রোহিঙ্গা নেতা হত্যার ঘটনায় পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি আমেরিকা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর

গত বুধবার কক্সবাজারের কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার ঘটনায় পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা।
'রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর' নামে পরিচিত ৪৮ বছর বয়সী মুহিবুল্লাহ ছিলেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নামে একটি সংগঠনের চেয়ারম্যান। বুধবার রাতে কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পে অজ্ঞাত অস্ত্রধারীদের গুলিতে প্রাণ হারান তিনি।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মুখপাত্র হিসেবে অংশ নিয়ে সুনাম কুড়িয়েছিলেন মুহিবুল্লাহ। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে গিয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও তিনি দেখা করেন। ট্রাম্পের কাছে তুলে ধরেন মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশা ও নিপীড়নের কথা।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যাকাণ্ডে ব্যথিত। রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে একজন সাহসী ও নির্ভীক নেতা হিসেবে মুহিবুল্লাহর প্রশংসাও করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে ব্লিংকেন বলেন, 'আমরা তাঁর (মুহিবুল্লা) মৃত্যুর ঘটনায় একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানাচ্ছি, যেন এই বর্বরোচিত অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা যায়। রোহিঙ্গাদের পক্ষে কাজ অব্যাহত রাখা এবং ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের নিজ সম্প্রদায়ের সদস্যদের আওয়াজ তোলার সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমে আমরা তাঁর কাজকে সম্মান জানাব।'
এদিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, রোহিঙ্গারা একটি মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে মিয়ানমার সরকারের কারণে দিনের পর দিন যে কষ্ট সহ্য করে চলেছে, মুহিবুল্লাহর মৃত্যুতে সেই বিষয়টিরই প্রতিফলন ঘটেছে।
'তাঁর হত্যাকাণ্ড একটি স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ যে শরণার্থী শিবিরে যারা স্বাধীনতার পক্ষে ও সহিংসতার বিরুদ্ধে সরব হয়, তাদের ঠিক কী ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়।'
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাও মুহিবুল্লাহর উপর আক্রমণের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা বিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে তারা যোগাযোগ রাখছে।
'আমরা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন তাৎক্ষণিক তদন্ত কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয়, এবং এই ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনে,' বলেছে সংস্থাটি।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের নেতা হিসেবে মুহিবুল্লাহ শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাত থেকে বেঁচে ফেরাদের সাক্ষ্য নথিভুক্ত করতে প্রচণ্ড খেটেছেন। তাঁর তৈরি করা বিস্তারিত নথিগুলোই ব্যবহৃত হয়েছে বিভিন্ন তদন্তে, যার মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের একটি তদন্ত অন্যতম।
২০১৯ সালে তিনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাউন্সিলে বক্তব্য রাখেন। পরবর্তীতে ওই বছরই ধর্মীয় কারণে নিপীড়নের শিকার একটি দলের সদস্য হিসেবে হোয়াইট হাউজে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে তিনি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা 'পদ্ধতিগত গণহত্যা'র শিকার হয়েছে, এবং সে-দেশের সরকার তাদের নাগরিকত্বের অধিকার হরণ করেছে।
'কল্পনা করে দেখুন, আপনার কোনো পরিচয় নেই, জাতি নেই, দেশ নেই, কেউই চায় না আপনাকে,' তিনি বলেন, 'তখন কেমন অনুভব করবেন আপনি? ঠিক তেমনটিই আজ আমরা রোহিঙ্গা হিসেবে অনুভব করছি।'
তিনি আরো বলেন, যদি তাদেরকে নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হয়, তাহলে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছুক।
'আমরা রাষ্ট্রহীন নই। আমাদেরকে অমন নামে ডাকা বন্ধ করুন। আমাদের একটি রাষ্ট্র রয়েছে, সেটি হলো মিয়ানমার,' তিনি বলেন।
কিন্তু মুহিবুল্লাহর আন্তর্জাতিক খ্যাতি যত বাড়তে থাকে, ততই বাড়তে থাকে তাকে হত্যার হুমকি।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হাজার হাজার শরণার্থী মুহিবুল্লার নামাজে জানাজায় অংশ নেয়। পরে তাকে শিবিরের ভেতরের কবরস্থানে দাফন করা হয়।
গত বছর থেকেই মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলে আসছে যে অন্তত ২ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তাদের আশ্রয়স্থল ছেড়ে পালাতে হয়েছে। কেননা তারা শিবিরের অভ্যন্তরীণ অবৈধ নেশাদ্রব্য বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ দখল নিয়ে দুই দলের লড়াইয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল।