নতুন সংঘর্ষের মুখোমুখি স্নায়ুযুদ্ধের দুই শিশু- বাইডেন ও পুতিন

এক দশক আগে মস্কোতে আয়োজিত এক সভায় পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন ও জো বাইডেন। সৌজন্যবোধের ধার না ধেরেই সাবেক ঝানু কেজিবি সদস্য পুতিনকে জো বাইডেন বলেন, "আপনার চোখগুলো দেখছি। মনে হয় না আপনার হৃদয় আছে।" শুনে পুতিন হেসেছিলেন।
সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাইডেন একবার বলেছিলেন "আমরা একে অপরকে বুঝতে পারি।" এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র যখন ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করতে বিশ্বকে একত্রিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে তখন বাইডেন ও পুতিন পরস্পরকে আরও ভালোভাবে বুঝে ওঠার চেষ্টা করছেন। কার পরবর্তী চাল কী হবে সেটা ধরতেই উঠেপড়ে লেগেছেন দুই নেতা। দুজনের একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এই প্রতিযোগিতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখো মানুষের ভাগ্য।
বার্লিন ও কিউবা নিয়ে জন এফ কেনেডি ও নিকিতা ক্রুশ্চেভের পর আর কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বা রাশিয়ার নেতা এতো নাটকীয় পরিস্থিতিতে পরস্পরের মুখোমুখি হননি। পরমাণু শক্তিধর দুই রাষ্ট্র ছয় দশক আগের মতো নিজেদের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত না হলেও দুপক্ষের এই দ্বন্দ্বের পরিণাম সারা বিশ্বেই প্রভাব ফেলবে। আসন্ন বছরগুলোতেও বিশ্ববাসী সম্ভবত তা ভালোমতোই টের পেতে চলেছে।
ইউক্রেনে হামলা চালানোর জন্য পুতিনকে আগ্রাসী বলে তিরষ্কার করেছেন বাইডেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকেও পুতিনকে সরিয়ে দিতে তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গত শুক্রবার বাইডেন পুতিনের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেন। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালেও কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘটনা ঘটেনি।
তবে রাশিয়ানরা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ভঙ্গুরতা সম্পর্কে অবগত। আমেরিকার সিদ্ধান্তহীনতা ও মতানৈক্যে ভোগার সময়টিই বেছে নিয়ে বাইডেনের পরীক্ষা নিচ্ছেন পুতিন।
বাইডেন সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্ক কমিটির চেয়ারম্যান থাকাকালে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ফ্র্যাঙ্ক লোয়েনস্টেইন। তার মতে, "এই দুজন দুই ভিন্ন পৃথিবীর বাসিন্দা। তাদের দুজনের সংঘাত কোথায় ঘটবে তা অনুমান করা কঠিন। বাইডেন পুরোনো নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বাসী। অন্যদিকে পুতিন বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনা ভাঙতে চাচ্ছেন।"
গত কয়েক সপ্তাহে বাইডেন তার উপদেষ্টা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে পুতিনের হিসেব-নিকেষ ও পরিকল্পনা উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত তা সফল হয়নি বলেই ধরে নেওয়া চলে।
পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই ইউক্রেন সম্পর্কে তিক্ততা পোষণ করেছেন। ইউক্রেনকে একটি প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেও মানতেন না তিনি। তবে করোনাভাইরাস মহামারি চলাকালে দীর্ঘ দুই বছর আইসোলেশনে কাটানোর সময়ই পুতিন সবেচেয়ে কঠোর সিদ্ধান্তগুলো নেন।
