জমজমের পানি: কূপের ইতিহাস থেকে শুরু করে আধুনিক রূপান্তর

চার হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রবাহমান এক পবিত্র পানির জলাধার জমজম কূপ। পবিত্র হজ পালনকালে এই কূপের পানি পানের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির পরম অভিজ্ঞতা অর্জন করেন মুসলিম হজযাত্রীরা।
এ বছরের হজে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রায় ১৮ লাখ মুসলমান সমবেত হয়েছেন সৌদি আরবের মক্কায়। পবিত্র এই ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে ৮ জুন।প্রতিটি সক্ষম মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ পালন করা ফরজ। আর সেই হজের অবিচ্ছেদ্য অংশ পবিত্র জমজমের পানি।
জমজম কূপের অবস্থান?
মসজিদুল হারামের মধ্যে, কাবার ঠিক পূর্বদিকে ২১ মিটার দূরে অবস্থিত জমজম কূপ। ১৯৬২ সালে সৌদি বাদশাহ সৌদ কাবা ঘর তাওয়াফের স্থান সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন, যাতে আরও বেশি হজযাত্রী স্থান পেতে পারেন। সেই সময় কূপের মুখ নিচে নামিয়ে ২.৭ মিটার গভীরে বেজমেন্টে নেয়া হয়।
পরে, ২০০৩ সালে বেজমেন্টের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। জমজমের পানি প্রবাহ তখন সরিয়ে নেওয়া হয় পাশের ফোয়ারা ও পানির ডিসপেন্সারে।
বর্তমানে হজযাত্রীরা মসজিদুল হারামের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ফোয়ারা ও পানির স্টেশন থেকে জমজমের পানি পান করেন।

জমজম কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
জমজম শুধু একটি কূপ নয়; বরং এটি যেন একটি স্মৃতিচিহ্ন, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পবিত্র নগরী মক্কার জন্মকথা এবং নবী ইব্রাহিম (আ.), তার স্ত্রী হাজেরা (আ.) এবং সন্তান ইসমাইল (আ.)-এর গল্প।
ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, মহান আল্লাহর আদেশে ইব্রাহিম (আ.) তার স্ত্রী হাজেরা (আ.) ও শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.)-কে নির্জন মরুভূমিতে রেখে যান। পানি ও খাবার ফুরিয়ে গেলে, হাজেরা (আ.) পানির খোঁজে মরিয়া হয়ে ছোটাছুটি করেন—সাফা ও মারওয়া নামের দুই পাহাড়ের মাঝে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটে অলৌকিক ঘটনা, ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের কাছে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে পানির ধারা। সেই ধারাই পরবর্তীতে পরিচিত হয় 'জমজম' কূপ হিসেবে।
এই পানি শুধু তাদের প্রাণই বাঁচায়নি, বরং পরবর্তীতে এখানেই গড়ে ওঠে মক্কা নগরী, যেখানে আজ বাস করে প্রায় ২২ লাখ মানুষ।
হজ ও উমরাহ পালনকারীরা এই ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণে আজও 'সাঈ' নামের রীতি পালন করেন— যা হলো সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাতবার দৌঁড়ানো। এরপর তারা পান করেন জমজমের পবিত্র পানি। হাদিসে জমজমের পানিকে পবিত্র, উপকারী ও রোগ নিরাময়কারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

