পাঠ্যবই বদলেই মুছে ফেলা যাবে না ভারতের জটিল ইতিহাস—মুখোমুখি হওয়াটাই প্রয়োজন

গত মাসে ভারতের জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ পরিষদ (এনসিইআরটি) সপ্তম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। এর ফলে ঐতিহাসিক নির্ভুলতা ও আদর্শিক উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দানা বাঁধে।
সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশনের (সিবিএসই) আওতাধীন স্কুলগুলোতে ব্যবহৃত পাঠ্যবই থেকে দিল্লি সালতানাত ও মুঘল সাম্রাজ্য সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বাদ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সদ্যসমাপ্ত মহাকুম্ভসহ প্রাচীন ভারতীয় রাজবংশ এবং হিন্দু তীর্থস্থান নিয়ে নতুন বিষয়বস্তু যুক্ত করা হয়েছে। সংশোধিত পাঠ্যে মৌর্য, শুঙ্গ ও সাতবাহনের মতো রাজবংশগুলোর ওপর বিশেষভাবে আলোকপাত করে ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে শতাব্দীব্যাপী মুসলিম শাসনের ইতিহাস প্রায় পুরোপুরি বাদ পড়েছে।
এ নতুন পাঠ্যক্রম ঘিরে একটি গভীর প্রশ্ন সামনে এসেছে—শিক্ষা কি ইতিহাসের যাচাইযোগ্য তথ্যকে গুরুত্ব দেবে, না-কি সাংস্কৃতিক স্মৃতি ও ধর্মীয় আখ্যানকে? রামায়ণ ও মহাভারতের মতো ধর্মীয় মহাকাব্য ভারতের সভ্যতার গঠনে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু ইতিহাসবিদেরা বারবার সতর্ক করেছেন যে, পৌরাণিক কাহিনীকে প্রমাণভিত্তিক ইতিহাসের সমতুল্য হিসেবে দেখানো এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাদের মতে, পৌরাণিক গল্পে প্রতীকী অর্থ ও নৈতিক বার্তা থাকতে পারে, কিন্তু ইতিহাস গঠিত হয় প্রমাণ ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে।
নতুন পাঠ্যে ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গ এবং হিমালয় অঞ্চলের চারধাম তীর্থস্থানসহ 'পবিত্র ভূগোল'কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, এতে ভক্তিমূলক বিশ্বাস ও ঐতিহাসিক সত্যের মধ্যকার প্রয়োজনীয় পার্থক্য অনুপস্থিত। ফলে, ইতিহাস শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য—প্রমাণভিত্তিক জ্ঞান ও সমালোচনামূলক চিন্তা—প্রতিহত হচ্ছে।
এ পরিবর্তনগুলোকে অনেকেই ভারতের পাঠ্যক্রমে আদর্শিক হস্তক্ষেপের ধারাবাহিক অংশ হিসেবে দেখছেন। অতীতেও বিভিন্ন সরকার তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ করেছে। ২০২৩ সালের এনসিইআরটি সংশোধনের মাধ্যমে দ্বাদশ শ্রেণি থেকে মুঘল শাসন, দলিত লেখক ওমপ্রকাশ বাল্মীকি এবং দশম শ্রেণির বিবর্তনতত্ত্ব বাদ দেওয়া হয়েছিল। ইতিহাসবিদেরা এ 'মুছে দেওয়া'র প্রবণতাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন, কারণ এতে ভারতের ইতিহাসে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অবদানকে ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ।
এ পরিবর্তন নিয়ে সমাজে দ্বিমত স্পষ্ট। ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রুশকে মন্তব্য করেছেন, মুঘলদের পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিলে তাদের ইতিহাস মুছে যাবে না। তবে শিক্ষার্থীরা ভারতের বহুবর্ণ অতীতের পূর্ণ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ চিত্র থেকে বঞ্চিত হবে। শিক্ষাবিদ অপূর্বানন্দ বলেছেন, এ পরিবর্তনের ফলে ভারতীয় ইতিহাসকে একমাত্র হিন্দু পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যা উপমহাদেশের দীর্ঘ ইসলামিক ও সমন্বয়ধর্মী ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে।
অন্যদিকে, শাসক দল বিজেপি-সমর্থিত ব্যক্তিরা এ পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের মতে, এ পদক্ষেপ পাঠ্যক্রম থেকে ঔপনিবেশিক ও মার্কসবাদী প্রভাব দূর করে প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি প্রয়াস। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এতে জাতীয় গর্ব ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় বৃদ্ধি পাবে।
এনসিইআরটি'র পরিচালক দীনেশ প্রসাদ সাকলানি বলেছেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো স্পর্শকাতর বিষয় পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া যৌক্তিক। তার মতে, এমন বিষয় শিক্ষার্থীদের মানসিকতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সমালোচকেরা মনে করেন, এটি ইতিহাসকে 'স্যানিটাইজ' করার চেষ্টামাত্র—যেখানে অস্বস্তিকর সত্যগুলো এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।