মহামারির সময় অন্যান্য যেকোনো বিশ্বনেতার চেয়ে অনলাইনে পুতিনের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে কম। এমনকি নিজের অধীনস্ত কর্মকর্তাদের থেকেও তিনি দূরত্ব বজায় রেখেছেন। সাম্প্রতিক ভিডিও চিত্রগুলোতে দেখা যায়, পুতিন বৈঠককালে বিদেশি এমনকি রাশিয়ান কর্মকর্তাদের থেকেও দুরত্ব বজায় রেখে চলেছেন। দুই দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পর নিজের ৭০তম জন্মদিনের কাছাকাছি সময়ে এসে পুতিন নিজের ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য আরও বেশি মরিয়া হয়ে উঠেছেন
তবে পুতিন সীমা অতিক্রম করছেন কি না তা নিয়ে আমেরিকান বিশ্লেষকদের মধ্যেও বিতর্ক চলছে। ইউক্রেনের সীমান্তে যখন রাশিয়ার সৈন্যরা জড়ো হচ্ছে তখন বাইডেন পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করার সব ধরনের চেষ্টা চালান। টেলিফোনে আলোচনা করার চেষ্টা থেকে শুরু করে রাশিয়ান কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য তিনি অসংখ্য দূত পাঠান। কিন্তু তার আহ্বানে কেউ সাড়া দেয়নি।

নিজের শাসন ব্যবস্থার শেষ পর্যায়ে এসে পুতিন যদি নতুন করে ইতিহাস লেখার চেষ্টা করেন বা ১৯৯১ সালে 'অন্যায়ভাবে' সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার হিসাব পূরণ করতে নতুন করে পুরোনো সাম্রাজ্য দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন তাহলে এই উদ্যোগ পুরোনো কোনো কৌশল দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মনে হয় না।
নতুন কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা বাইডেনও করছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালে পুতিনের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সমালোচনাই বেশি করতেন। বাইডেন সাম্প্রতিক সময়ে ট্রান্স আটলান্টিক জোটকে সংহত করতে ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে মনোযোগ দিয়েছেন। এই কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে আটলান্টিকের দুই পাড়েই আটকে গেছে পুতিনের অর্থ।
আমেরিকার পঞ্চম প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনের মুখোমুখি বাইডেন। কিন্তু তিনিই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ক্ষমতায় আসার আগেই সিনেটর ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাশিয়া সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণে ভূমিকা পালন করেন। আগের চার প্রেসিডেন্ট কোনো না কোনো মাত্রায় মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আশা রেখেছিলেন। কিন্তু বাইডেন কখনোই পুতিনকে বন্ধু বানানোর মতো ভ্রমে ভুগেননি।
তবে বাইডেন পুতিনের সঙ্গে একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। পুতিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার পেছনে সময় নষ্ট না করলেও তার প্রতি পর্যাপ্ত মনোযোগ বজায় রেখে যথাযথ সম্মান দিতে চেয়েছিলেন। রাশিয়ার পরিবর্তে বাইডেন চীনের দিকে কূটনৈতিক মনোযোগ দিতে চেয়েছিলেন।
গত বসন্তে ইউক্রেনের কাছে রাশিয়ার সৈন্য সমাবেশের মুখে বাইডেন জেনেভা শীর্ষ সম্মেলনে পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সম্মত হন। তবে এই আলোচনায় ক্রেমলিন নেতা লাভবান হবেন এমন পুর্বাভাস থেকে উপদেষ্টারা আলোচনায় আপত্তি জানায়।
বাইডেন যদি তার প্রতিপক্ষকে অবমূল্যায়ন করে থাকেন তবে পুতিনও একই কাজ করেছেন। সম্ভবত আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সময় সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে পুতিন আন্দাজ করেছিলেন যে বাইডেন আর ইউক্রেনে সেনা মোতায়েন করতে যাবেন না। আমেরিকান ও রাশিয়ান বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে কঠোর অবস্থান নিবে না সে সম্পর্কে পুতিন তখনই ধারণা পান।
সমালোচকদের অনেকেই মনে করেন বাইডেনের আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন ছিল। তবে ইউক্রেন নিয়ে পুতিনের পরিকল্পনা সামনে আসার পরই বাইডেন এই বিষয়ে আলোচনায় বসতে সক্রিয় হন। ইউরোপীয় মিত্রদেরও পুতিনের বিরুদ্ধে একত্রিক করতে উদ্যোগী হন তিনি।
