গভীর সংকটে ইউনিয়ন ব্যাংক, যোগসাজশে করা হয় আর্থিক কারসাজি

একসময় এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত ইউনিয়ন ব্যাংক চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। তার ছয় মাস আগেও এ পরিমাণ ছিল মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা—অর্থাৎ, মাত্র ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০০ গুণ।
এ ঋণ এখন ব্যাংকের মোট ঋণের ৮৭ শতাংশ, যা আগের ৩.৮২ শতাংশ থেকে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এতে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে ব্যাংকটি।
২০১৩ সালে রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে লাইসেন্স পাওয়া ইউনিয়ন ব্যাংক গত এক দশক ধরে প্রকৃত অবস্থার চেয়ে ভালো ছবি দেখাতে মন্দ ঋণ গোপন রেখেছিল। কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণের হার কম দেখিয়ে একধরনের ভুয়া আর্থিক চিত্র তুলে ধরেছিল ব্যাংকটি।
তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব তথ্য সামনে আসতে শুরু করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। এর মধ্যে ১৮ শতাংশ ঋণ বাড়ার পেছনে এককভাবে দায়ী ইউনিয়ন ব্যাংক।
ফলে ব্যাংকটির ১৪ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি তৈরি হয়েছে এবং মূলধন উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষয় হয়েছে। বাধ্য হয়ে ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিতে শুরু করে।
২০২৩ সালে ইউনিয়ন ব্যাংক ১৬০ কোটি টাকা মুনাফার দাবি করলেও ২০২৪ সালে প্রভিশন ঘাটতির বিপরীতে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে মোট মুনাফা ছিল মাত্র ৫৫৭.৬৪ কোটি টাকা।
এতে ধারণা করা হচ্ছে, আগের মুনাফার এ হিসাব সম্ভবত মন্দ ঋণ আড়াল করে দেখানো হয়েছিল।
ব্যাংকটির ঋণ আমানত অনুপাতসীমা (এডিআর) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৮ শতাংশ, যেখানে নির্ধারিত সীমা ৯২ শতাংশ। এ উচ্চ হার থেকে স্পষ্ট, ব্যাংকটি বেপরোয়া ঋণ বিতরণ করেছে এবং বর্তমানে চরম তারল্য সংকটে রয়েছে।
তদারকি ব্যর্থতা
সব ধরনের বিপদচিহ্ন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা বাহ্যিক নিরীক্ষকেরা ব্যাংকটির কোনো অসঙ্গতি ধরতে পারেনি। এমনকি ২০২৩ সালেও ব্যাংকটি এ+ ক্রেডিট রেটিং পেয়েছিল।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ব্যাংকটিকে নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করতে অনুমতি দিয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত পরিশোধই করা হয়নি। এসব কারণে ইউনিয়ন ব্যাংককে ডিএসই-তে 'জেড' শ্রেণিতে নামানো হয়।
বর্তমানে ব্যাংকটির শেয়ারের দাম ৩ টাকা, যা ১০ টাকার অভিহিত মূল্যের তুলনায় অনেক কম।
৯০ শতাংশ ঋণ গেছে এস আলমের কাছে
ব্যাংকের বেশিরভাগ ঋণই বিতরণ হয়েছে চট্টগ্রাম-কেন্দ্রিকভাবে—মোট ঋণের ৫৬ শতাংশ। এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ব্যাংকের ৯০ শতাংশ ঋণ এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে গেছে।
এর অনেক ঋণেরই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল না। শ্রেণিবদ্ধ ঋণের অন্তত ৪০ শতাংশের কোনো সুনির্দিষ্ট ঋণগ্রহীতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, 'এস আলম ভবনেই ঋণ প্রকল্প তৈরি হতো। শাখা ব্যবস্থাপকরা সরাসরি গ্রুপটির চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের চাচাতো ভাই ও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর নির্দেশেই কাজ করতেন।'
ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম মানা হতো না। ঋণ পরিশোধ না করেই একের পর এক নবায়ন করা হতো। এর ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ঋণ পেতেন না।
আগস্টে সরকারের পরিবর্তনের পর এ অনিয়ম বন্ধ হয়।
মোকাম্মেল ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে ছিলেন। তিনি ঋণের সঠিক শ্রেণিকরণে বাধা দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পরে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা তার ও স্ত্রীর একাধিক অ্যাকাউন্ট জব্দ করলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান।
আস্থা ফেরানোর লড়াইয়ে নতুন ব্যবস্থাপনা
২০২৪ সালের আগস্টে ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠিত হয় এবং তাতে এস আলম গ্রুপের প্রভাব দূর করা হয়।