জমজম শব্দের অর্থ কী?
বিশ্বাস করা হয়, জমজমের পানির ধারা বেরিয়ে আসার পর হাজেরা (আ.) পানিকে ধরে রাখার চেষ্টা করতে থাকেন যাতে পানি নষ্ট না হয়। তিনি এর চারপাশে বালু জড়ো করে ধরে রাখার চেষ্টা করেন এবং তখন তিনি চিৎকার করে বলেন 'জম জম', যার অর্থ অনেকের মতে, 'থামো! থামো!'।
এই ছোট্ট শব্দেই পরিচিত হয়ে ওঠে বিখ্যাত এই জমজম কূপ।
জমজমের পানি কোথা থেকে আসে?
জমজমের পানির উৎস পবিত্র মসজিদুল হারামের নিচে অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক ভূগর্ভস্থ জলাধার। এই কূপটি প্রাকৃতিকভাবেই গঠিত হয়েছে বালি, পাথর ও শিলাস্তর দিয়ে, যেখানে পানি এসে জমা হয়। আশপাশের ইব্রাহিম উপত্যকা (ওয়াদি ইব্রাহিম) এবং কাছাকাছি পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি ধীরে ধীরে মাটির নিচে গিয়ে জমে এই ভূজলাধারে। আর এখান থেকেই উঠে আসে জমজমের পবিত্র পানি।
মূল কূপটি প্রায় ৩১ মিটার (১০১ ফুট) গভীর এবং এটি প্রথমে হাতে খনন করা হয়েছিল। কূপের ওপরের অংশ দিয়ে বালি , কাঁকর ও পাথরের ফাঁক গলে পানি প্রবেশ করে, আর নিচের অংশে পানির প্রবাহ আসে শক্ত শিলার ফাটল দিয়ে।
আগে যেখানে রশি আর বালতির মাধ্যমে পানি তুলতে হতো, এখন সেখানে আধুনিক বৈদ্যুতিক পাম্প ব্যবহার করা হয়। যদিও এখন জমজম কূপটি জনসাধারণের জন্য সরাসরি উন্মুক্ত নয়, তবে এর পানি পাওয়া যায় মসজিদের বিভিন্ন ফোয়ারা ও পানির ডিসপেন্সার থেকে।
প্রতিদিন কী পরিমাণ জমজমের পানি তোলা হয়?
জমজম কূপকে মনে করা হয় এক অলৌকিক জলধারা হিসেবে, যা প্রায় ৪,০০০ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে পানির জোগান দিয়ে চলেছে। হজ ও উমরাহর আচার-অনুষ্ঠানে এই পানির কেন্দ্রীয় ভূমিকা—ইতিহাসে শত শত বছর ধরে বিশদভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
সাধারণ দিনগুলোতে জমজম কূপ থেকে উত্তোলিত পানির পরিমাণ অন্তত ৯ লাখ ৫০ হাজার লিটার, তবে হজ ও রমজানের মতো ভিড়ের মৌসুমে উত্তোলন বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৬ লাখ লিটার পর্যন্ত।
এই বিপুল চাহিদা মেটাতে জমজম কূপের পানির স্তর, পিএইচ (অম্ল-ক্ষার মাত্রা), তাপমাত্রা ও পরিবাহিতা রিয়েলটাইমে নজরদারির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ডিজিটাল সেন্সর। পাশাপাশি, ওয়াদি ইব্রাহিম জুড়ে স্থাপন করা অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণ কূপগুলো সাহায্য করছে পুরো ভূগর্ভস্থ জলাধার বৃষ্টিপাত ও পানি ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া বোঝার কাজে।
জমজম পানি কীভাবে সাধারণ পানির থেকে ভিন্ন?
জমজম পানি দেখতে স্বচ্ছ, গন্ধহীন হলেও এর স্বাদ একটু আলাদা কারণ এতে রয়েছে প্রাকৃতিক খনিজ উপাদান। এর পিএইচ মাত্রা ৭.৯ থেকে ৮.০ হওয়ায় এটি সাধারণ পানির চেয়ে সামান্য ক্ষারধর্মী, যা স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উপকারী।
কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, জমজম পানিতে কোনো ধরনের ক্ষতিকারক জীবাণু বা শৈবালজাতীয় উদ্ভিদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি । এসব পদার্থ অন্যান্য অনেক কূপের পানিতে প্রায়ই পাওয়া যায়, যা পানির স্বাদ ও নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলে।
এই পানিতে থাকা খনিজ উপাদানগুলো স্বাস্থ্যের জন্য নানা উপকারে আসে:
ফ্লুরাইড: দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধে সাহায্য করে। বিশেষ করে গরম আবহাওয়ায় খুব প্রয়োজনীয়।
ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম: জমজমের পানিতে এসব খনিজ উপাদান মেলে আয়নিক আকারে , যা শরীর খুব সহজে শোষণ করতে পারে।
সোডিয়াম ও পটাশিয়াম: শরীরের পানিশূন্যতা রোধ করে, স্নায়ু ও পেশি কার্যকারিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মোট খনিজের মাত্রা হিসাব করলে, জমজমের পানিতে প্রতি লিটারে প্রায় ৮৩৫ মিলিগ্রাম খনিজ থাকে, যেখানে সৌদির রাজধানী রিয়াদের নলকূপের পানিতে তা মেলে মাত্র ৩৫০ মিলিগ্রাম।
@জমজমের পানি বিতরণ ব্যবস্থা
সৌদি সরকার জমজমের পানিকে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার বা বিক্রি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। এটি শুধু হজযাত্রীদের জন্য বিতরণ করা হয়, যাতে পানির গুরুত্ব ও পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ থাকে।
হজ বা উমরাহ শেষে অনেক তীর্থযাত্রী ৫ লিটার বিশিষ্ট বোতল করে জমজম পানি নিজের দেশে পরিবার ও বন্ধুদের কাছে নিয়ে যান। বিমান সংস্থাগুলো সাধারণত এই পানিকে সাধারণ লাগেজের আওতায় রাখে না, তাই যাত্রীরা আলাদা ব্যাগে বা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে এই পানি পরিবহন করেন।
জমজম পানি সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বিতরণ করতে সৌদি কর্তৃপক্ষ একটি আধুনিক, বহু স্তর বিশিষ্ট ব্যবস্থাপনা তৈরি করেছে। মসজিদুল হারাম থেকে জমজম পানি বৈদ্যুতিক পাম্পের মাধ্যমে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে 'কুদাই' এলাকায় কিং আবদুল্লাহ জমজম ওয়াটার প্রকল্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পানি বোতলজাত করা হয়।