কাতারে এক টুকরো মরক্কো: ইতিহাসের সাক্ষী হতে ছুটে আসছেন হাজারো সমর্থক

কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল। খেলা চলছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালের সঙ্গে আফ্রিকা মহাদেশের দল মরক্কোর। হঠাৎ প্রতিপক্ষের একটি ট্যাকলে মাঠে লুটিয়ে পড়লেন পর্তুগিজ তারকা ব্রুনো ফার্নান্দেস, তার সতীর্থরা ছুটে গেলেন রেফারির কাছে পেনাল্টির আবেদন নিয়ে; সেই সাথে পর্তুগিজ ও মরক্কান খেলোয়াড়দের মধ্যে শুরু হলো কথা কাটাকাটি। এমনই একটি উত্তেজনাকর মূহূর্তে বেসামাল হয়ে এক পর্তুগিজ দর্শক গালি দিয়ে বসলেন মরক্কানদের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সাথেসাথেই পাশের চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালেন জনৈক মরক্কান ভক্ত, কড়া ধমক দিয়ে তাকে বললেন চুপ করতে। অতঃপর দুই ভক্তের মধ্যেও শুরু হলো উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, হাতাহাতি; এক পর্যায়ে একজন প্রহরী ছুটে এলেন দুজনকে থামাতে এবং তখন পর্তুগাল ভক্তই ক্ষমা চাইলেন প্রথমে।
পরবর্তীতে দালিল আমরানি নামের ওই মরক্কান ভক্ত দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানান, তিনিও পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকেই কাতারে উড়ে এসেছেন নিজ দলের খেলা দেখতে। আদতে মরক্কান নাগরিক হলেও অনর্গল ইংলিশে কথা বলতে পারা আমরানি জানান, তিনি লিসবনে একজন রাধুনী হিসেবে কাজ করেন। "আমার দোহায় আসার কোনো পরিকল্পনা ছিল না, কিন্তু মরক্কো নক-আউট পর্বে কোয়ালিফাই করতে আমি অনলাইনে টিকিট খুঁজতে শুরু করি। ৭০০ রিয়াল দিয়ে আমি প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট কিনি। তারপর আমার এক বন্ধু এই কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের টিকিট জোগাড় করে দেয়", হাপাতে হাপাতে বলছিলেন আমরানি।

বিশ্বকাপে একের পর এক অঘটনের জন্ম দিয়ে অবশেষে সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে আফ্রিকার দেশ মরক্কো। বছরের পর বছর ধরে 'ছোট দল'-এর তকমা পাওয়া আরব-আফ্রিকা বা এশিয়া মহাদেশের দলগুলো এবার ঘোল খাইয়ে দিয়েছে ইউরোপ-আমেরিকা অঞ্চলের বড় দলগুলোকে। আর তাইতো মরক্কোর ইতিহাস গড়ার সাক্ষী হতে আমরানির মতোই কাতারে ছুটে আসছেন হাজারো মরক্কান নাগরিক।
আমরানির প্রিয় খেলোয়াড় ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। কিন্তু খেলা যখন পর্তুগাল ও মরক্কোর, তাকে তো অবশ্যই নিজের জন্মভূমিকে সমর্থন দিতেই হবে। তার ভাষ্যে, "আমি একজন মরক্কান। আমি যেখানেই থাকি না কেন, মরক্কো আমার হৃদয়ের গভীরে। তাই আমি সবসময়ই মরক্কোকে সমর্থন দিবো।"
আমরানির মতো আরও হাজারো মরক্কান বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসছেন প্রিয় দলের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে। বাংলাদেশ সময় ১৫ ডিসেম্বর রাত ১টায় বিশ্বকাপের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের মুখোমুখি হবে আফ্রিকান সিংহরা। আরব-আফ্রিকা অঞ্চলের ইতিহাসে প্রথম দেশ হিসেবে এবার সেমি-ফাইনালে উঠেছে মরক্কো, তাই মরক্কানদের এখনকার আবেগ-ভালোবাসা অনুভূতিটা হয়তো লিখে বোঝানো সম্ভব না। আমরানি বলেন, "আমরা একটা ছড়ানো ছিটানো দেশ বলা যায়। সত্তর ও আশির দশকে যখন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল, দেশে নানা সংঘাত ছিল, তখন আমাদের অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে গেছে; বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে, যেমনটা আমাদের ফুটবলার এবং কোচরা গিয়েছেন।"