এরপর ২০২৫ সালের মার্চে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে মো. হুমায়ুন কবির নিয়োগ পান। তিনি জানান, ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ২ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা পেয়েছে এবং বর্তমানে আমানতকারীদের ঋণ পরিশোধ শুরু করেছে।
তিনি আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন, ঋণখেলাপির হার ধীরে ধীরে কমে আসবে। তার দাবি, এস আলম গ্রুপসহ কয়েকজন বড় ঋণগ্রহীতা ঋণ নিষ্পত্তির বিষয়ে আলোচনায় রয়েছে। একইসঙ্গে প্রতারক ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
মো. হুমায়ুন কবির বলেন, 'আমরা আশা করছি জুনের মধ্যেই স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। আমাদের দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।'
যোগসাজশে আর্থিক কারসাজি
অভ্যন্তরীণ টিম, বাহ্যিক নিরীক্ষক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি—কেউই ব্যাংকটির গোপন রাখা বিশাল পরিমাণ খেলাপি ঋণ শনাক্ত করতে পারেনি।
২০২৩ সালের নিরীক্ষা করে এমএম রহমান অ্যান্ড কোং, আর আগের বছরগুলোতে করে অন্যান্য তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান। স্বচ্ছতা নিশ্চিতের কথা থাকলেও এ প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক হিসাব সঠিকভাবে যাচাই করতে ব্যর্থ হয়।
জালিয়াতিপূর্ণ আর্থিক বিবরণী তৈরির পেছনে ছিলেন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম মোকাম্মেল হক চৌধুরী এবং প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন। দুজনই এস আলম গ্রুপের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
বোর্ড পুনর্গঠনের পর আমিনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়, আর মোকাম্মেল আত্মগোপনে চলে যান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান স্বীকার করে বলেন, অনেক ঋণগ্রহীতার আগের ব্যবসায়িক পরিচিতির কারণে তাদের ঋণ শ্রেণিবদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর এ অনুশীলন বন্ধ হয়।
তিনি জানান, অনেক প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতা তখন থেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন।
২০২০ সালের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে ব্যাংকের ৯০ শতাংশ ঋণ শ্রেণিবদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু যে কর্মকর্তা প্রতিবেদনটি করেছিলেন, তাকে বদলি করা হয় এবং তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবিরের আমলে সে প্রতিবেদন উপেক্ষিত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক একদিকে ব্যাংকটিকে এডিআর সীমা অতিক্রম করতে অনুমতি দেয়, অন্যদিকে লভ্যাংশ ঘোষণারও অনুমোদন দেয়।
ইউনিয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতাদের একত্রে বৈঠকে বসিয়ে কাগজে-কলমে ঋণ পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রেণিকরণ এড়ানোর চেষ্টা চালানো হয়েছিল।
২০২৪ সালের জুন প্রান্তিকে ইউনিয়ন ব্যাংক আয় ও নগদ প্রবাহে ইতিবাচক চিত্র দেখালেও সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পরিস্থিতি পুরো উল্টে যায়—শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়ায় মাইনাস ০.৭৭ টাকা এবং পরিচালন নগদ প্রবাহ হয় মাইনাস ১৯.৫০ টাকা।
এস আলম পরিবারের দখলে ইউনিয়ন ব্যাংক
২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন ব্যাংক কার্যত এস আলম গ্রুপের দখলে ছিল। গ্রুপটির কর্ণধার সাইফুল আলমের ছেলে আহসানুল আলম মাত্র ২৪ বছর বয়সে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন, যা তাকে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সি ব্যাংক চেয়ারম্যানে পরিণত করে।
এর আগে তিনি ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন এবং নির্বাহী কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন। তার চাচা শহীদুল আলমও এর আগে চেয়ারম্যান পদে ছিলেন।
২০২৩ সালে আহসানুল ইসলামি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার পর ব্যাংকিং খাতে এস আলম গ্রুপের প্রভাব আরও বেড়ে যায়।
দামি অফিস, দায়হীন তদারকি
ইউনিয়ন ব্যাংকের আকার ছোট হলেও তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাম্মেল হকের অফিস ছিল দেশের অন্যতম বড় এমডি অফিসগুলোর একটি।
সেখানে ছিল তার ব্যক্তিগত জিম এবং তিনটি ওয়েটিং রুম। তাকেই এস আলম গ্রুপের আর্থিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের মূল ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।