নিউইয়র্কে শিক্ষকতা করা ক্রুশ্চেভের প্রপৌত্রী নিনা ক্রুশ্চেভের মতে, "কেনেডি ও ক্রুশ্চেভের মতো তারাও সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ হলেও স্নায়ুযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া আছে। আমার মনে হয় তারা পরস্পরকে ভালোমতোই বুঝে।"
বাইডেন ও পুতিন দুজনেই স্নায়ুযুদ্ধের সময় নিজেদের শৈশব পার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বন্দ্ব যখন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে তখন তারা শিক্ষাদীক্ষা শেষে সংসার জীবনে প্রবেশ করেন। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের শেষটা দুজন ভিন্নভাবে দেখেছেন। একজন এটাকে দেখেছেন গণতন্ত্রের বিজয় ও স্বাধীনতা হিসেবে। আরেকজন বিষয়টিকে দেখেছেন নিজের জাতি ও মানুষের জন্য নেমে আসা এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগ হিসেবে।
বাইডেন ও পুতিন দুজনেই স্বচ্ছলতার মাঝে বেড়ে উঠেছেন। তবে দুজনের ক্ষমতাই ভিন্নভাবে গড়ে উঠেছে। ৭৯ বছর বয়সী বাইডেন একজন বহুল প্রশংসিত রাজনীতিবিদ যিনি উদ্দ্যমী ব্যক্তিত্বের জন্য প্রশংসনীয়। অন্যদিকে ৬৯ বছর বয়সী পুতিন একগুঁয়ে এক সাবেক গোয়েন্দা এজেন্ট যিনি বহু ক্ষোভ ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব লালন করেন।
পুতিন কখনোই নিজে পরিবার নিয়ে কথা বলেন না। অন্যদিকে, বাইডেন সহজে কথা থামাতে পারেন না। ১৯৯৯ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন পুতিনকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচিত করার আগ অবধি পুতিন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। অন্যদিকে বাইডেন পুরো জীবনই রাজনীতির পেছনে কাটিয়েছেন।
বাইডেন একজন নিয়মিত রাজনীতিবিদ হলেও পুতিন এসেছে গোয়েন্দা বাহিনী থেকে যাদের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক কার্যক্রম মাফিয়াদের মতো। সোভিয়েতের ইতিহাস নিয়ে পুতিনের এখনও বিস্তর অভিযোগ আছে। তিনি ইতিহাসকে পুনরায় উলটে দিতে চান।

রাশিয়ান কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাইডেনের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। ১৯৭৯ সালে সিনেটর হিসেবে তিনি সোভিয়েত নেতা লিয়েনিড ব্রেজনেভের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বাইডেনই উভয়পক্ষের সম্পর্ককে নতুন করে শুরু করার প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু উত্তেজনা বাড়ার পরই তাকে ইউক্রেনের পক্ষে সমর্থনে নেতৃত্বদানের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। আর তখন থেকেই পুতিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
২০১১ সালে মস্কোতে ভ্রমণের পর পুতিনের সঙ্গে বৈঠককে বিতর্কিত হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন বাইডেন। বাইডেনের বর্ণনা অনুযায়ী, "পুতিন পুরো সময় ঠাণ্ডা মাথায় থাকলেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তর্ক করে গেছেন।"
পুতিন সম্পর্কে বুশ একবার বলেছিলেন, "তার হৃদয় উপলদ্ধি করা যায়।" বাইডেন বৈঠকে পুতিনকে আসলেই হৃদয়হীন বলে সম্বোধন করেছিলেন, না কি পুতিন সম্পর্কে বুশের বিখ্যাত মন্তব্যকেই ঠাট্টাচ্ছলে উড়িয়ে দিতে এই গল্প বলেছেন তা জানার উপায় নেই।
দুই নেতা যারা একসময় পরস্পরকে বুঝতে পারেন বলে দাবি করেছিলেন, তারাই আজ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন যার পরিণতি পুরো বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিতে চলেছে।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস