয়োজন পড়ে মাত্র ৩ রান। অফ স্পিন করা মাশরাফির প্রথম দুই বল থেকেই মিলে যায় তা। ম্যাচসেরা চার্লস ৫২ বলে ৭টি চার ও ৫টি ছক্কায় ৭৯ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলেও অপরাজিত থাকেন। ১৭ বলে অপরাজিত ২৫ রান করেন মঈন। সিলেটের রুবেল ২টি এবং জর্জ লিন্ডা একটি উইকেট নেন।
এর আগে ব্যাটিং করা সিলেট স্ট্রাইকার্স মন মতো শুরু করতে পারেনি। আসরজুড়ে দারুণ ব্যাটিং করা তৌহিদ হৃদয় এদিন রানের খাতা খোলার আগেই বিদায় নেন। দলীয় ১৮ রানে প্রথম উইকেট হারানো দলকে পথ দেখাতেই আগেই নেমে পড়েন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। কিন্তু আগের দুই ম্যাচে কার্যকরী ইনিংস খেললেও এবার পারেননি, ৪ বলে ১ রান করে বিদায় নেন তিনি।
২৬ রানে নেই ২ উইকেট, চাপ তখন সিলেটের মাথায় পাহাড় সমান। এমন সময়ে নাজমুল হোসেন শান্তর সঙ্গে জুটি বাধেন মুশফিকুর রহিম। মুহূর্তেই চাপ কাটিয়ে দ্রুত গতিতে রান তুলতে থাকেন এই দুজন। তৃতীয় উইকেট জুটিতে ৫৬ বলে ৭৯ রান যোগ করেন তারা। দলীয় সংগ্রহ ১০০ পেরিয়ে সাজঘরে ফেরেন এবারের বিপিএলের রানের ফোয়ারা বইয়ে দেওয়া শান্ত।
এর আগে ৪৫ বলে ৯টি চার ও একটি ছক্কায় ৬৪ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন বাঁহাতি এই ওপেনার। ১৫ ম্যাচে চারটি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৩৯.৬৯ গড় ও ১১৬.৭৪ গড়ে ৫১৬ রান করেছেন শান্ত, যা আসরের সর্বোচ্চ। তার বিদায়ের পর দিক হারায় সিলেট। মুশফিকের সঙ্গে যোগ দিয়ে ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিলেও ইনিংস বড় করতে পারেননি রায়ান বার্ল। জিম্বাবুয়ের এই ক্রিকেটার ১১ বলে ১৩ রান করে আউট হন।
বার্ল ফেরার পর মুশফিক একাই লড়াই করেছেন, অন্য প্রান্তে বেজে গেছে ভাঙনের সুর। তৃতীয় ওভারে উইকেটে যাওয়া অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং করেন। ৪৮ বলে ৫টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৭৪ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলেন মুশফিক। কুমিল্লার পেসার মুস্তাফিজুর রহমান ২টি উইকেট নেন। একটি করে উইকেট পান আন্দ্রে রাসেল, তানভীর ইসলাম, সুনিল নারিন ও মঈন আলী।