নতুন পাঠ্যক্রমে সাম্প্রতিক মহাকুম্ভ মেলার অন্তর্ভুক্তিকে অনেকে 'নির্বাচিত ইতিহাসচর্চার' বড় উদাহরণ হিসেবে দেখছেন। বলা হয়েছে, এতে ৬৬ কোটিরও বেশি তীর্থযাত্রী অংশ নিয়েছেন—এ বিশাল সংখ্যাটি তুলে ধরে উৎসবটির সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে জোর দেওয়া হয়েছে। বর্ণনার ভাষাও ছিল গৌরবময়। কিন্তু এ মেলাতেই প্রয়াগরাজে পদদলনে কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনাটি কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। সমালোচকেরা বলছেন, এটি ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া, যার পেছনে রয়েছে একটি নির্দিষ্ট আদর্শিক লক্ষ্য—যেখানে সংঘাত ও বিতর্ক এড়িয়ে ইতিহাসকে মসৃণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ইতিহাসবিদদের মতে, এ ধরনের উপস্থাপনায় ইতিহাসের জটিলতা হারিয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা আধুনিক ভারতের বড় ধর্মীয় সমাবেশগুলো ঘিরে যে বাস্তব সামাজিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ থাকে, তা বুঝতে ব্যর্থ হতে পারে।
এখানেই উঠে আসে আরেকটি প্রশ্ন—ইতিহাস কি শুধু শাসক, যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যের গল্প, নাকি সব সম্প্রদায়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার সমন্বয়? দিল্লি সালতানাত ও মুঘল শাসনকাল নিয়ে সম্পূর্ণ অধ্যায় বাদ দিয়ে নতুন পাঠ্যবইগুলো ভারতের অতীতের একটি বড় অংশ উপেক্ষা করছে। এতে ইতিহাসকে একপাক্ষিকভাবে তুলে ধরার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা একটি নির্দিষ্ট আদর্শের সঙ্গে খাপ খায়।
ভারতের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পাঠ্যক্রমে স্থান দেওয়া অনৈতিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো—ইতিহাস কীভাবে লেখা হবে? কোন তথ্য কোন বিশ্বাসের ভিত্তিতে যুক্ত হবে? সমস্যা দেখা দেয়, যখন মিথকে সত্য হিসেবে তুলে ধরা হয় এবং ইতিহাস বিকৃতির ন্যায্যতা দিতে সাংস্কৃতিক গর্বকে ব্যবহার করা হয়।
এ পরিবর্তনগুলো ভারতের সমাজে চলমান বৃহৎ আদর্শিক সংঘাতকে তুলে ধরে—একদিকে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ, অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা; অন্যদিকে জাতিকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ। এটি শুধু শিক্ষার বিষয় নয়—এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের পরিচয়, দেশ ও বিশ্বে নিজেদের অবস্থান কেমনভাবে গড়ে তুলবে, তার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে।
সমালোচকেরা এ প্রবণতাকে 'সাংস্কৃতিক গণহত্যা'র সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাদের মতে, পাঠ্যক্রম থেকে মুসলিম অবদান বাদ দেওয়া ভারতীয় পরিচয়কে ধর্মীয় ভিত্তিতে পুনর্গঠনের বৃহত্তর একটি প্রকল্পের অংশ। ইতিহাসবিদ এস. ইরফান হাবিব একে 'হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রচার' হিসেবে দেখেছেন, আর হারবানস মুখিয়া মনে করেন, এটি হিন্দু ভোটব্যাংককে ঐক্যবদ্ধ রাখার একটি সাংস্কৃতিক কৌশল।
এ প্রেক্ষাপটে সময়ের দাবি হলো—ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ বাদ না দিয়ে, সেগুলোকে সূক্ষ্মতা ও ভারসাম্যের সঙ্গে পাঠ্যক্রমে উপস্থাপন করা। যেমন, মুঘল সাম্রাজ্যকে কেবল একটি রাজনৈতিক যুগ হিসেবে নয়, তার শিল্প, স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক অবদানসহ উপস্থাপন করা উচিত। একইভাবে, মহাকুম্ভ মেলার আধ্যাত্মিক গুরুত্বের পাশাপাশি তার ব্যবস্থাপনাগত সমস্যাগুলোও স্বচ্ছভাবে আলোচনার মধ্যে আনা জরুরি।
একটি ভারসাম্যপূর্ণ ইতিহাস শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক ভাবনা ও নানান দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত হতে সহায়তা করবে। এতে ইতিহাস শিক্ষা হবে যুক্তি ও ঐতিহ্যের মধ্যকার একটি সেতুবন্ধন—যেখানে শিক্ষার্থীরা অতীতকে শুধুমাত্র গ্রহণ করে না, বরং তাকে প্রশ্ন করে, অন্বেষণ করে এবং গভীরভাবে বোঝে।
সবশেষে, ইতিহাস এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বরং তাকে সম্মুখীন হতে হয়, বোঝতে হয়, এবং সততার সঙ্গে শেখাতে হয়। কেবল তখনই আমরা এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারব, যারা ভারতের বৈচিত্র্যপূর্ণ ও জটিল ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান জানিয়ে একটি প্রগতিশীল ভবিষ্যৎ নির্মাণে সক্ষম হবে।
হাসনাইন নাকভি: মুম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ইতিহাস ফ্যাকাল্টির সাবেক সদস্য।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।