মহামারিতে উজাড় হচ্ছে আমেরিকা ট্রাম্প তখন গলফ খেলছেন!

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিনই যখন কোভিড-১৯ সংক্রমণের নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে, ঠিক তার মাঝেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজের অবসরকালীন নানা শখ মেটাচ্ছেন মনের সুখে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কার্যকালাপ মার্কিন জাতিস্বত্বাকে বিভাজিত করছে, জন্ম দিচ্ছে নতুন বিতর্কের। এসব নিয়ে অবশ্য বরাবরের মতোই 'থোরাই পরোয়া' মনোভাব প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি। উল্টো মহামারি পরিস্থিতি মোকাবিলায় তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যর্থতা ও উদাসীনতার যে অভিযোগ রয়েছে, প্রতিদিন তার স্বপক্ষে প্রমাণের পাল্লা ভারি করে চলেছেন।
শতাব্দীর সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য খাতের বিপর্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র। এই সঙ্কট মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে, দুর্যোগের কালো মেঘদলকেই ভারি করেছে বর্তমান মার্কিন সরকার।
গত শুক্রবার বার্তা সংস্থা সিএনএন প্রকাশিত এক সংবাদে জানানো হয়, ট্রাম্পের নির্বাচনী জনসভাগুলো চলাকালে তাকে সংক্রমণ মুক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে হোয়াইট হাউজ। এই প্রচেষ্টা খুব একটা সহজ নয় অবশ্য। ট্রাম্পের নির্বাচনী সমাবেশে তিনি ও তার সমর্থকের দল, সামাজিক দূরত্বের বিধি মানছেন না। মাস্ক না পড়েই হাজির হচ্ছেন জনসমাগমে। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সংক্রমণ মোকাবিলার চেষ্টাকে যেন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকি নিজ সমর্থকদেরও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছেন তিনি।
এর মাঝে আবার সময় বের করে বর্ণবাদী প্রচারণায় নিজের সমর্থন জানানো অব্যাহত রেখেছেন। সম্প্রতি প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি অ্যান্ড্রু জ্যাকসনের মূর্তি রক্ষা করার পক্ষে নিজ অভিমত দিয়েছেন তিনি। ১৮৩৭ সালে অ্যান্ড্রু জ্যাকসন অবসরগ্রহণের পর তার মালিকানাধীন একটি শস্যচাষ কেন্দ্রের দেখাশোনা করে বাকি জীবন কাটান। ওই স্থাপনায় কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের দিয়ে কাজ করানো হতো।
শুধু তাই নয়, সম্প্রতি ট্রাম্প আরেকটি নগ্ন বর্ণবাদী ভিডিও টুইট করেন। সেখানে তার এক সমর্থককে 'শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য' প্রতিষ্ঠার পক্ষে স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
আবার আফগানিস্তানে তালেবান যোদ্ধাদের রাশিয়া অর্থ দিয়ে মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনাদের খুন করিয়েছে এমন তথ্য-প্রমাণ সম্বলিত গোয়েন্দা প্রতিবেদন মার্কিন গুপ্তচরেরা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনটি প্রেসিডেন্ট এবং প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরেও পৌঁছানোর দাবি করে গোয়েন্দা সূত্র। অথচ সেই সম্পর্কে তাকে কিছুই জানানো হয়নি এমন দাবি করেছেন ট্রাম্প। এমনকি এই ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেবেন, তা জানানোর সময় পাননি তিনি।
সময় অবশ্য অন্য কাজে ঠিকই বের করতে পারছেন। নিজের পূর্বসূরি সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কালেভদ্রে গলফ খেলার অভ্যাস নিয়ে এক সময় সমালোচনাকারী ডোনাল্ড ট্রাম্প, এখন নিজেই ব্যস্ত গলফ কোর্সে। ভার্জিনিয়ায় নিজের মালিকানাধীন গলফ কোর্সে দেশে মহামারি পরিস্থিতির অবনতির মাঝেও তিনি সম্প্রতি দুইবার গেছেন।
এর আগে অবশ্য তিনি নিজেই দাবি করেন যে, বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনকারীদের হাতে রাজধানী ওয়াশিংটনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন অবনতি না হয়, সেজন্যেই নাকি তিনি তার নির্ধারিত নিউজার্সি সফর বাতিল করেছেন। করোনায় বিপর্যস্ত মার্কিন অঙ্গরাজ্যটিতে বিপুল কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের বসবাস। দারিদ্র্যের কারণে যাদের অনেকেই স্বাস্থ্যগত সমস্যায় আক্রান্ত, আর সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হওয়ার পর একারণে কৃষ্ণাঙ্গরাই বেশি মারা গেছেন অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর তুলনায়।
ট্রাম্প রোববার নিজের সাপ্তাহিক ছুটি যেভাবে গলফ খেলে পার করেছেন, তার মধ্য দিয়ে মহামারি মোকাবিলায় যে তার মোটেই মনঃসংযোগ নেই বার্তাও দিলেন যেন। অথচ এই কোভিড-১৯ সংক্রমণ এখন পর্যন্ত এক লাখ ২৫ হাজারের বেশি মার্কিনীর জীবন কেড়েছে। আগামীদিনেও এর ফলে লাখো মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।
পরিস্থিতি এই পর্যায়ে এসেছে ট্রাম্পের কারণেই। তার প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা, অবহেলা এবং সঙ্কটকালীন পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক কাঁদা ছোড়াছুড়ি যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। নিজ প্রশাসনের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অবজ্ঞা করেই অর্থনীতিকে সচল করতে জোর করে দেশে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনে প্ররোচনা দেন তিনি ও তার প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে জনস্বাস্থ্যের চাইতে অর্থনীতিকেই প্রাধান্য দেওয়া শুরু করেছিলেন 'অস্থিরমতি' মার্কিন রাষ্ট্রপতি।
একাধিক বার ট্রাম্প প্রশাসনের স্বাস্থ্য উপদেষ্টারা তাকে সতর্ক করার চেষ্টা করেন। কিন্তু শুধু ট্রাম্প নন, কানে তুলো গুঁজে নির্বাচনে ট্রাম্পকে জয়ী করার চেষ্টায় ব্যস্ত তার শীর্ষ সহযোগীরাও। গত শুক্রবার মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স দাবি করেন, সংক্রমণ হার স্থিতিশীল রাখতে যুক্তরাষ্ট্র নাকি অসাধারণ সফলতা অর্জন করেছে!
অথচ এর আগেই, ট্রাম্প প্রশাসনের জনস্বাস্থ্য এবং মানব পরিষেবা দপ্তরের মন্ত্রী অ্যালেক্স আজার সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে, বর্তমান অবস্থাকে চরম সঙ্কটের সঙ্গে তুলনা করে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
এসময় অ্যালেক্স আজার বলেছিলেন, এটা খুবই, খুবই জরুরি অবস্থা। আর সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার সময় ও সুযোগ প্রতি মুহূর্তেই হারিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, যুক্তরাষ্ট্রে করোনার সংক্রমণকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না।
গত শুক্রবার মাইক পেন্সের 'ব্যাপক উন্নতি' দাবির পর থেকে দৈনিক ৪০ হাজারের বেশি মানুষের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ছে। এর মধ্যে শুক্রবারে ৪০ এবং শনিবারে শনাক্ত হয়েছেন ৪২ হাজার। ট্রাম্পের আহ্বানে সাড়া দিয়ে- ফ্লোরিডা, টেক্সাস এবং অ্যারিজনার মতো যেসব রাজ্য অর্থনীতিকে সচল করেছিল তাদের সংক্রমণ পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে উদ্বেগজনক।
অবস্থাদৃষ্টে এটা স্পষ্ট যে, প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের হঠকারী শাসক নিরোর মতো নগরে আগুন না লাগালেও দেশে মহামারির বিস্তার করে নিজে বেশ নির্ভাবনায় আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে তার হয়তো জানা নেই- নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও তার হাত থেকে রক্ষা পায়না। আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচনে সেই আগুনের আঁচটা বেশ ভালোই অনুভব করবে ট্রাম্পের রিপাবলিকান দল।
- সূত্র: সিএনএন
- লেখক: স্টিফেন কলিনসন, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
- অনুবাদ: নূর মাজিদ