বলে রাখা ভালো, বর্তমান মরক্কো দলের ২৬ জন খেলোয়াড়ের ১৪ জনই বেড়ে উঠেছেন ফ্রান্স, স্পেন, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের মতো ইউরোপের দেশগুলোতে। দলের রক্ষাকবজ হাকিম জিয়েশ জন্মগ্রহণ করেছেন নেদারল্যান্ডসের ড্রোনটেনে। আরেক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় আশরাফ হাকিমির জন্ম স্পেনের মাদ্রিদে এবং কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুই জন্মগ্রহণ করেছেন ফ্রান্সের কর্বেইল-এসোনেস অঞ্চলে। মরক্কান দলের এই বিশ্বনাগরিকতার (কসমোপলিটানিজম) ধরনের কারণেই বিশ্বজুড়ে সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে দেশটির।
কাতারেই রয়েছে প্রায় ৪০ হাজার মরক্কান এবং এর দ্বিগুণেরও বেশি মানুষ মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলো থেকে দোহায় ছুটে আসছে খেলা দেখতে। এমনকি রয়্যাল মরক্কান এয়ারলাইন্সকে রাবাত থেকে দোহা রুটে বাড়তি সাতটি ফ্লাইট চালু করতে হয়েছে; টিকিটের জন্য চলছে হাহাকার, ম্যাচের টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। ইউরোপ ও আফ্রিকা থেকে আগত অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি মরক্কান সমর্থক এবার কাতারে এসেছেন বলা চলে।
একথা বলাই বাহুল্য যে, নিজের দেশকে সমর্থনের জন্য এই খাটুনি করার পাশাপাশি পকেটও ফাঁকা হয়ে গেছে মরক্কানদের। ফারাহ তাহিরি নিজে একটি ট্যুরিজম কোম্পানি চালান, লুক্সেমবুর্গে থাকার সময় হঠাৎ তার মনে ম্যাচ দেখার প্রচন্ড ইচ্ছা জেগে ওঠে। ফ্রাংফুর্ট থেকে ফ্লাইটের টিকিটের দাম দেখতে গেলেন তিনি, "দাম ছিল ৮০০ ইউরো। তারপর আমি থাকার জায়গা নিশ্চিত করতে একটা টিকিট কিনলাম, আরও ২০০ ইউরো দিয়ে। সৌভাগ্যবশত এক বন্ধু আমাকে সাহায্য করেছিল, কিন্তু তাও এক রাতের জন্য আরও ১০০ ইউরো তো দিতেই হবে। এতগুলো টাকা ব্যয় করা আমার জন্য খুব কঠিন ছিল, কিন্তু আমার কষ্ট সার্থক হয়েছে।

বেশিরভাগ মরক্কানই শুধু একটি ম্যাচের টিকিট কিনে কাতারে এসেছিলেন, হয়তো ভেবেছিলেন অন্য ম্যাচগুলোর টিকিট কোনো না কোনোভাবে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু এই মুহুর্তে মরক্কোর ম্যাচের টিকিটের চাহিদা এত বেশি যে মরক্কান ফুটবল ফেডারেশন 'আগে এলে আগে পাবেন' ভিত্তিতে ৫০০০ ফ্রি টিকিট বিতরণ করেছে। কাতার সরকারও তাদের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তবুও টিকিটের জন্য কাড়াকাড়ি লেগেই আছে। কেউ কেউ এই আশায় আছেন যে স্টেডিয়ামের বাইরে কেউ চড়া দামে তার টিকিট বিক্রি করলে সেটা লুফে নেবেন কিংবা পুলিশকে অনুরোধ করে ভেতরে ঢুকবেন। নক-আউট পর্বে স্পেনের বিপক্ষে খেলায় কাতারের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে মরক্কান সমর্থক ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের কথাও শোনা যায়। কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল, ওইসব সমর্থকদের কাছে টিকিট না থাকলেও তারা জোর করে ভেতরে ঢুকতে চাইছিল।
আমরানি বলেন, "স্টেডিয়ামের ভেতরে যত সমর্থক আছে, বাইরেও তেমনই। তারা মরক্কোর নাম ধরে উল্লাস করে, উৎসাহ-উদ্দীপনা জোগায়। এমনকি আমরানি নিজেও ম্যাচের কিছু কিছু ভিডিও করে স্টেডিয়ামের বাইরে থাকা তার বন্ধু আহমেদকে পাঠিয়েছেন। কেউ কেউ আবার আল বিদা ও কর্নিশে ফ্যান জোনের মধ্যে জড়ো হয়েছেন। তাহিরি নামের এক ভক্ত বলেন, "আমি ফ্যান জোনে খেলা দেখেছি, দারুণ লেগেছে। কিন্তু স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার সাথে তো এর তুলনাই হয় না।"

এদিকে স্টেডিয়ামের ভেতরে মরক্কান সমর্থকদের উল্লাসের জোয়ারে কান পাতা দায়! ২০১৬ ইউরোর সময় আইসল্যান্ডের সমর্থকরা যেমন করেছিলেন- তেমনই হাজার হাজার মরক্কান ভক্ত 'সের' (চলো, চলো) রবে মাতিয়ে তোলেন স্টেডিয়াম। ক্রিমসন রঙের জার্সি পরে, মুখে নিজেদের পতাকা রঙ একে স্টেডিয়ামে ঢোকেন তারা। আরব অঞ্চলের অন্যান্য দেশের ভক্তরাও এ্খন মরক্কোকে সমর্থন দিচ্ছেন।
"আমি বলবো এই বিশ্বকাপ সারা বিশ্বের আনাচে-কানাচে থাকা সব মরক্কানদের একত্রিত করেছে। অর্ধেক মরক্কোই এখন কাতারে", বলেন তাহিরি। আমরানি ও তাহিরি দুজনেই ২১ ডিসেম্বর লিসবন ও ফ্রাংকফুর্টে ফেরার টিকিট বুক করে ফেলেছেন। ১৮ তারিখ ফাইনালের পরেও দুদিন বাড়তি সময় রেখেছেন তারা; যদি ফাইনালে পৌঁছে বিশ্বকাপই জিতে যায় মরক্কো! তাই উদযাপনের সুযোগ মিস করতে চান না তারা- হাসতে হাসতে বললেন তাহিরি। কিন্তু মরক্কো বিশ্বকাপ জিতুক বা না জিতুক, সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীরা মরক্কোর যোগ্যতা ও ক্ষমতা ইতোমধ্যেই দেখে ফেলেছে এবং তাদের সমর্থকগোষ্ঠী যে অজেয় তাও প্রমাণ হয়ে গিয়েছে।
সূত্র: দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস